ইউরোপীয় সক্ষমতার ৪ কোটি, ২৫০ গ্রাম মাংস বা একটি ইলিশ কেনার সামর্থ্য নেই কয় কোটির?
বাজারটিতে প্রতিদিন দুটি গরুর মাংস বিক্রি হতো। গত এক বছর ধরে দৈনিক মাংস বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। সেটা প্রথমে সপ্তাহে দুদিন একটি করে আর এখন সপ্তাহে একদিন একটি গরুর মাংস বিক্রিতে নেমে এসেছে। বিক্রেতারা বলছেন, এই একটি গরুর মাংস বিক্রি করতেও সারা দিন কেটে যায়, ক্রেতা নেই।
নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে, খাদ্য তালিকা থেকে অনেকেই মাংস ছেঁটে ফেলছেন। ফলে, বাজারে মাংসের দোকানগুলো খালি পড়ে থাকছে।
গত ২৩ অক্টোবর সংবাদটি প্রকাশ করেছে দ্য ডেইলি স্টার বাংলা। সেখানে উঠে এসেছে গাজীপুরের সবচেয়ে বড় পশুর হাট আমরাইদ বাজার ও শ্রীপুরের লোহাই বাজারের চিত্র।
এটা কি খুব বিচ্ছিন্ন কোনো চিত্র? না সারাদেশের চিত্র এমনই?
সাধারণ মানুষকে বিবেচনার বাইরে রেখে ব্যবসায়ী বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির মতো করে দেখলে, ভিন্ন ব্যাখ্যা সম্ভব। বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, '১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে চার কোটি মানুষ আছে যাদের ক্রয় ক্ষমতা ইউরোপের মানুষের সমান। এই চার কোটি মানুষ দাম দিয়ে ভালো জিনিসপত্র কিনতে পারে।'
চার কোটি মানুষ অনেক বড় সংখ্যা। এর মধ্যে বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেও আছেন। বাকি ১৩ কোটি আরও বড় সংখ্যা। কথা ছিল, বাণিজ্যমন্ত্রীরা বা সরকার এই ১৩ কোটি মানুষের কথাও ভাববেন।
বাণিজ্যমন্ত্রী যে তা ভাবেননি, তা নয়।
তিনি সম্প্রতি পরিষ্কার করে মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন, 'খাদ্যপণ্যের দাম আপাতত কমার কোনো সুযোগ নেই, আগামী বছরের শুরুতেই সংকট কাটিয়ে নিত্যপণ্যের বাজার স্বাভাবিক হবে।'
এখন দাম কমছে না এবং আগামী বছরের শুরুতে দাম কমবে—বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের কোন অংশটি সঠিক? নিশ্চিত করেই বলা যায়, 'দাম কমছে না' এটা সঠিক। কিন্তু বক্তব্যটি অসম্পূর্ণ, সঙ্গে যোগ করতে হবে 'দাম আরও বাড়বে'। আগামী জানুয়ারিতে 'দাম কমবে' আশাবাদের এই কথাটি কি ঠিক হবে না? না, দেশের প্রচলিত বাস্তবতা তা বলে না।
তাহলে বাণিজ্যমন্ত্রী একথা বললেন কেন? ব্যবসায়ী বাণিজ্যমন্ত্রী রাজনীতিতে এসে একথা বুঝে গেছেন যে, এসব কথা বলার জন্যে কখনও জবাবদিহি করতে হয় না। তার এই আশাবাদ শোনানোর আরও একটি কারণ, তিনি একবারে কয়েক মাসের জন্যে হাত-মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে থাকলেন। প্রতিদিন জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, তাতে বাণিজ্যমন্ত্রীকে বিচলিত হতে হবে না। তিনি আরাম কেদারায় বসে বলতে পারবেন, আমি তো আগেই বলে দিয়েছি 'দাম কমবে না'। জানুয়ারিতে গিয়ে নতুন ব্যাখ্যা দেওয়ার বহু সুযোগ বাণিজ্যমন্ত্রীর সামনে থাকবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তো থাকবেই, এখনকার ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধসহ আরও কতকিছুর দোহাই দেওয়া যাবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, জিনিসপত্রের দাম না কমলে এবং প্রতিনিয়ত বাড়লে বাণিজ্যমন্ত্রীসহ চার কোটি মানুষের কোনো সমস্যা হবে না, বুঝলাম। বাকি ১৩ কোটি মানুষের কী হবে?
আমাদের অর্থমন্ত্রী তো বাণিজ্যমন্ত্রীর চেয়ে আরও এক কাঠি সরেস। দেশের অর্থনীতির অবস্থা এত ভালো যে, 'আর কত ভালো হবে অর্থনীতি' এই প্রশ্ন করে বিরক্তিও প্রকাশ করেছেন কয়েক মাস আগে।' পৃথিবীর সেরা অর্থমন্ত্রীর খেতাব পাওয়া অর্থমন্ত্রী বিশ্বাসই করেন না যে দেশের অর্থনীতির অবস্থা খারাপ। তিনি এও বিশ্বাস করেন না যে, দেশে দরিদ্র মানুষ আছে বা সেই সংখ্যা বেড়েছে। তিনি সপ্তাহে দুদিনের বেশি অফিসে আসারও প্রয়োজন মনে করেন না।
করোনার আগে দেশের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল দুই থেকে আড়াই কোটি। সরকারি হিসেবেও এ সংখ্যা অস্বীকার করা হয় না। করোনা মহামারির পরে আরও অন্তত আড়াই কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি সংগঠনগুলোর একাধিক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। তার মানে দেশে এখন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অন্তত পাঁচ কোটি। এদের ক্ষুদ্র একটি অংশের জন্যে সরকার ন্যায্যমূল্যে পণ্য দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। বাকিরা কী করছেন, কীভাবে বেঁচে আছেন?
