পৌনে ২ কেজি স্বর্ণ ৪০ হাজার, ২০ বিঘা জমি ২ হাজার, বারিধারায় ফ্ল্যাট ১.৩০ লাখ টাকা

১৪৮ ভরি (১.৭২ কেজি) স্বর্ণের দাম ৪০ হাজার টাকা! বিশ বিঘা জমির দাম দুই হাজার টাকা! বরিশালে ৪০০ টাকা মূল্যের পাঁচ কাঠা প্লট! আর বারিধারার একটি ফ্ল্যাটের দাম ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা!

শুনতে যতই উদ্ভট মনে হোক না কেন, আইনপ্রণেতা হতে চেয়ে প্রার্থীদের কয়েকজনের হলফনামায় এসব তথ্যই উল্লেখ করা হয়েছে।

হলফনামা অনুযায়ী, সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও লালমনিরহাট-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নুরুজ্জামান আহমেদের ২৫ বিঘা জমি আছে যার মূল্য ৩১ হাজার ৫০০ টাকা। এই দাম একজন পোশাক শ্রমিকের মাত্র দুই মাসের ন্যূনতম মজুরির সমান।

রংপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল কালাম আহসানুল হক চৌধুরীরও ২৫ বিঘা জমির মালিক। নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় তিনি জানিয়েছেন, এই জমির মূল্য ৭০ হাজার টাকা।

তাদের মতো আরও অনেক প্রার্থী তাদের অনেক বেশি মূল্যের সম্পদ এত কম দামে দেখিয়েছেন যা হাসির উদ্রেক করে। ডেইলি স্টার বেশ কয়েকজন প্রার্থীর হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখেছে যাদের উল্লিখিত সম্পদের মূল্য শুধুমাত্র সুদূর অতীতেই সম্ভব হতে পারে।

হলফনামা এক ধরনের লিখিত শপথ, যেখানে মিথ্যা তথ্য দেওয়া ফৌজদারি ও নির্বাচনী আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ফৌজদারি আইনে এর শাস্তি তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং নির্বাচনী আইনে প্রার্থিতা বাতিল পর্যন্ত হতে পারে।

সংসদ সদস্য প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় আটটি ব্যক্তিগত ও আর্থিক তথ্য সম্বলিত একটি হলফনামা জমা দিতে হয়।

সুপ্রিম কোর্ট ২০০৭ সালে এক যুগান্তকারী রায়ে ইসিকে এসব তথ্য সংগ্রহ করে তা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে বলেছে।

পরে নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) এ সংক্রান্ত একটি বিধান অন্তর্ভুক্ত করে, যা সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আইনি কাঠামো।

তবে হলফনামায় অসঙ্গতি প্রকট।

সুদূর অতীতের সম্পদ মূল্য

পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও বরিশাল-৫ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহিদ ফারুকের বারিধারা ডিওএইচএসে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যার মূল্য দেখানো হয়েছে ১৩ লাখ টাকা। বিলাসবহুল এই এলাকায় কিছু ফ্ল্যাটের মাসিক ভাড়াই মন্ত্রীর ফ্ল্যাটের দেখানো মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

আরেক অভিজাত এলাকা গুলশানে-২ এ একটি আট তলা ভবনের মালিকানা অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রীর। যার মূল্য দেখানো হয়েছে ৩৫ লাখ টাকা।

ঢাকার অন্যতম দামি এলাকা ধানমন্ডিতে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী সেলিম ওসমানের স্ত্রীর ৪ হাজার ২৬৫ স্কয়ার ফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। যার মূল্য দেখানো হয়েছে ১৩ লাখ ১০ হাজার টাকা।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু জানিয়েছেন, তার বারিধারার ফ্ল্যাটের দাম ৩২ লাখ টাকা।

বরিশাল-৬ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন আব্দুল হাফিজ মল্লিক।

মল্লিকের হরফনামায় দেখা যাচ্ছে, তিনি পাঁচ কাঠা সরকারি প্লটের মালিক। তবে সেটি কোথায় তিনি তা উল্লেখ করেননি। তবে এর মূল্য বলেছেন ৪০০ টাকা। এই দামে আজ তিন লিটার ভোজ্য তেলও কেনা যায় না।

মল্লিকের কাছে ৪০ হাজার টাকা মূল্যের ৩০ ভরি স্বর্ণও রয়েছে।

বর্তমানে প্রতি ভরি (২২ ক্যারেট) সোনার দাম ১ লাখ টাকার বেশি।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনুর পূর্বাচলে ১০ কাঠার একটি প্লট রয়েছে এবং তার স্ত্রীর হলফনামা অনুসারে ৪০ ভরি সোনা রয়েছে, যার মূল্য যথাক্রমে ১৬ লাখ ১০ হাজার টাকা এবং ১২ হাজার টাকা।

ইনুর নিজের ২৫ ভরি স্বর্ণের দাম ২৫ হাজার ৫০০ টাকা।

পাবনা-৩ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য মকবুল হোসেন ২ হাজার টাকা মূল্যের ২০ বিঘা জমির মালিকানা ঘোষণা করেছেন। যে দামে বর্তমানে দুই কেজি খাশির মাংশ কেনা যায় না।

ঢাকায় কামরুল ইসলাম কীভাবে এত সস্তায় জমি ও ফ্ল্যাট কিনলেন তা যে কারোরই অনুমানের বাইরে।

সাবেক এই মন্ত্রী মিরপুরে চার কাঠা জমির মূল্য দেখিয়েছেন ৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা এবং পূর্বাচলে ১০ কাঠা জমির মূল্য ৩৯ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। ১ দশমিক ৭৫ কাঠা জমিতে তার দুটি ফ্ল্যাটের মূল্য দেখানো হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা।

'মাল্টি লেভেল প্রতারণা'

'এগুলো বহু-স্তরীয় প্রতারণা, জালিয়াতি এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের জন্য ক্ষমতার অপব্যবহারের উদাহরণ।' ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ডক্টর ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিষ্ময়করভাবে কম দাম দেখানো সম্পত্তির যেসব কাগজপত্র দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে এতে কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য অবৈধ লেনদেনও হয়ে থাকতে পারে।

তিনি আরও বলেন, 'জনগণের হতাশা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বৈধ উৎসের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবৈধ আয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে।'

এসব কিছুই কার্যত ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়মুক্তির দিকে পরিচালিত করে এবং দুর্নীতিকে আরও গভীরে বিস্তৃত করছে বলেও মনে করেন তিনি।

যোগাযোগ করা হলে ইসি সচিব জাহাংগীর আলম বলেন, 'প্রার্থীরা তাদের হলফনামায় সুপ্রিম কোর্টের আদেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কিছু তথ্য প্রকাশ করেন এবং আমরা আমাদের ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করি। আমরা শুধু তথ্যগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করছি।'

তিনি বলেন, দুদক বা এনবিআর উপযুক্ত মনে করলে ব্যবস্থা নিতে পারে।

নির্বাচন কমিশন কখনো এনবিআর বা দুদককে তদন্তের অনুরোধ করেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এটা আমাদের কাজ নয়। আমাদের কাজ হচ্ছে তথ্যগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করা।'

Comments