ড্যান্ডিতে ডুবছে পথশিশুদের জীবন

১০ বছরের রানার বাড়ি কুমিল্লার শাসনগাছায়। রাত ১০টার পর ঢাকার ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের সামনে সিটি করপোরেশনের ময়লার ট্রাকে চুক্তি ভিত্তিতে কাজ করে রানা। এই কাজ করে মাসে আয় হয় ৩ হাজার টাকা। তবে পুরো টাকাই উড়ে যায় 'ড্যান্ডি'র পেছনে।

সম্প্রতি ফার্মগেটে একটি ফুট ওভারব্রিজে ডেইলি স্টারের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় রানার। সময়টা তখন পড়ন্ত বিকেল। কথা বলার ফাঁকে বোতলে মুখ ঢুকিতে ড্যান্ডি সেবন করেছিল রানা। পাশেই ওভারব্রিজের মেঝেতে বসে ঝিমাচ্ছিল রাকিব নামের আরেক পথশিশু। রানা জানায় রাকিব তার বন্ধু। একই ওভারব্রিজে শিল্পী ও স্বপ্না নামের আরও দুটি মেয়ে নিজেদের মাঝে গল্পের ফাঁকে পলিথিনে মুখ ঢুকিয়ে ড্যান্ডি সেবন করছিল।

ঘণ্টাখানেক পরে এই প্রতিবেদক আবার ফার্মগেটের সেই ওভারব্রিজে যান। তখন সন্ধ্যা গড়িয়েছে। অন্ধকার ওভারব্রিজে উঠতেই দেখা গেল নোংরা মেঝেতে কাপড় বিছিয়ে মড়ার মতো ঘুমাচ্ছে রানা বাদে বাকিরা। কেবল মুখের সামনে একটা বোতল রেখে নিঃশ্বাসের সঙ্গে তখনো ড্যান্ডি সেবন করছিল রানা। আলাপের এক পর্যায়ে রানা বলে, 'দিনে দুইবার ডান্ডি খাই। ডান্ডি খাইলে বেবাক কিছু ভুইলা থাকন যায়।'

ড্যান্ডি কী

ড্যান্ডি মূলত একধরনের আঠা। ড্যানড্রাইট অ্যাডহেসিভ বা ড্যান্ড্রাইট নামের আঠাটিকেই মাদক সেবীরা ডান্ডি বলে চেনে। এই আঠা দিয়ে নেশা করে তারা। আঠায় থাকা কার্বন-ট্রাই-ক্লোরাইড, টলুইন, অ্যাসিটোন ও বেনজিন স্বাভাবিক তাপমাত্রাতেই বাষ্পে পরিণত হয়। এসব রাসায়নিক শ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে মাদকসেবি পথশিশুরা। চিকিৎসকরা জানান, ক্রমশ ব্যবহারের কারণে মাদকটি ধীরে ধীরে চরম আসক্তিতে পরিণত হয়।

উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মনরোগবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. সৈয়দ ফাহীম সামস ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পথশিশুদের ড্যান্ডি গ্রহণ করার একমাত্র কারণ এটি সস্তা ও সহজলভ্য। পথশিশুরা এটি নাক দিয়ে গ্রহণ করে, এবং একধরনের মনস্তাত্ত্বিক অবসাদে চলে যায়। যাকে তারা সমস্ত কিছু থেকে নিস্তার পাওয়া বলে মনে করছে। একই সঙ্গে তারা মনে করে তারা অতীতকে ভুলতে পারছে। অন্য মাদকের চেয়ে ড্যান্ডির পার্থক্য হলো এটি অন্য ধরনের এক অনুভূতির সৃষ্টি করে, যা আবেগকে ভিন্নভাবে পরিবর্তিত করে। যে কারণে পথশিশুদের মধ্যে এটি জনপ্রিয়। দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে গুরুতর মানসিক সমস্যার পাশাপাশি শিশুদের শারীরিক জটিলতাও সৃষ্টি হয়।'

ড্যান্ডি কোথায় পাচ্ছে পথশিশুরা

সম্প্রতি তেজগাঁও রেলস্টেশনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কয়েকজন মাদকাসক্ত পথশিশুর কথা হয়। তারা জানায়, নেশা করার জন্য আঠাটি তারা মুচির কাছ থেকে কিনে নেয়। তেজগাঁও রেলস্টেশনে এক মুচির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আঠাটি বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও হার্ডওয়্যারের দোকানে বিক্রি হয়। একাধিক হার্ডওয়্যারের দোকানীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ড্যানড্রাইট অ্যাডহেসিভ নামের আঠাটি ভারত থেকে আসে। এই আঠা দিয়ে সাধারণত বিভিন্ন ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি, প্লাস্টিকের ব্যবহার্য জিনিসপত্র, চামড়া সহ বিভিন্ন পণ্য জোড়া দেওয়ার কাজ করা হয়। কৌটায় এবং টিউবে দুইভাবেই বিক্রি করা হয় আঠাটি। টিউবের আঠাটির দাম ৩৫ টাকা। তবে কৌটায় পরিমাণে বেশি থাকায় দামও বেশি হয়।

