শহীদ জননী জাহানারা ইমাম: বাংলার হৃদয়ে জ্বেলেছেন যিনি অনির্বাণ শিখা
একটি দেশের জন্য তিনি কী করেননি! সন্তানকে বিলিয়ে দিয়েছেন মাতৃভূমির জন্য। হারিয়েছেন জীবনসঙ্গীকেও। কেবল তাই নয়, সারাজীবন বারবার প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হয়েছে তাকে। কিন্তু তিনি পাহাড়ের মতো অটল। একটিবারের জন্যও থামেননি আপন গতিপথ থেকে। এগিয়ে চলেছেন নিজে, একটি জাতিকে দিয়েছেন এগিয়ে চলার প্রেরণা।
তিনি জানতেন তার জীবনে হারানোর কিছু নেই। দিনে দিনে তিনি হয়ে উঠেছেন একটি জাতির সংগ্রামের পথিকৃৎ।
কৈশোর থেকে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠতে হয়েছিল জাহানারা ইমামকে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে এক পরিপাটি সংসার আর ঝামেলাহীন জীবন ছিল তার।
জাহানারা ইমাম তখন পুরদস্তুর গৃহিণী আর তার স্বামী শরীফ ইমাম 'দ্য ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের' প্রকৌশলী। ২ সন্তান নিয়ে তাদের সুখের সংসার। চাইলেই মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামী জীবন থেকে নিজেদের আড়াল করতে পারতেন জাহানারা ইমাম। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পাড়ি জমাতে পারতেন জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে। চাইলেই সেখানে গোটা মুক্তিযুদ্ধের সময় কাটিয়ে দিতে পারতেন, নিরাপদে থাকত তার গোটা পরিবার। কিন্তু তিনি চেয়েছেন স্বদেশের মুক্তি।
তার মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি 'একাত্তরের দিনগুলি' লেখার সূচনা হয়েছিল ১৯৭১ এর উত্তাল ১ মার্চে। এদিনই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের স্থগিত ঘোষণা দিয়েছিলেন। দূরদর্শী জাহানারা ইমাম বুঝতে পেরেছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় ঘনিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের জন্ম কেবলই সময়ের অপেক্ষা।
জাহানারা ইমামের সন্তান ছিলেন শাফী ইমাম রুমী, মুহূর্তের জন্যও তিনি যাকে ছেড়ে থাকতে পারতেন না। রাজনীতি সচেতন রুমী যখন একাত্তরের মার্চে বিভিন্ন সভা সমিতিতে যোগদান করতে লাগলেন, মা জাহানারা ইমাম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলেও বাধা দেননি।
একাত্তরের ১৭ মার্চে লেখা জাহানারা ইমামের দিনলিপিতেই সেই চিত্র প্রমাণিত হয়। জাহানারা ইমামের জনৈক গণক আত্মীয় রুমীকে সাবধানে রাখার পরামর্শ দিলে জাহানারা ইমাম জবাবে বলেছিলেন, 'ওইসব সাবধানে রাখার কথা বাদ দিন। আমার কপালে পুত্রশোক আছে কি না, তাই বলুন? ওটা থাকলে লখিন্দরের লোহার ঘর বানিয়েও লাভ নেই।'
মুক্তিযুদ্ধে তার এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ি 'কণিকা' হয়ে উঠল মুক্তিযোদ্ধাদের পরম আশ্রয়স্থল। শরীফ ইমাম এবং তার বন্ধু সাজেদুর রহমান খান টাকা সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠাতেন। জুন মাসের শেষের দিকে ২ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের লেখা একটি চিঠি নিয়ে জাহানারা ইমামদের বাড়িতে এসেছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা শাহাদাত চৌধুরী ও হাবিবুল আলম।
