‘বেতন বাড়ান, না হয় খাদ্যের দাম কমান’

নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে সাধারণ মানুষ যখন ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত, তখন এই সংকটের সমাধান করতে না পারলেও মানুষের অভাববোধ কিংবা বাজারদর নিয়ে তার ক্ষোভকে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখাই ভালো। কেননা আজ যিনি জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির পক্ষে ওকালতি করছেন, সরকার পরিবর্তন হয়ে গেলে তিনিই নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করবেন।

বেতন বাড়ানোর দাবিতে রাজপথে আন্দোলন চলাকালে গত ১ নভেম্বর রাজধানীর মিরপুর এলাকায় একজন পোশাক শ্রমিক সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, 'যদি বেতন বাড়াতে সমস্যা হয় তাহলে নিত্যপণ্যের দাম কমানো হোক। বাসা ভাড়া কমানো হোক। আমরা যে টাকা বেতন পাই তা দিয়ে যেন সারা মাস চলতে পারি, সেই ব্যবস্থা করা হোক।'

এ সময় আরেকজন শ্রমিক বলেন, 'আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত না। আমরা আমাদের বেতন বৃদ্ধির জন্য শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করে যাচ্ছি। অথচ ক্ষমতাসীন দলের লোকজনদের দিয়ে আমাদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। গার্মেন্টসকর্মীর জীবনকে এত সস্তা করে দেখা উচিত না।' (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ১ নভেম্বর ২০২৩)

এর পরদিন দ্য ডেইলি স্টার বাংলার আরেকটি খবরের শিরোনাম 'বেতনের তুলনায় খরচ অনেক বেশি'। খবরে একজন পোশাক শ্রমিকের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা হয়েছে, 'আমি প্রায় ১৬ বছর ধরে কাজ করতেছি। এখন আমি বেতন পাই সাড়ে ১৩ হাজার টাকা। এই টাকায় এখন কোনোভাবেই সংসার চালাতে পারতেছি না। বেতনের তুলনায় খরচ অনেক বেশি। বাসা ভাড়া দেওয়ার পর খাওয়ার টাকা ঠিক মতো থাকে না।'

যখনই নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে সাধারণ মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করে; গণমাধ্যমে সংবাদ ও বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়; সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রল হয়—তখন সরকার এবং সরকারি দলের তরফে একই বক্তব্য আসে, দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ও ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ গত বছরের মার্চে রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, 'বাংলাদেশে গত ১৩ বছরে মানুষের মাথাপিছু আয় ৬০০ ডলার থেকে ২ হাজার ৬০০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। প্রতিটি মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়েছে।' (প্রথম আলো, ৬ মার্চ ২০২২)

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম গত বছরের ৯ জানুয়ারি রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, 'গত একযুগে আমাদের গড় আয় ম্যাজিকের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে...।' কিন্তু মাথাপিছু আয় বাড়লেও নিত্যপণ্যের দামও যে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এবং এর ফলে ওই মাথাপিছু আয়ের নিচে যে স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষের দীর্ঘশ্বাস চাপা পড়ছে—মন্ত্রী সে কথা বলেননি।

প্রশ্ন হলো, আয় বেড়েছে কতজনের এবং ক্রয়ক্ষমতা তিন গুণ বেড়েছে কাদের? দেশের প্রধান রপ্তানিপণ্য তৈরি পোশাক কারখানায় একজন শ্রমিক ১৬ বছর কাজ করার পরেও তার বেতন সাড়ে ১৩ হাজার টাকা।

এক বছরে দেশজ উৎপাদন থেকে যে আয় হয়, তার সঙ্গে রেমিট্যান্স যোগ করে জাতীয় আয় বের করা হয়। সেই জাতীয় আয়কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে গড় মাথাপিছু আয় বের করা হয়। যদিও এভাবে মাথাপিছু আয়ের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় কি না, সেটি বরাবরই একটি বিতর্কের বিষয়। কেননা এখনও বাংলাদেশে গরিব মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি এবং এখানে একদিকে ধনী-গরিবের বৈষম্য যেমন প্রকট, তেমনি অবৈধ উপায়ে টাকা কামিয়ে পাচার করে দেওয়ার সুযোগ অনেক। ফলে যারা এভাবে অবৈধ পথে বিপুল টাকা-পয়সা কামিয়ে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছেন, তাদের মাথাপিছু আয়ের সঙ্গে সাড়ে ১৩ হাজার টাকা বেতন পাওয়া পোশাক শ্রমিকের মাথাপিছু আয় মেলানোর কোনো সুযোগ নেই।

যে শ্রমিক ঢাকা শহরে চাকরি করে সাড়ে ১৩ হাজার টাকা বেতন পান, তার ঘর ভাড়া কত? বাজার খরচ কত? বাড়িতে যদি বাবা-মা থাকেন এবং তাদেরকে যদি টাকা পাঠাতে হয়, তাহলে তিনি কত টাকা পাঠাতে পারবেন? বস্তিতে থাকলেও কি ১৩ হাজার টাকা দিয়ে এই সময়ে একটা সংসার চলে? ওভারটাইম করেই বা কত টাকা বাড়তি আয় করা সম্ভব?

