ব্যবস্থা নিতে দেরি করলে অর্থনৈতিক সংকট আরও বাড়বে

উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, বাংলদেশ ব্যাংক,
অলঙ্করণ: বিপ্লব চক্রবর্তী

গত ১৮ মাসে উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমাতে ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারেনি বাংলাদেশ। বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে অর্থনীতির এই দুই প্রধান সূচক।

যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে, সেগুলো সময়ের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে এবং প্রত্যাশিত ফল বয়ে আনতে পারেনি।

জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত নীতিনির্ধারক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর কোন নতুন পদক্ষেপ নিবে না। কারণ, এই সময়ের মধ্যে কোনো ব্যবস্থার কারণে দেশের অর্থনীতিতে স্বল্পমেয়াদী চাপ সৃষ্টি করতে পারে এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে চায় না তারা।

কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকার উদ্যোগ নিতে নির্বাচনের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করলে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। তারা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করা দেশের জন্য আরও সংকট ডেকে আনতে পারে।

কারণ, ইতোমধ্যে বৈশ্বিক নানা কারণে দেশের অর্থনীতি চাপের মধ্যে আছে। যেমন- রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যের উচ্চমূল্য ও বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমেছে।

অর্থনীতিবিদরা রিজার্ভ ধরে রাখতে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ ইতোমধ্যে দেশের রিজার্ভ কমতে কমতে ২০২১ সালের আগস্টের চেয়ে অর্ধেকে নেমে এসেছে।

সম্প্রতি আইএমএফের একটি মিশন ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের পর্যালোচনা করতে বাংলাদেশ সফর করেছে। তারা ১৬ দিনের পর্যালোচনা শেষ করে গত বৃহস্পতিবার বলেছে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে রাজস্ব নীতি ও নমনীয় বিনিময় হারের মতো আর্থিক নীতিমালা প্রয়োজন।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, 'কে সরকারে আসবে, কে আসবে না, সেটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। অর্থনীতি যেন সঠিকভাবে এগিয়ে যায় ও মানুষের উপর চাপ না বাড়ে তা প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে।'

আইএমএফের একটি নথি অনুযায়ী, ২০২১ সালের আগস্টে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল প্রায় ৪০ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষে যা দাঁড়ায় ৩৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বুধবার তা দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলারে।

বিশ্বব্যাংক বলেছে, পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ও বৈশ্বিক মুদ্রানীতি কঠোর করায় ক্রমাগত পেমেন্ট ভারসাম্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর প্রভাব ফেলছে।

বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক না করার ফলেও দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার দর প্রায় ২৮ শতাংশ কমেছে, এতে আমদানি ব্যয় বাড়লেও এখনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

জাহিদ হোসেন বলেন, 'তিন থেকে চার মাস পর যদি বিনিময় হার বাজারভিত্তিক হয়ে যায় এবং কোনো অস্থিরতা দেখা দেয়, তখন তা স্থিতিশীল করার যথেষ্ট সুযোগ সরকারের থাকবে না। তাই, অপেক্ষা করা ঝুঁকিপূর্ণ।'

কারণ প্রতিমাসেই রিজার্ভ এক বিলিয়ন ডলার করে কমছে। এভাবে কমতে থাকলে তা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়তে পারে।

তিনি আরও বলেন, 'বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়াতে হলে বিনিময় হার বাজারমুখী করতে হবে। যত দেরি করা  হবে ততই ঝুঁকি বাড়াবে। তাই তারা অপেক্ষা করে বেশি ঝুঁকি নিচ্ছেন।'

'কিন্তু, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি এখনই সঠিক ব্যবস্থা নেয় ও সমস্যা কমে, তাতে সরকারই উপকৃত হবে এবং তাদের জন্য স্বস্তি বয়ে আনবে। তাহলে অপেক্ষা কেন?' বলেন তিনি।

বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অঘোষিত নির্দেশে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেডা) বিনিময় হার নির্ধারণ করছে। তার মানে বিনিময় হার এখনো নিয়ন্ত্রিত।

জাহিদ হোসেন মন্তব্য করেন, 'এই ব্যবস্থা ঠিকমতো কাজ করছে না।'

