যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা

জীবনের জন্য পড়াশোনা, পড়াশোনার জন্য জীবন নয়

যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা
কনফারেন্সে শেষে ড. ডেবোরাহ ও ড. এলিজাবেথের সঙ্গে নাদিয়া রহমান (মাঝে)। ছবি: মনিরা মনি

সময়টা এখন শরতের মৃদুমন্দ বাতাসের। হাঁটতে বেরুলে রঙিন সব পাতা পড়ে থাকে পায়ের নিচে। আবহাওয়াটা বেশ শান্ত হলেও পড়াশোনার গতি বিপরীত। কেন না এখন সিমেস্টারের সব চাইতে 'পিক আওয়ার'। কোর্স ওয়ার্ক ছাড়াও বেশ চিন্তিত ছিলাম নিজের থিসিস নিয়ে। এখানে গবেষণা মানেই শ খানা গবেষণা আর্টিকেল, নিখুঁতভাবে সব কিছু উপস্থাপন আর অধ্যাপকদের সঙ্গে কয়েকখানা মিটিং। 

তারও আগে প্রফেসরদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নিজের থিসিস কমিটি নিজেকেই ঠিক করে বিভাগে জমা দিতে হয়। সব মিলিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলাম। এমনকি মনে হচ্ছিল থিসিস আসলেই করব কি না। 

তবে এখানে যে বিষয়টি একদমই আলাদা তা হলো অধ্যাপকদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা। আমি যতবারই আমার প্রফেসরদের সঙ্গে মিটিংয়ে বিস্তারিত আলোচনায় গিয়েছি ততবারই মনে হয়েছে, এমন মানুষের সঙ্গে কাজ করাটা আমার জন্যই ইতিবাচক হবে। আমি যতবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছি, আমার অধ্যাপকেরা ততবারই অভয় দিয়েছেন। শুনেছি, 'জীবনের জন্য পড়াশোনা, পড়াশোনার আগে তোমার ব্যক্তিগত জীবন নয়', 'না হয় সময় বেশিই লাগবে তোমার গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে, তাতে তুমি নিশ্চয়ই খারাপ শিক্ষার্থী হয়ে যাবে না'। আমি তো ভিন্ন মহাদেশের মানুষ। আমার দেখার এবং পরিমাপের দৃষ্টিভঙ্গি তো গড়ে উঠেছে ভিন্ন আদলে! 

সেখানে ছোটবেলা থেকেই ভালো রেজাল্ট বা ফল দিয়ে যেভাবে পুরো শিক্ষার পরিবেশটাকে একটা গণ্ডিতে রেখে দেওয়া হয় সেটা তো আমার মধ্যে এখনো কমবেশি কাজ করে। আমরা তো শিখেছি পড়া মনে রাখা কিংবা মুখস্থ করা, কিন্তু কোনো কিছুকে বারবার প্রশ্ন করে নতুন আদলে গড়ে তুলতে শিখিনি। বড়বেলাতেও নয়। 

এখানে মুখস্থ ব্যপারটাই নেই! কোনো কোনো বিভাগে পরীক্ষাও নেই। অনেকেই শুনে মনে করতে পারেন, বেশ বাঁচা গেল! বিষয়টা তেমনও নয়। পরীক্ষা না থাকলেও আপনাকে দিনের পড়া দিনেই শেষ করতে হবে। প্রতিটা ক্লাসে এই সিলেবাসের ওপর আলোচনা করতে হবে। আপনি যত ইচ্ছা অধ্যাপককে প্রশ্ন করতে পারবেন। যত প্রশ্ন করবেন তার ওপর আপনার গ্রেডিং বা নম্বর নির্ধারিত হয়। তাই বলে কাউকে ছোট করবার উদ্দেশ্যে কিংবা 'আজব' কোনো প্রশ্ন অবশ্যই নয়। যে প্রশ্নই আপনি করবেন তার আগে কনটেক্সট আপনাকে আলোচনা করে নিতে হবে। 