যে পোশাকের গায়ে চড়ে 'মেইড ইন বাংলাদেশ' লেখা স্টিকার ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে ঘুরে বেড়ায় এবং বাংলাদেশের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে—সেই মেইড ইন বাংলাদেশের কারিগররা বাজারে গিয়ে এক কেজি চাল, এক কেজি আলু, একটি ছোট পাঙাস মাছ, একটু তেল-নুন-পেঁয়াজ কিনতে গিয়ে গলদঘর্ম হয়। বিরক্ত হয়। লোহার শিকে ঝুলিয়ে রাখা গরু ও খাসির বড় বড় রানের পাশ দিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে হেঁটে যায়। ভাবে, আগামী কোরবানিতে প্রতিবেশী ও সচ্ছল আত্মীয়দের বাড়ি থেকে কিছু মাংস পাবেন। কিন্তু সপ্তাহে অন্তত একদিন তো মাংস খেতে মন চায়। ভরসা ব্রয়লার মুরগি। একটু আমিষ দরকার। এক হালি ডিম। কিন্তু পকেটে হয়তো আছে পাঁচশো টাকা।

এই বাস্তবতা শুধু পোশাক শ্রমিকের নয়। স্বল্প আয়ের প্রতিটি মানুষের বাজার করার গল্পটা একইরকম। প্রত্যেকের দীর্ঘশ্বাসের রঙ অভিন্ন। প্রত্যেকের চোখের জলের রঙ এক। প্রত্যেকের না পাওয়ার বেদনা সমান।

কিন্তু রাষ্ট্র কী করবে? তারও তো সীমাবদ্ধতা অনেক। প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দেশের অর্থনীতি এখনও খুব শক্তিশালী নয়। বেকারের সংখ্যাও অনেক। তারমধ্যে আছে লাগামহীন দুর্নীতি, অনিয়ম, সুশাসনের ঘাটতি। জাতীয় নির্বাচনের আগ মুহূর্তে তৈরি হয় রাজনৈতিক সংকট, সংঘাত—যার সরাসরি প্রভাব পড়ে নিত্যপণ্যের বাজারে। অসাধু ব্যবসায়ীরা সব সময়ই দাম বাড়ানোর অজুহাত খোঁজেন। খেয়াল-খুশিমতো জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেন। প্রত্যেকের উত্তর অভিন্ন—তা হলো, বেশি দামে কিনেছি, তাই বেশি দামে বেচি। কিন্তু উৎপাদনের পর্যায় থেকে পাড়া-মহল্লার বাজারে খুচরা ক্রেতার কাছে আসতে আসতে ২০ টাকার সবজি কী করে ৮০ টাকা বা ১০০ টাকা হয়ে যায়, সেটি অর্থনীতির কোনো সাধারণ সূত্রে মেলে না।

তার মানে এখানে বিরাট শুভংকরের ফাঁকি। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে এই ফাঁক বন্ধ করা। কিন্তু দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়ে যেসব বক্তব্য দেন—তা অসাধু ব্যবসায়ীদের আরও বেশি উৎসাহ দেয়। যে মশার কয়েলের দাম ছয় মাস আগেও ছিল ৭০ টাকা, চোখের পলকে সেটি কীভাবে ১২০ টাকা হয়ে গেলো, তার কোনো সদুত্তর নেই। বাজারে পেঁয়াজ ও সবজির পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকার পরেও যে এগুলোর দাম ধেই ধেই করে বেড়ে যায়, সেটি নিয়ন্ত্রণ করবে কে? রাষ্ট্রের কাজ কী? সরকারের এত মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তর, পরিদপ্তরের কাজ কী? সবারই খুব সাধারণ অজুহাত—লোকবল সংকট।

যে পোশাক শ্রমিক বলেছেন হয় বেতন বাড়ান না হয় জিনিসপত্রের দাম কমান—এই দুটি ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের ভূমিকা প্রধান। সরকার শুধু সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়াতে ভূমিকা রাখে তা নয়, বরং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন বাড়াতেও ভূমিকা রাখতে পারে। শিল্প-কারখানা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের কাছ থেকে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পায়। প্রণোদনা পায়। সুতরাং সেইসব সুযোগ-সুবিধা ও প্রণোদনা আরও বাড়িয়ে কিংবা চাপ প্রয়োগ করে কর্মীদের বেতন ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা বাড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সরকার বাধ্য করতে পারে।

