টানা দুই মাস ১২ শতাংশের ওপরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি, মানুষের কষ্ট কমছে না

বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি
স্টার ফাইল ফটো

বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক শেষ করেছেন মীর রাসেল। বর্তমানে তিনি বেসরকারি খাতে চাকরি খুঁজছেন। কিন্তু, খাদ্য পণ্যের আকাশছোঁয়া দামের অসহনীয় হয়ে উঠেছে তার জীবনযাপন। উচ্চ মূল্যের কারণে খাদ্য তালিকা থেকে ফল ছাঁটাই করেছেন। কারণ টিউশনি করে জীবিকা নির্বাহ কার রাসেলের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে।

মীর রাসেল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'উচ্চমূল্যের বাজারে জীবনযাপন সত্যিই অসহনীয় হয়ে উঠেছে। এখন সবকিছুর দাম আকাশছোঁয়া। খাবারের প্লেটে মাছ ও মাংসের উপস্থিতি কমেছে। কারণ, এগুলো এখন সাধ্যের বাইরে।'

তিনি রাজধানীতে দুই রুমের ভাড়া বাসায় থাকেন। সেখানে তার সঙ্গে আরও আটজন থাকেন। ২৬ বছর বয়সী এই তরুণের আয়ের প্রধান উৎস টিউশনি। সেই আয় দিয়েই বেশিরভাগ ব্যয় বহন করেন। ফলের দাম সাধ্যের বাইরে চলে যাওয়ায় ফল কেনা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন এই তরুণ।

শুধু রাসেল নয়, চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেশের মানুষের জীবনযাপনে প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে নির্দিষ্ট ও নিম্নআয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা সীমিত করেছে মূল্যস্ফীতি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশে, যা আগস্টের ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ থেকে সামান্য কম। কিন্তু, এক বছর আগের একই মাসের চেয়ে প্রায় তিন পার্সেন্টেজ পয়েন্ট বেশি।

ফলে, বেশিরভাগ খাদ্য পণ্যের দাম কমার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। ফলে, সাধারণ মানুষের আয়ের বেশিরভাগ ব্যয় করতে হয়েছে খাদ্য পণ্য কিনতে।

তবে, খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতিও কিছুটা কমে হয়েছে ৭ দশমিক ৮২ শতাংশ, যা আগস্টে ছিল ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) হয়েছে ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ, যা  ১২ বছরের মধ্যে আগস্টে রেকর্ড করা মূল্যস্ফীতির চেয়ে ২৯ বেসিস পয়েন্ট কম।

বিশ্বব্যাংকের মতে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতা কমিয়েছে। এটি ব্যক্তিগত খরচ আনুমানিক সাড়ে সাত শতাংশ থেকে সাড়ে তিন শতাংশ কমিয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ কারণে গত দেড় বছরে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি দ্রুত গতিতে বেড়েছে। বাহ্যিক কারণগুলোর মধ্যে আছে- ইউক্রেনে-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন এবং দেশের বাইরে থেকে আমদানি করা পণ্যের উচ্চমূল্য। অভ্যন্তরীণ কারণগুলোর মধ্যে আছে- গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার ২৮ শতাংশ অবমূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, ৩০ শতাংশ রিজার্ভ হ্রাস- এসব কারণে আমদানিতে সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে।

গতকাল বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শিল্প খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ১৭৯ শতাংশ বৃদ্ধি ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়েছে।

এছাড়া ডিজেলের উচ্চমূল্য সেচ ও কৃষিপণ্যের দামে প্রভাব ফেলেছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে পেট্রোলের দাম বৃদ্ধির কারণে পরিবহন ব্যয় বেড়েছে, যা খুচরা বাজারে পণ্যের দামে প্রভাব ফেলেছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ডিস্টিনগুইশড ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ বছরের সেপ্টেম্বরে ১২ শতাংশের বেশি খাদ্য মূল্যস্ফীতি দেখা গেছে, অথচ ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ০৮ শতাংশ।

তিনি বলেন, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে যে পণ্য ১০০ টাকায় কেনা হয়েছে ২০২২ সালের একই মাসে তার দাম দাঁড়ায় ১০৯ টাকা, আর চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে সেই একই পণ্য প্রায় ১২২ টাকায় কিনতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, 'গ্রাম ও শহরের মানুষ খাদ্য ব্যয় মেটাতে চাপের মধ্যে আছে। শুধু দরিদ্ররা নয়, নির্দিষ্ট ও মধ্যম আয়ের মানুষও এই চাপে ভুগছে। কারণ তাদের আয়ের সিংহভাগ ব্যয় করতে হচ্ছে খাবার কিনতে।'

'মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ স্তরে আছে, এটি নজিরবিহীন,' বলেন তিনি।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক এবং নীতি সুদহার কয়েকবার বাড়িয়েছিল। তবে ঋণের সুদ হারের সীমাবদ্ধতায় মুদ্রানীতি ব্যাহত হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

এদিকে খাদ্য পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ডিম, পেঁয়াজ ও আলুর  দাম নির্ধারণ করে সরকার। চিনি ও তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাসের দামও নির্ধারণ করা হয়।

সেলিম রায়হান বলেন, 'সরকারের দাম নির্ধারণের নীতি কাজ করছে না। বাজারে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাই মুদ্রানীতিও এখন কাজ করছে না। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, সরকারের এই উদ্যোগ কোনো কাজে আসেনি।'

তিনি বলেন, 'বাজার স্থিতিশীল করতে সরকার খাদ্য পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক কমাতে পারত। কিন্তু এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেই।'

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ডিস্টিনগুইশড ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে তাদের জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনা, মনিটরিং ও সঠিক তথ্যভিত্তিক নীতিমালার অভাব আছে। সরকারও এসব বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে।'

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (সিএবি) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, 'মূল্যস্ফীতির সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে, দাম বৃদ্ধি অব্যাহত আছে এবং এ থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি মানুষের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। খুব শিগগির দাম কমার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।'

অধ্যাপক সেলিম রায়হান সতর্ক করে দিয়ে বলেন, 'আগামী মাসগুলোতে সরকারের অগ্রাধিকারের অভাবে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে। কারণ আসন্ন নির্বাচনের কারণে অর্থনৈতিক বিষয়ের চেয়ে রাজনৈতিক বিষয়গুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে।'

তিনি জানান বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

এছাড়া ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে আরও পণ্য বিক্রির জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

Comments

The Daily Star  | English

Parties agree on 10yr PM term limit, independent police commission

Consensus disclosed by Commission Vice-Chairman Ali Riaz on 19th day of political dialogues at Foreign Service Academy

1h ago