ঠিক দরিদ্র নয়, তার একটু উপরে যাদের অবস্থান সেই নিম্নমধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের প্রকৃত সংখ্যা কত, তা যেমন অজানা। তাদের দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণাও অজানা, বিশেষ করে মধ্যবিত্তের। তারা দিনমজুরের কাজও করতে পারে না, দাঁড়াতে পারে না টিসিবির ট্রাকের লাইনেও। যদিও মুখ ঢেকে তাদের অনেককে এখন লাইনে দাঁড়াতে দেখা যায়। এটা যে কতটা মানসিক যন্ত্রণার তা বাণিজ্যমন্ত্রী-অর্থমন্ত্রী কোনোদিন বুঝবেন না।
বাজারে নির্দিষ্ট একটি পণ্যের দাম আকস্মিকভাবে বেড়ে গেলে সরকার সংশ্লিষ্ট একটি শ্রেণি বলতে শুরু করেন, এটা না খেলে কী হয়? হ্যাঁ, একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পণ্য না কিনলে বা না খেলে হয়ত চলে। কিন্তু সাধারণত দাম তো নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে বাড়ে না। বেড়ে যাওয়াটাই তো স্বাভাবিক হয়ে যায়। ডিমের দাম বেড়ে গেল। এমন বহু রকমের আলোচনার পর বাণিজ্যমন্ত্রী একটি ডিমের দাম নির্ধারণ করে দিলেন ১২ টাকা। কয়েক কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দিলেন। দিন-মাস পেরোলো, একটি ডিমও দেশে আসল না। দাম কমা তো দূরের কথা, ১২ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩-১৪ বা ১৫ টাকায়।
মানুষ এখন আড়াইশ গ্রাম মাংস কেনে, একটি ইলিশ মাছ কেটে পিস হিসেবে বিক্রি হয়—যা গণমাধ্যমে সংবাদের মর্যাদা পেয়েছে। বিষয়টি এভাবে হয়ত ভাবা যায় যে, যার যতটুকু দরকার ততটুকু কিনলে অপচয় হবে না। আসলে এর নেপথ্যে যে নির্মম বাস্তবতা লুকিয়ে আছে, তা আমাদের ক্ষমতাসীনরা দেখতে চান না। যে মানুষটির আস্ত ইলিশ মাছ কেনার সাধ্য ছিল, তিনি এখন ভাগে ইলিশের দু-তিনটি পিস কিনছেন। যে মানুষটি এক বা দুই কেজি গরুর মাংস কিনতেন, তিনি এখন কিনছেন আড়াইশ গ্রাম। দাম বেড়েছে আয় বাড়েনি, তিনি সামর্থ্য হারিয়েছেন। যে কারণে আজ মাংসের দোকানগুলো খালি পড়ে থাকছে।
এই নির্মম বাস্তবতা আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র স্বীকার করতে চাইছে না। বরং তারা যা করছে, সেটা জনমানুষের সঙ্গে এক ধরনের নিষ্ঠুরতা।
ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ায় তা সেদ্ধ করে সংরক্ষণ করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী, সেদ্ধ করে কোথায় রাখবে, সেটা ফ্রিজে কতদিন রাখা যায়—এসব প্রশ্ন না তুলেও বলা যায়, এটি আসলে ঠিক কোন ধরনের সমাধান?
কাঁচা মরিচ শুকনা করে গুড়া করে রাখতে হবে, পেঁয়াজ ভেজে বয়ামে রাখতে হবে, আর বলে দেওয়া হবে 'দাম কমবে না'।
নিত্যপণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে এসব কথা কি সাধারণ মানুষের প্রতি সহানুভূতির প্রকাশ, না এক ধরনের তামাশা, মানুষ তা বুঝতে পারে না।
বাজারে প্রতিটি সবজির দাম বেশি। ৮০ টাকা কেজির নিচে প্রায় কোনো সবজি নেই বললেই চলে। সরকার বেশকিছু পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল। পেঁয়াজ ৬৪-৬৫ টাকা কেজি, আলু ৩৫-৩৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি করার কথা। অথচ, পেঁয়াজ ৯০-১০০ টাকা, আলু ৪৫-৫৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। দাম নির্ধারণ করে দিলেও একদিনের জন্যও তা কার্যকর করতে পারেনি সরকার।
প্রশ্ন আসে, দাম নির্ধারণ করা হলো কোন যুক্তিতে? নির্ধারিত দাম কার্যকরই বা করা গেল না কেন? কোনো জবাবদিহি তো নেই-ই, কেমন দ্বিধাহীনভাবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলে দিতে পারলেন, দাম এখন কমবে না।
একদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির যাঁতাকলে মানুষ পিষ্ট, অপর দিকে রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্তরা তাদের কথায় মানুষের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলছেন। অথচ এই মানুষগুলোর দায়িত্ব ছিল সাধারণ মানুষের জীবনকে সহনীয় রাখার।
mortoza@thedailystar.net
Comments