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশিষ্ট ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'নির্বাচনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক চক্র ও রাজনৈতিক চক্রকে এক করা ঠিক নয়। রাজনৈতিক চক্রের জন্য অপেক্ষার সময় আমাদের নেই।'

তিনি বলেন, 'এখন আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। রিজার্ভ যদি চলমান গতিতে কমতে থাকে এবং তা রোধে সময়মতো ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচক আরও খারাপ হতে পারে। আমাদের হাতে অন্য কোনো বিকল্প নেই, তাই দেরি করা উচিত হবে না।'

তিনি বলেন, বাহ্যিক ভারসাম্য ও রিজার্ভের ওপর চাপ সব সামষ্টিক অর্থনৈতিক সমস্যার মূল উৎস।

ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পারায় মূলত সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটছে, ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা যাচ্ছে। রিজার্ভ বাড়াতে স্বল্প সময়ের মধ্যে রেমিট্যান্স বড় ভূমিকা রাখতে পারে, কিন্তু রপ্তানি আয় অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল।

তিনি বলেন, 'রেমিট্যান্স দ্রুত বাড়তে পারে। কিন্তু, রেমিট্যান্স আনতে হলে বাজারমুখী বিনিময় হার চালু করতে হবে।'

সম্প্রতি টাকার কিছুটা অবমূল্যায়নের অনুমতি দেওয়ায় অক্টোবরের প্রথম ১৫ দিনে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। কিন্তু, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রেকর্ড সংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী বিদেশে গেছেন, সেই বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হলে রেমিট্যান্স প্রবাহ যথেষ্ট নয়।

সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স প্রবাহ ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন ১ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অথচ, গত বছর ১১ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি বাংলাদেশি দেশ ছেড়েছেন, যা আগের বছরের ৬ লাখ ১৭ হাজার অভিবাসী শ্রমিকের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'রেমিট্যান্স আরও বাড়াতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।'

সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি আগের মাসের তুলনায় শূন্য দশমিক ২৯ শতাংশীয় পয়েন্ট কমেছে। তবে, মূল্যস্ফীতি এখনো ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশের মতো উচ্চ স্তরে আছে। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ভোক্তা মূল্য সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে।

বিশ্বব্যাংকের মতে, মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে এবং চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির বহিস্থ খাতের ওপর চাপ অব্যাহত থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।

মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের আর্থিক উপায় আছে এবং সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের মতো বাজার ব্যবস্থাপনার দিকে মনোনিবেশ করা উচিত।

তিনি বলেন, 'নির্বাচনের পর খেলাপি ঋণ ও মূলধন সংক্রান্ত সংস্কার শুরু হতে পারে।'

জাহিদ হোসেন ও মুস্তাফিজুর রহমান দুজনেই সুদের হারকে বাজারভিত্তিক করার সুপারিশ করেছিলেন এবং এ বিষয়ে সাম্প্রতিক উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।

২০২০ সালের এপ্রিল মাস থেকে চালু থাকা সুদের হারের সীমা গত জুনে প্রত্যাহার করে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারপর চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে একটি সমন্বিত বিনিময় হার বাস্তবায়ন করে এবং চলতি মাসে পলিসি রেট ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অধ্যাপক আতিউর রহমান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই উদ্যোগকে সমর্থন করেন।

তিনি বলেন, 'মুদ্রানীতি সংকোচনশীল থাকা উচিত। উদ্ভাবনী উপায়ে বিনিময় হার নমনীয় করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।'

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোকে বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে আরও রেমিট্যান্স আনতে প্রণোদনা দেওয়ার অনুমতি দিতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ অভিবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থের প্রায় অর্ধেক হুন্ডির মতো অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে আসে।

সরকার ইতোমধ্যে ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে।

তিনি বলেন, 'অতিরিক্ত প্রণোদনার কারণে রেমিট্যান্সের বিনিময় হার বাজার দরের কাছাকাছি চলে আসবে।'

তিনি মনে করেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছে। এতে রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা উপকৃত হচ্ছেন। তাই আগামী মাসগুলোতে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি প্রবাহ বাড়তে পারে।'

Comments

The Daily Star  | English

1,500 dead, nearly 20,000 injured in July uprising: Yunus

He announced plans to demand the extradition of deposed dictator Sheikh Hasina from India

1h ago