লেক্সিংটন সমাধিক্ষেত্র: বসন্তের একটি দিন আর শত-সহস্র চেরি ফুল

ভ্রমণ
ছবি: নাদিয়া রহমান

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকিতে বসন্ত শুরু হয় মার্চ থেকে, আর পুরোদমে এপ্রিল থেকে। বসন্তের শুরুটা বোঝা যায় যখন ক্যাম্পাস, গ্র্যাডহাউজিংয়ের চেরি গাছগুলোতে সাদা, হালকা গোলাপি ফুলগুলো ফুটতে শুরু করে। দুপাশে গুচ্ছ হয়ে ফুটে থাকা ফুল গাছগুলোর নিচ দিয়ে আমরা হেঁটে যেতাম ক্যাম্পাসে কিংবা ক্যাম্পাস থেকে গ্র্যাডহাউজিংয়ে।

তবে কেন্টাকিতে বসন্তের এই চেরি ফুলের সৌন্দর্য দেখা যায় লেক্সিংটনের সেমেট্রি বা সমাধিক্ষেত্রে। দুপাশ জুড়ে বিশাল শত-শত চেরি ফুলগাছগুলো থেকে তুষারের মতো ফুলের পাপড়ি ঝরে পড়ে পুরো রাস্তা হালকা গোলাপি হয়ে থাকে এই সময়টা। আসলে বসন্ত উপভোগ করার জন্য অনেক জায়গার কথা মনে আসলেও, সমাধিক্ষেত্র হয়তো প্রথমেই মনে আসে না। কিন্তু যারা কখনো লেক্সিংটন সেমেট্রিতে গিয়েছেন, তারা জানেন এ সময়টা একঘেয়ে তুষারের পর বসন্তের চেরি ব্লসোম দেখার জন্য অন্যতম।

রঙিন ক্র্যাব আপেল, সুউচ্চ ম্যাগনোলিয়া, টিউলিপ আর গোলাপি রঙের চেরি ফুলসহ প্রায় ষোল হাজার গাছ রয়েছে এই সমাধিক্ষেত্রে। এটি সমাধিক্ষেত্র হলেও প্রবেশে কোনো বিধিনিষেধ নেই। আর এও সত্য, যারাই এখানে যায় তারাও এতটা শান্তিপ্রিয় যে আলাদাভাবে নতুন করে কোনো নিয়ম বা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি এই সমাধিক্ষেত্রের কর্তৃপক্ষ। শুরুতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে থাকলেও ১৮৪৯ এর দিকে এটি জনসমাধিক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে। ১৭০ একর বিস্তৃত এই সেমেট্রি একইসঙ্গে 'আরবোরেটাম' বা জাতীয় উদ্যান হিসেবেও উম্মুক্ত করে দেওয়া হয় সেই সময়ে।

যুক্তরাষ্ট্র
ছবি: নাদিয়া রহমান

ঢোকার পথে সেই রোমানিয়ান সময়ের গথিক একটি লোহার ফটক, তার পাশে পার্কিং করে এগুলেই চোখে পড়বে কয়েক রকমের রঙিন টিউলিপ। ফল বা শরতের শুরুতে কিছু টিউলিপ চোখে পড়লেও বসন্তের মতন উজ্জ্বল টিউলিপের আসলে তুলনা হয় না। টিউলিপের পরেই শুরু হয়েছে চেস্টনাট, উইলো, পাইন গাছেদের সারি। গাছেদের সারির মধ্যে শত বছরের পুরনো সমাধিক্ষেত্র। এখানে প্রায় ৭৪ হাজারেরও বেশি সমাধি রয়েছে। সমাধিক্ষেত্রে শায়িত প্রিয়জনের উদ্দেশ্যে পাথরের ফলকে লেখা আছে প্রিয় কোনো কবিতা, বাইবেলের বাণী কিংবা নিজেদের মনের শেষ কথাগুলো।