কিন্তু বেতন ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা বাড়িয়েও কোনো ফল পাওয়া যাবে না যদি বাজার নিয়ন্ত্রণে না থাকে। ১০ টাকা বেতন বাড়বে, খরচ বাড়বে ১৫ টাকা, তাতে শেষমেষ ৫ টাকা ঋণ। মাথাপিছু আয় বাড়লো কিন্তু জীবনযাপনের খরচ বেড়ে গেলো তারচেয়ে বেশি, তাতে ওই মাথাপিছু আয় অর্থহীন। উন্নয়ন হলো কিন্তু তার সুফল ভোগ করলেন প্রকল্পের পিডি, ইঞ্জিনিয়ার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, এমপি, দলীয় লোক, ঠিকাদার, নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসায়ী। তাহলে ওই উন্নয়ন দিয়ে দেশের লাভটা কী? সরকারের পরিসংখ্যানে মাথাপিছু আয় তিন গুণ বাড়লো, অথচ জীবনমান আগের চেয়ে খারাপ হলো—তাহলে ওই মাথাপিছু আয় দিয়ে কী হবে? ফলে রাষ্ট্রকে একইসঙ্গে মানুষের আয় বাড়ানো এবং জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ—দুটি কাজ একসঙ্গে করতে হয়।

সমাজের সচ্ছল ও ধনী মানুষদের নিয়ে রাষ্ট্রকে খুব বেশি চিন্তা না করলেও চলে। যার পয়সা আছে আলুর কেজি দুইশো টাকা হলেও তার অসুবিধা নেই। কিন্তু আলুর কেজি ২০ টাকা থেকে ৪০ টাকা হয়ে গেলে অসুবিধায় পড়া লোকের সংখ্যাই বেশি।

সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লোকেরা বেতনের বাইরেও নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা পান। রেশন তথা কম দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পান। তাদের মধ্যে অনেকে রেশনে পাওয়া এইসব জিনিস বিক্রিও করে দেন। কিন্তু এই সংখ্যাটি পুরো জনগোষ্ঠীর তুলনায় অতি সামান্য। এর বাইরে এখনও বিপুল জনগোষ্ঠীর অবস্থা সেই লোকের মতো যার প্যান্টের ছিদ্র ঢাকতে গেলে জামার ছিদ্র বেরিয়ে যায়। অর্থাৎ বাসা ভাড়া দেওয়ার পরে পরিবার-পরিজন নিয়ে তিন বেলা খেতে গিয়েই সব টাকা শেষ। যাতায়াত, চিকিৎসা, সন্তানের পড়ালেখা, পোশাক, প্রসাধনীর কোনটা বাদ দেবেন? এইসব লোককে নিয়েও রাষ্ট্রকে ভাবতে হয়।

সমাজের প্রান্তিক মানুষের জন্য সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আছে। নানারকমের ভাতার ব্যবস্থা আছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া অন্যদের ভাতার পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এটি মন্দের ভালো। সেইসঙ্গে আছে খোলা বাজারে নিত্যপণ্য বিক্রির কার্যক্রম। কিন্তু চাহিদার তুলনায় খোলা বাজারে বা ট্রাকে টিসিবির পণ্য বিক্রির কার্যক্রমের ব্যাপ্তি ছোট। প্রতিদিন যে পরিমাণ পণ্যের চাহিদা, সেই পরিমাণ সরবরাহ নেই। যে কারণে অনেককে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রাকের পেছনে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।

মুশকিল হচ্ছে, কোনো কিছুর দাম বেড়ে গেলে সেটি না খাওয়া কিংবা বিকল্প কিছু খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া অথবা ইনিয়ে-বিনিয়ে জিনিসের দাম বৃদ্ধির পক্ষে ওকালতি করা এবং এই ইস্যুতে কথা বললে তাকে 'সরকারবিরোধী' বা 'উন্নয়নবিরোধী' হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা সংকটকে আরও ঘনীভূত করে। অসাধু ব্যবসায়ীদের উৎসাহ জোগায়।

অতএব নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে সাধারণ মানুষ যখন ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত, তখন এই সংকটের সমাধান করতে না পারলেও মানুষের অভাববোধ কিংবা বাজারদর নিয়ে তার ক্ষোভকে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখাই ভালো। কেননা আজ যিনি জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির পক্ষে ওকালতি করছেন, সরকার পরিবর্তন হয়ে গেলে তিনিই নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করবেন। তাছাড়া মানুষের জীবনের সঙ্গে যুক্ত বিষয়গুলোকে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে রাখা গেলে সংকট সমাধানের পথ সহজ হয়।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Was with the student movement till the end: ZI Khan Panna

Noted SC lawyer was recently sued in case filed over shooting youth during the movement

1h ago