অবিস্মরণীয় শহীদমাতা সালেমা বেগম
পুরো মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি আপামর মুক্তিযোদ্ধাদের মা হিসেবে হাজির হয়েছিলেন। দেশমাতৃকাকে রক্ষার তাগিদে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তিনি নিজের দুই সন্তানকে দেশের তরে বিলিয়ে দিয়েছিলেন।
সন্তানদের উদ্দেশে বলেছিলেন, 'যদি তোমরা যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হও, তবে শহীদের মা হিসেবে আমি সারাজীবন গর্ববোধ করব। রণাঙ্গনে শত্রুপক্ষের গুলি যেন তোমার পিঠে না লেগে বুকে লাগে। তোমাদের মৃত্যুও যেন বীরের মতো হয়।'
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, আশরাফুন্নেছা সাফিয়া বেগমের মতোই অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিলেন শহীদ জননী সালেমা বেগম। কিন্তু দুর্ভাগ্য সালেমা বেগমের আত্মত্যাগ আমাদের সামনে উঠে আসেনি।
শুধু মুক্তিযুদ্ধই নয়, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন সালেমা বেগম। তার অনুপ্রেরণাতেই গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন তার দুই ছেলে।
গণঅভ্যুত্থানের সময় তার বড় ছেলে সেলিম কামরুল হাসান ছিলেন রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আর ছোট ছেলে আমিনুল হাসান তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী।
বাংলার প্রতিটি শহরের মতো গণঅভ্যুত্থানের হাওয়া পৌঁছে গিয়েছিল রাজশাহী নগরীতেও। গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনে যোগ দিয়ে সেলিম ও তার সঙ্গীরা পুলিশের জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল চালিয়ে গিয়েছিলেন। জবাবে লাঠিচার্জ আর গুলি।
পরদিন ছাত্রদের আগলে রাখতে গিয়ে নিজের বুক পেতে দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার ড. শামসুজ্জোহা প্রমাণ করেছিলেন শিক্ষকের মহাত্মা। শহীদ শামসুজ্জোহার কল্যাণেই সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল সেলিমসহ বহু শিক্ষার্থীর প্রাণ।
সালেমা বেগম সবসময় শহীদ শামসুজ্জোহার সেই ত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন তার সন্তানদের। শহীদ শামসুজ্জোহার আদর্শ বুকে ধারণ করতে বলতেন। গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে শহীদ শামসুজ্জোহার আত্মত্যাগ স্মরণ করতে গিয়ে তিনি বলতেন, 'জোহা সাহেব আমার সেলিমকে বাঁচাতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন। তার রক্ত বৃথা যেতে পারে না।'
মুক্তিযুদ্ধের আগেই সালেমা বেগম বুঝতে পেরেছিলেন সশস্ত্র যুদ্ধ আসন্ন। তার দুই ছেলেই শুটার হওয়ায় বাড়িতে শুটিং অনুশীলনের রাইফেল ও গুলি মজুদ ছিল। অসহযোগ আন্দোলনের সময় সালেমা বেগমের নির্দেশে তার ছেলে ও বাড়ির পাহারাদাররা মিলে বাড়ির সামনে বাংকার খনন করে রেখেছিলেন। যেন যুদ্ধ শুরু হলে তারা প্রতিরোধ গড়তে পারেন।
একাত্তরের ৫ মার্চ সালেমা বেগমের দুই সন্তান তেজগাঁওয়ের সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোরের সামনে পুলিশ সদস্যদের নিয়ে পাকিস্তানি জান্তাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সাহসিকতার প্রমাণ দিয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় ৩১ মার্চ সেলিম ও আমিনুল দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। ১৪ এপ্রিল ভৈরবের লালপুরের যুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন সালেমা বেগমের দুই সন্তানই।
পরবর্তীতে তেলিয়াপাড়ার বিখ্যাত অ্যামবুশ, হরষপুর, মুকুন্দপুর, বিলোনিয়া, আখাউড়ার যুদ্ধসহ অসংখ্য যুদ্ধে তার দুই সন্তান যে অসীম ত্যাগ ও সাহসিকতা প্রদর্শন করেছিলেন তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেই বিরল।