কোনো কোনো সমাধিক্ষেত্রের সঙ্গেই রয়েছে পুরোনো দিনের পাথরে তৈরি প্রতিকৃতি, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটেরিয়েট হেনরি ক্লের ১২০ ফুট দীর্ঘ স্মৃতিস্তম্ভটি কয়েক ব্লক দূর থেকেও চোখে পড়বে সহজেই। ক্রীতদাস প্রথা উচ্ছেদের জন্য এই হেনরি ক্লের ভূমিকা ছিল বেশ অগ্রগামী। পথ হারিয়ে ফেললেও এমন স্মৃতিস্তম্ভগুলো দেখে আমরা পথ চিনে ফিরে আসতে পেরেছিলাম মূল ফটকে।

যুক্তরাষ্ট্র
ছবি: নাদিয়া রহমান

কত শত বছরের সাক্ষী এই প্রতিকৃতিগুলো দাঁড়িয়ে আছে স্থিরভাবে। বাতাসে উড়ে আসা চেরি ফুল, সবুজ ছোট পাতা পড়ে জমে রয়েছে এই একেকটা প্রতিকৃতির গায়ে। সবথেকে কনিষ্ঠ আমেরিকার ভাইস-প্রেসিডেন্ট জন সি. ব্রেকইনরিজ, আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময়কার কনফেডারেট জন হান্ট মরগ্যানসহ ইতিহাসের বহু মানুষের স্ট্যাচু, ফলক রয়েছে এই চেরী ফুলগুলোর নিচে। সেমেট্রির আরেক অংশ জুড়ে শায়িত রয়েছেন স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধে অংশ নেওয়া সৈনিকরাও।

বিশাল এই ঐতিহাসিক সেমেট্রিতে বেশ কয়েকবার পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। পরে পথ চিনে নিতে সাহায্য করেছে সেমেট্রির আরেক পাশের লেক আর পুকুর। যেহেতু বসন্তের সময়, উইলো আর উইস্টেরিয়া গাছ নুয়ে পড়ছিল লেকের ওপরে। মাথার ওপর হালকা গোলাপি রঙের উইস্টেরিয়া আর চেরি ব্লসোম, সামনে লেকের মধ্যে ভেসে বেড়ানো রাজহাঁস। দীর্ঘ তুষার আর একঘেয়ে শীতের পর বসন্তের এক ভর দুপুরে ইতিহাসের বহু পুরোনো এই সমাধিক্ষেত্রে বসে মনে হয়েছিল, ভিন্ন এক যুগের কোনো এক জায়গায় চলে এসেছি।

মনে হচ্ছিল, ডর্ম জীবনের হাসিঠাট্টা, ক্যাম্পাসের সরব ক্লাসরুম বা শহরতলীর মনোরম আলোতে সন্ধ্যার আড্ডার সঙ্গে সেই ভর দুপুরের তেমন কোনো মিল নেই। ফিরে আসতে আসতে বিকেল, সূর্যের তাপ তখনও কমেনি। গাড়িতে ওঠার সময় আবারও চোখে পড়ল সেই রঙিন টিউলিপগুলোকে, কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে কত উজ্জ্বলতার সঙ্গে এই বসন্তে প্রকাশ করেছে নিজেদের। আর শেষ বেলায় মনে পড়ছিল, কয়েকটি সমাধিফলকে লেখা কিছু বাক্য, 'নীরবে, স্থিরতার সঙ্গে তোমাকে স্মরণ করছি, আমার চিত্তের প্রশান্তিতে'।

নাদিয়া রহমান: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির শিক্ষার্থী।

 

Comments

The Daily Star  | English

Tanvir takes five as Tigers clinch 2nd Sri Lanka ODI

Bangladesh captain Mehidy Hasan Miraz has won the toss and opted to bat first in the second ODI against Sri Lanka, looking to keep the three-match series alive with a win at the R Premadasa Stadium today. 

14h ago