খালেদ মোশাররফের এই চিঠিটি পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচলের যেন বিপর্যয় ঘটানো যায়। সেজন্য খালেদ মোশাররফ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বেশ কিছু ব্রিজ ও কালভার্ট বিস্ফোরকের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেওয়ার। শরীফ ইমাম এক সময় সরকারি প্রকৌশলী ছিলেন। ব্রিজের ঠিক কোন কোন পয়েন্টে বিস্ফোরণ ঘটালে ব্রিজ ভাঙবে অথচ কম ক্ষতি হবে অর্থাৎ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সহজে মেরামত করা যাবে, তিনি সেভাবে বিস্তারিত তথ্য দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের।
ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধারা জানতেন, জাহানারা ইমামের বাড়ি কণিকাতে গেলেই ভালোমন্দ কিছু হলেও খাওয়া জুটবে। পাওয়া যাবে আশ্রয়। তাই মুক্তিযোদ্ধারা এই বাড়িতে লুকিয়ে আশ্রয় নিতেন।
মুক্তিযুদ্ধের ২৯ আগস্ট রুমীকে হারানোর রাত বা পরের দিনও একটিবারের জন্য দিনলিপি লেখা থামাননি জাহানারা ইমাম। একাত্তরের দিনগুলির প্রতিটি পাতায় ইতিহাসের এক অনন্য সাক্ষী হয়ে তিনি তুলে ধরেছেন অসীম আত্মত্যাগের এক অবিশ্বাস্য ইতিহাসের কথা।
জাহানারা ইমামের এই অবিশ্বাস্য প্রাণশক্তির রসদ কী ছিলো জানা নেই। হয়তো তিনি জানতেন তার হারানোর কিছু নেই। কেবলই আছে দেশকে দেওয়ার। পঁচাত্তরের পরবর্তী প্রেক্ষাপটে তিনি দেখেছিলেন একটি দেশ সমূলে খাদের কিনারায় দুলছে। একটি দেশ থেকে তার জন্মযুদ্ধকে মুছে দেওয়ার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। সেই বিভ্রান্ত জাতিকেই তিনি দেখালেন আলোর পথ।
জীবনে কখনোই রাজনীতিবিদ ছিলেন না শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। যদিও ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময় অভিনয়শিল্পী গোলাম মুস্তাফার স্ত্রী হোসনে আরার অনুরোধে নির্বাচনী প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু স্বামী শরীফ ইমামের আপত্তিতে নির্বাচনে দাঁড়াননি পরে। এ ছাড়া তিনি তখন ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। নির্বাচনে দাঁড়াতে হলে তাকে সরকারি চাকরিটি বাদ দিতে হতো।
রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলেও তিনি ছিলেন রাজনীতি সচেতন। দেশে তখন মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক ও এদেশীয় দালাল ও দোসরদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করা হচ্ছে। হৃদয়ে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হলো শহীদ জননীর।
ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং শারীরিক অবস্থা ভঙ্গুর হওয়া সত্ত্বেও স্বদেশের জন্মশত্রু, স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে তিনি গড়ে তুললেন দুর্বার আন্দোলন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তিনি এগিয়ে এলেন। তার নেতৃত্বেই ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি গড়ে উঠল একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ার পরও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিটি বৈঠকেই উপস্থিত থাকতেন তিনি। একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। আন্দোলন চালাতে গিয়ে নিজের উপার্জনের প্রায় সবই বিলিয়ে দিয়েছিলেন কর্মীদের জন্য। এরই ধারাবাহিকতায় আন্দোলনকে বেগবান করতে দেশব্যাপী গণস্বাক্ষর অভিযান চলল।
হলো মিছিল, মিটিং ধর্মঘট, মানববন্ধন, মহাসমাবেশ। একইসঙ্গে চলল সংসদের দিকে যাত্রা। কেবল দেশেই নয় তার তৎপরতা ও আকুল প্রচেষ্টায় বিদেশের মাটিতেও গঠিত হলো ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। অসুস্থ শরীরে জেলায় জেলায় ছুটে গিয়ে আন্দোলন ত্বরান্বিত করেছিলেন জাহানারা ইমাম। কেবল তাই নয়, যারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল তাদের গোপনে আর্থিক সাহায্যও করেছেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট ছিল তাদের প্রতিও ছিল শহীদ জননীর কোমল দৃষ্টি।