শহীদ জননী সালেমা বেগমের দুই সন্তানই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে প্রথম বাংলাদেশ ওয়্যারকোর্সের প্রশিক্ষণার্থী। ছোট ছেলে আমিনুল (ডা. এম এ হাসান নামে সুপরিচিত) দেশের শীর্ষ গণহত্যা গবেষকও বটে।
৭১ এর জুলাই থেকে যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দান করেছিলেন সালেমা বেগম। ২ নম্বর সেক্টরের প্রায় ১ ব্যাটালিয়ন সেনার চিকিৎসা, চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ও পোশাকের জোগান দিয়েছিলেন তিনি।
তেজগাঁওয়ের সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোর ও মেডিকেল সামগ্রির ফ্যাক্টরির শ্রমিক নেতা ও তার ৭০০ শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত করার পেছনে অসীম অবদান ছিল সালেমা বেগমের।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বিজয়ীর বেশে তার দুই সন্তান রণাঙ্গন থেকে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। এর কিছুদিনের মাথায় লেফটেন্যান্ট সেলিমকে রাষ্ট্রপতির গার্ড কমান্ডার পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। যদিও ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি লেফটেন্যান্ট সেলিমকে কোম্পানি সমেত মিরপুর মুক্তকরণের লড়াইয়ে নিয়ে যান ২য় ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর মঈনুল হাসান চৌধুরী।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গন তথা ঢাকার মিরপুরের বিহারীদের কাছ থেকে মিরপুর মুক্তকরণের যুদ্ধে শহীদ হন সেলিম কামরুল হাসান।
বড় ছেলেকে হারানোর আঘাত বিদীর্ণ করে দিয়েছিল সালেমা বেগমের বুক। ডায়েরিতে শহীদ সন্তানের কথা লিখতে গিয়ে শহীদ জননী সালেমা বেগম লিখেছেন, 'হারিয়ে গেল আমার সেলিম। এক নির্ভীক বীর। নয় মাস দেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে মরণপণ যুদ্ধ করে বিজয়ীর বেশে ফিরে এসেছিল সে। তারপর স্বাধীন বাংলার সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য শত্রুর শেষ ঘাঁটি ধ্বংস করার জন্য, নিজের সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মিরপুরে। সেই অসম যুদ্ধে হাজার হাজার অবাঙালি, পাকিস্তানি এবং রাজাকারের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে নিজের জীবন বাজি রেখে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং শাহাদাৎ বরণ করেছে। রণক্লান্ত সেলিম আজও ঘুমিয়ে আছে মিরপুরেরই বুকে। ও পিছু হটতে জানত না। সহযোদ্ধাদের জীবন বাঁচাতে নিজে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছে, সহযোদ্ধাদেরকে নিরাপদে সরে যাবার সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু স্বার্থপরের মতো নিজে বাঁচার চেষ্টা করেনি। তাইতো সেলিম সত্যিকারের বীর, এক মহান যোদ্ধা।'
ডায়েরির আরেক জায়গায় সালেমা বেগম লিখেছেন, 'মিরপুরের মাটি শত্রুমুক্ত হল সেলিমের রক্তে ভিজে। সেখানকার মাটিতে মিশে রইল ওর পবিত্র রক্তমাখা দেহ। সরকারের শেষ দায়িত্ব পালন করে, অত্যন্ত কর্তব্যের সাথেই পালন করে, মিরপুর মুক্ত করল। আর আমি এক অভাগিনী মা। গাজী সেলিমের মা থেকে শহীদ সেলিমের মা হয়ে গেলাম। কিন্তু যাকে আমি তেইশ বছর বুকের আদরে, স্নেহে, ভালবাসার বড় করেছি সে কী করে হারিয়ে যেতে পারে। সত্যিই কি সেলিম আর কোনদিন 'মা বলে আমাকে ডাকবে না' গলা জড়িয়ে ধরবে না, আমার কাপড়ের আঁচলে মুখ মুছবে না। সেই সুঠামদেহী যুবক সুন্দর মুখের স্মিত হাসি দিয়ে 'মাগো' বলবে না! ওর পায়ের ধুলো কি এই বাংলার কোনোখানে আর কোনোদিন পড়বে না' আর ভাবতে পারি না। মনে হয় সব কিছু মিথ্যে। আমি শুধুই কল্পনা করে চলেছি। কিন্তু সত্য যে বড় কঠিন। সেলিম নেই। কোথাও নেই। হাজার বার ডাকলেও সেলিম আর সাড়া দেবে না। আজ মনে হয় সেলিম তো আমার একার নয়, ও সারা বাংলার। ও আজ বাংলা মায়ের সন্তান।'
