দক্ষিণ চট্টগ্রামের সুস্বাদু পেয়ারা

দক্ষিণ চট্টগ্রামের সুস্বাদু পেয়ারা
দুই কাঁধে বোঝা নিয়ে পাহাড়ি পথ বেয়ে নেমে আসছেন পেয়ারা চাষিরা। ছবি: রাজিব রায়হান/স্টার

সেদিন ছিল শনিবার ভোরবেলা। আকাশ আংশিক মেঘলা। তবে মেঘের আড়াল থেকে  মাঝে মাঝে সূর্য উঁকি দিচ্ছিল। চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার রওশন হাটের মুখে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পিচঢালা পথ আগের রাতের বৃষ্টির কারণে তখনো ভেজা ছিল। ভোরে দোকানপাট খুলতে খুলতে হাটের দোকানিরা বার বার আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলেন। যেন আকাশের রং দেখে বুঝতে চাইছেন আরও বৃষ্টিপাত হবে কি না। 

সেই সময় দুই কাঁধে বোঝা নিয়ে কিছু লোককে মোড়ের পেছনের সরু বাঁকানো পাহাড়ি পথ বেয়ে নেমে আসতে দেখা গেল। তারা সারিবদ্ধভাবে আসার সময় যে বোঝা বহন করেছিল তা লাল সালুতে মোড়ানো ছিল।
 
তাদের আগমনে হাটে উপস্থিত লোকজনের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা গেল। লাল কাপড়ে মোড়ানো ভারে কী আছে? কাঁধ থেকে বোঝা নামানোর পর ভারীরা যখন সালুর গিট খুলে দিল, তখনই ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো। ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে মুখে জল নিয়ে আসা সবুজ, প্রায় পাকা, সুস্বাদু ডাসা পেয়ারা।

ওই ভারীরা ছিল আসলে একদল পেয়ারা চাষি, যারা পাহাড়ে তাদের বাগান থেকে পেয়ারা নিয়ে আসছিল পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রির জন্য। ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকা থেকে কিছু পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী এ হাটটিতে ভিড় করেছেন।
  
চট্টগ্রামের ২ পার্শ্ববর্তী উপজেলা চন্দনাইশ ও পটিয়া সুস্বাদু পেয়ারা উৎপাদনের জন্য সারাদেশে বিখ্যাত। এই এলাকার পেয়ারা স্বাদ ও আকারের জন্য সুখ্যাতি কুড়িয়েছে বহুকাল থেকে। তাইতো দূরদূরান্ত থেকে ব্যবসায়রীরা পেয়ারার মৌসুমে প্রতিদিন ভোরে এখানে এসে ভিড় করেন পেয়ারা কিনতে। 
 
পটিয়া ও চন্দনাইশ উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ এলাকার প্রায় ১ হাজার হেক্টর পাহাড়ি জমিতে পেয়ারা চাষ হয় এবং প্রতি বছর মৌসুমে গড়ে প্রায় ৭ কোটি টাকার পেয়ারা বিক্রি করেন চাষিরা।

স্থানীয় চাষিরা জানান, পটিয়া ও চন্দনাইশ উপজেলার পাহাড়ি ও সমতল জমিতে শতাধিক বাগানে পেয়ারা চাষ হয়। তবে বেশির ভাগ বাগানই চন্দনাইশ উপজেলার পাহাড়ি এলাকায়। এসব বাগানে পেয়ারা ছাড়াও আম, কাঁঠাল, লিচু, লেবুসহ অন্যান্য ফল চাষ করেন তারা। তবে এলাকাটি পেয়ারা উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত।

এই সুস্বাদু ফলটি কিনতে মৌসুমে প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা এখানে আসেন। এই অঞ্চলের পেয়ারা তার স্বাদের জন্য মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। 

চাষিরা জানান, এই অঞ্চলের কাঞ্চন নগরের পেয়ারা তার আকার ও স্বাদের জন্য অনেক সুনাম কুড়িয়েছে। কাঞ্চন নগর চন্দনাইশ উপজেলার কাঞ্চনাবাদ ইউনিয়নের একটি গ্রাম। 

পেয়ারার মৌসুমে বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা দুই উপজেলার রওশন হাট, বাগিচা হাট, বাদাম তল, কমল মুন্সির হাট ও খরনা বাসস্ট্যান্ডসহ বিভিন্ন স্পটে আসেন, যেখানে প্রতিদিন সকাল থেকে পেয়ারা নিয়ে ভিড় জমান পেয়ারা চাষিরা। এই স্পটগুলো চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে অবস্থিত হওয়ায়  ব্যবসায়ীরা সহজেই এগুলো তাদের নিজ নিজ গন্তব্যে পরিবহন করে নিতে পারেন। 

পেয়ারা চাষি আব্দুল মাবুদ জানান, বাংলা আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে আশ্বিনের শুরু (জুলাই ও সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত পেয়ারার মৌসুম। অবশ্য দীর্ঘ খড়ার কারণে এ বছর উৎপাদন কিছুটা কম বলে জানিয়েছেন তিনি। 
 
চন্দনাইশ পাহাড়ি এলাকায় প্রায় ১৫ শতাধিক কৃষকের নিজস্ব পেয়ারা ও অন্যান্য ফলের বাগান রয়েছে। 

আব্দুল মাবুদ বলেন, 'মুজাফফরাবাদ থেকে দোহাজারী পর্যন্ত বিস্তৃত এসব বাগানে কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করেন।' 

তিনি আরও জানান, এ উপজেলার হাশিমপুর ও কাঞ্চনাবাদ ইউনিয়ন পেয়ারা বাগানের প্রধান কেন্দ্রস্থল।

বন্দর নগরীর কোতয়ালী এলাকা থেকে আসা খুচরা ব্যবসায়ী আবুল কাশেম বলেন, 'এই এলাকার পেয়ারা স্বাদ ও আকারের জন্য বিখ্যাত। তাই, ক্রেতাদের কাছে এর চাহিদা বেশি।'

চন্দনাইশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আজাদ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, উপজেলার পেয়ারা চাষিরা ৭৫৫ হেক্টর জমিতে ১৫০০ মেট্রিক টন পেয়ারা উৎপাদন করেছেন এই বছর।

তিনি বলেন, 'আমরা তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি এবং উন্নত ফলনের জন্য বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছি।'

যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. হারুন-উর-রশিদ বলেন, 'চন্দনাইশ ও পটিয়ার পেয়ারা একটি দেশি জাত।'

তিনি আরও বলেন, 'মাটি ও পানির গুণাগুণ এবং আবহাওয়াসহ কিছু পরিবেশগত বৈচিত্র্য এর কারণে এই অঞ্চলের পেয়ারা স্বাদে ও আকারে দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা।'

 

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh lost over Tk 226,000cr for tax evasion: CPD

CPD estimated that around 50 percent of this amount has been lost to corporate tax evasion.

1h ago