কে কীভাবে খাচ্ছে তারও দেখভাল করতেন তিনি। তার বাড়ি ছিল আন্দোলনের কর্মীদের জন্য উন্মুক্ত। এক পর্যায়ে তারই পদক্ষেপে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে সমর্থন দেয়।
আজকে যে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে তার প্রধান কারিগর একজন জাহানারা ইমাম। তিনি যখন আন্দোলন শুরু করেছিলেন তখন সমস্ত পরিস্থিতি ছিল প্রতিকূলে। সেই অবস্থার মধ্যেই তার দৃঢ়তায় ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গোলাম আযমের ঐতিহাসিক বিচার অনুষ্ঠিত হয়। উত্থাপিত হলো তার বিরুদ্ধে ১০টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ।
১২ জন বিচারক সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করলেন। গণ আদালতের রায় কার্যকরের দাবি জানালেন সরকারের কাছে।
আজকের দিনে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রায় স্বাভাবিক মনে হলেও, তখনকার বাস্তবতার হিসেব-নিকেশে আর প্রেক্ষাপটে তা ছিলো অকল্পনীয়। যার ফলাফল হিসেবে জাহানারা ইমামসহ ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে করা হয়েছিল অ-জামিনযোগ্য মামলা। ১৯৯৩ সালের ২৮ মার্চ নির্মূল কমিটির সমাবেশের পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন জাহানারা ইমাম। তাকে ভর্তি হতে হয়েছিল পিজি হাসপাতালে। কিন্তু তিনি জীবনের পরোয়া করেননি।
গণআদালতের রায় কার্যকর করার দাবিতে স্মারকলিপি নিয়ে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রীর কাছে। তারই অক্লান্ত চেষ্টায় ১০০ জন সংসদ সদস্য গণআদালতের রায়ের পক্ষে সমর্থন ঘোষণা করেছিলেন।
হাসপাতালে বেডে শুয়েও গুরুতর অসুস্থ শহীদ জননী নিয়মিত খোঁজখবর নিয়েছেন আন্দোলনের। মৃত্যুর আগে লিখে গিয়েছিলেন,
'মরণব্যাধি ক্যান্সার আমাকে শেষ মরণ কামড় দিয়েছে। আমি আমার অঙ্গীকার রেখেছি। রাজপথ ছেড়ে যাইনি। মৃত্যুর পথে বাধা দেবার ক্ষমতা কারো নেই। তাই আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। আপনারা আপনাদের অঙ্গীকার ও ওয়াদা পূরণ করবেন। আন্দোলনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে থাকবেন। আমি না থাকলেও আপনারা, আমার সন্তান-সন্ততিরা আপনাদের উত্তরসূরিরা সোনার বাংলায় থাকবে।'
কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার 'সকল কাঁটা ধন্য করে' গ্রন্থের 'তিনি' পরিচ্ছেদে শহীদ জননীর প্রয়াণের পর লিখেছিলেন,
'বাংলার পবিত্র মাটিতে তার পায়ের চিহ্ন আর পড়বে না। স্বাধীনতাবিরোধীদের এই সংবাদে উল্লসিত হবার কিছু নেই। বাংলার হৃদয়ে তিনি জ্বেলে দিয়েছেন অনির্বাণ শিখা। ঝড়-ঝাপ্টা যত প্রচণ্ডই হোক না কেন সেই শিখা জ্বলতে থাকবে। কী সৌভাগ্য আমাদের, তিনি জন্মেছিলেন এই দেশে।'
জাহানারা ইমামের ছড়িয়ে দেওয়া সেই আলোকশিখা প্রজ্বালিত থাকবে হাজার বছর। ৯৪তম জন্মদিবসে জাতির আলোকবর্তিকা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
তথ্যসূত্র:
জীবনের পথ দিনের প্রান্তে/ জাহানারা ইমামের সাক্ষাৎকার/ সরদার ফজলুল করিম।
একাত্তরের দিনগুলি/ জাহানারা ইমাম
অন্য জীবন/ জাহানারা ইমাম
গণআদালত ও জাহানারা ইমাম/ শাহরিয়ার কবির
একাত্তরের দিনগুলি ও শহীদ জননী জাহানারা ইমাম/ সম্পাদনা মোহাম্মদ শাকেরউল্লাহ
সকল কাঁটা ধন্য করে/ হুমায়ূন আহমেদ।
Comments