আমি নিজে যে কয়েকটি ফাইনাল পরীক্ষায় বসেছি, সবগুলোই ছিল ওপেনবুক। আপনি বই, প্রয়োজনীয় ম্যাটেরিয়াল পাশে নিয়েই বসতে পারবেন। আপনি চাইলেই ইন্টারনেট থেকে সব তথ্য খুঁজে নেবেন, তাতে সমস্যা নেই, কিন্তু আপনি আসলেই চিন্তা করছেন কি না, একজন গবেষক হিসেবে নতুন কোনো উদ্ভাবন বা বিষয় নিয়ে ভাবছেন কি না, তার উপস্থাপন করতে হবে পরীক্ষার খাতায়। এখানে প্রশ্নও করা হয় সেই আদলেই। 

আরেকটি বিষয় যা আসলেই ভালো লাগে তা হলো এখানে গ্রেডিং বা নম্বর নিয়ে কোনো প্রতিযোগিতা নেই। কে কত গ্রেড পেল এটা কেউ জিজ্ঞেস করে না, জিজ্ঞেস করাটাই এখানে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। এখানে শুধু দেখা হয় আপনি বছর শেষে কয়টি কনফারেন্স, সিম্পোজিয়ামে অংশ নিলেন, কয়টি গবেষণা করলেন। আমার নিজেরই অভিজ্ঞতা আছে, পরিসংখ্যানের এক পরীক্ষায় গিয়ে উত্তর না করে চলে আসবার। কারণটা ছিল, এখানকার প্রযুক্তিগত এত সংযোজন বুঝতে না পারা। কেন না, এখানে নিত্য নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার, প্রায়শই সেগুলোর পরিবর্তন করা হয়। আমি এক সপ্তাহ পর প্রফেসরকে গিয়ে বলায় উনি জিজ্ঞেস করলেন, আমি আসলেই সত্যি বলছি কি না! এরপর সেই একই প্রশ্নে আমাকে আবারও পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দিলেন। অবশ্যই তার উত্তর আমাকে প্রফেসরের সামনে বসেই করতে হয়েছে। কিন্তু একজন অধ্যাপক হিসেবে আমার মতো এক ভিন দেশের শিক্ষার্থীকে যে উনি অভয় দিয়ে আবারও সুযোগ দিলেন, এ ধরনের পরিস্থিতির সঙ্গে আমি আগে কখনো পরিচিত ছিলাম না! কারণ এখানে সব কিছুর ঊর্ধ্বে গুরুত্ব দেওয়া হয়, শেখা এবং চিন্তার ওপর। আপনি প্রকৃত অর্থেই কতটুকু শিখতে পারছেন এবং তা ভবিষ্যতে প্রয়োগ করতে পারছেন দেশের জন্য, এটাই এখানে মুখ্য।
 
এখানে শিশুদের দেখিনি স্কুল থেকে ফিরে ভারি ব্যাগ নিয়ে কোচিং সেন্টারে দৌড়াতে। সব বাচ্চাই নির্ভারভাবে বিভিন্ন খেলাধুলা আর লাইফ স্কিলস শিখছে এই বয়স থেকেই। সাঁতার, সাইক্লিং, জুডো, স্কেটিং, ব্যালে কত কিছু করতে দেখি! শিশুদের মা-বাবাদেরও এত চিন্তিত থাকতে দেখিনি কোচিং, পরীক্ষার ফল, প্রতিযোগিতা নিয়ে। শারীরিক এবং মানসিক বিকাশের সব রকম পরিবেশই এখানে আছে।
 
তাই প্রতিটি বেলায়ই ভাবি, শেখার আসলে কোন শেষ নেই!

 

নাদিয়া রহমান: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির শিক্ষার্থী।

 

Comments

The Daily Star  | English

Nowfel gained from illegal tobacco trade

Former education minister Mohibul Hassan Chowdhoury Nowfel received at least Tk 3 crore from a tobacco company, known for years for illegal cigarette production and marketing including some counterfeit foreign brands.

4h ago