নিজের বড় ছেলে সেলিমকে প্রাণাধিক ভালোবাসতেন সালেমা বেগম। মিরপুরের শেষ যুদ্ধে ছেলেকে হারানোর পর আমৃত্যু বিছানায় না ঘুমিয়ে মাটিতে ঘুমিয়েছিলেন সালেমা বেগম।
রাজনীতিবিদ বা রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলেও আজীবনই সালেমা বেগম ছিলেন রাজনৈতিক সচেতন। পুরো দেশেই তখন মুক্তিযুদ্ধের নরঘাতক ও এ দেশীয় দালাল ও দোসরদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করা হচ্ছিল।
সালেমা বেগমের হৃদয়েও প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো। তার উদ্যোগেই তখন গঠিত হয়েছিল লেফটেন্যান্ট সেলিম মঞ্চ। এই মঞ্চ গঠনের উদ্দেশ্য ছিল বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সুনিশ্চিত করা।
তারও দুই বছর পর মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে উঠল একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও অন্যতম প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন সালেমা বেগম।
১৯৯২ সালে বরিশালে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছিল সালেমা বেগমকে। সালেমা বেগমের নেতৃত্বেই দক্ষিণাঞ্চলের গ্রামগঞ্জে স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল প্রচারণা ও গণসংযোগ। তার অনুপ্রেরণায় দক্ষিণাঞ্চলের প্রত্যন্ত জনপদেও আন্দোলন ছড়িয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, যারা অর্থনৈতিকভাবে খানিকটা ভঙ্গুর তাদের গোপনে আর্থিক সাহায্যও করেছেন শহীদ জননী সালেমা বেগম। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট ছিল তাদের প্রতিও ছিল তার কোমল দৃষ্টি। কে কীভাবে খাচ্ছে তারও দেখভাল করতেন তিনি। তার বাড়ি ছিল আন্দোলনের কর্মীদের জন্য সর্বসময়ই উন্মুক্ত। একপর্যায়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, শহীদ জননী সালেমা বেগমের উদ্যোগেই ইউরোপীয় পার্লামেন্ট যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছিল।
নব্বইয়ের দশকে যখন ঢাকার মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে মুসলিম বাজার বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হয় তখন তার ছোট ছেলে ডা. এম এ হাসান বধ্যভূমি থেকে শতশত শহীদের হাড়গোড়, খুলি এনে দেশে প্রথমবারের মতো ডিএনএ প্রোফাইলের কাজ শুরু করেন। একই বছর জল্লাদখানা বধ্যভূমিও উন্মোচিত হয়েছিল।
ডা. এম এ হাসান যখন শহীদদের ডিএনএ প্রোফাইলের কাজে নিয়োজিত ছিলেন, সালেমা বেগম তখন শহীদদের মাথার খুলি আর অস্থিতে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে নিজের জ্যেষ্ঠ সন্তান শহীদ সেলিমের কথাই স্মরণ করতেন। বলতেন, এই শহীদদের মাঝেই লুকিয়ে আছেন তার প্রিয় সেলিম। শহীদ জননী সালেমা বেগমের অনুপ্রেরণাতে পরবর্তীতে ডা. এম এ হাসানের উদ্যোগে গঠিত হলো 'ওয়্যার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংস কমিটি।'
মুক্তিযুদ্ধ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীতে শহীদ জননী সালেমা বেগমের যে অবদান, যে অবর্ণনীয় ত্যাগ স্বীকার তার স্বীকৃতিটুকুও আমরা জাতি হিসেবে দিতে পারিনি। তবে শহীদ জননী সালেমা বেগম যে আদর্শের বীজ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বপন করে গিয়েছিলেন, আদর্শের যে আলোক শিখা প্রজ্বলন করে দিয়েছিলেন তা প্রজ্বলিত থাকে যুগের পর যুগ ধরে।
৯৮তম জন্মদিবসে জাতির আলোকবর্তিকা শহীদ জননী সালেমা বেগমের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
সূত্র- অবরুদ্ধ দেশ: অনিকেত জীবন/ডা. এম এ হাসান
Comments