হার্ডওয়্যার দোকানি আবদুল হামিদ বলেন, টিউবের দাম কম, পরিমাণেও থাকে কম। সে তুলনায় কৌটায় কিনলে লাভ। তাই পথশিশুরা কখনো- কখনো টিউব কিনলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুচি কিংবা ক্ষুদ্র ইলেকট্রিক পণ্য সারাইয়ের দোকানে কৌটা থেকে ৪০-৫০ টাকার আঠা কিনে থাকে।

তেজগাঁও রেলস্টেশনে ওসমান নামের এক পথশিশুর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। ওসমান জানায়, 'পরথম পরথম মাথা ঘুরায়। কয়দিন খাওনের পর সইয়া যায়। এরপরে না খাইলে দম আটকাইয়া আহে।'

আরিফ নামের আরেক পথশিশু জানায়, এই মাদক নিলে ঘোরের মধ্যে চলে যায় তারা।

ড্যান্ডি আসক্তের সংখ্যা

২০২২ সালে ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) 'পথশিশুদের জরিপ ২০২২' এ পথশিশুদের প্রকৃত সংখ্যা না থাকলেও ইউনিসেফের বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, দেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি হতে পারে। বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয় দেশের মোট পথশিশুর মধ্যে ৪৮ দশমিক ৫ ভাগই ঢাকা বিভাগে থাকে।

অন্যদিকে ২০২২ সালে প্রকাশিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) একটি গবেষণায় বলা হয় দেশে ৫৮ শতাংশ পথশিশু মাদকে আসক্ত। ১৪ শতাংশ শিশুর বয়স ১০ বছর হওয়ার আগেই মাদক গ্রহণ করে। তুলনামূলক সহজলভ্য ও সস্তা হওয়ায় পথশিশুদের মধ্যে ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ শিশুই গাঁজা সেবন করে। ড্যান্ডিতে আসক্ত ১৫ দশমিক ২ শতাংশ শিশু।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গবেষণা ও ইউনিসেফের বিশেষজ্ঞদের তথ্য অনুযায়ী ঢাকাতেই ড্যান্ডিতে আসক্ত পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার।

গবেষণার বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (নিরোধ শিক্ষা) মো. মানজুরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের গবেষণায় দেখা যায় পথশিশুদের মধ্যে গাঁজা সেবনের প্রবণতা বেশি। তবে ঢাকার পথশিশুরা ড্যান্ডিই বেশি সেবন করে। এখন সে সংখ্যাটি নিশ্চয়ই আরও বেড়েছে। মূলত ৫-১০ বছর বয়সী পথশিশুদের মধ্যেই ড্যান্ডি গ্রহণের প্রবণতা বেশি।'

সরকারের উদ্যোগ

পথশিশুদের বিষয়টি সাধারণত দেখে থাকে সমাজসেবা অধিদপ্তর। মাদকাসক্ত পথশিশুদের বিষয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরও একাধিক প্রকল্পের অধীনে বেশ কিছু কাজ করেছে বলে জানান অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম চৌধুরী। ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'মাদকাসক্ত পথশিশুদের জন্য আমাদের নানা কার্যক্রম রয়েছে। সারা দেশে সমাজসেবা অধিদপ্তরের ১৩টি শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে। যেখানে প্রায় ২ হাজার ৬০০ আসন রয়েছে। এই কেন্দ্রগুলো মূলত পথশিশুদের জন্যই করা। এসব কেন্দ্রে মাদকাসক্ত পথশিশুরাও বিনামূল্যে সেবা পেতে পারে। স্থায়ী আবাসের জন্য ভবন নির্মাণাধীন থাকায় এখন এসব কেন্দ্রের কার্যক্রম ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত হচ্ছে। ভবন তৈরি হলে কেন্দ্রের আসন সংখ্যা বাড়বে।

তিনি আরও বলেন, আমরা ৬টি বিভাগে একটি করে মোট ৬টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে পথশিশুদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এভাবে পথশিশুদের পুনর্বাসন করা হয়। আমরা ইউনিসেফের সহযোগিতায় পথশিশুদের একটি ডাটাবেজ তৈরি করছি। এটি শেষ হলে পথশিশুদের সম্পর্কে আমরা পূর্ণাঙ্গ একটি ধারণা পাব।

কামরুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, 'ইউনিসেফের সহযোগিতায় ঢাকায় পথশিশুদের জন্য তাঁবু ভিত্তিক তিনটি শিশু কল্যাণ হাব রয়েছে। এসব হাবে মাদকাসক্ত পথশিশুরা কাউন্সেলিং, পড়াশোনাসহ সব ধরনের সেবা পাচ্ছে। ঢাকার মতো দেশের আরও কয়েকটি সিটি করপোরেশনে এই ধরনের হাব তৈরি হচ্ছে।'

চিকিৎসাতেও অপর্যাপ্ততা

মাদকাসক্ত পথশিশুদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তরের অধীনে থাকলেও মাদকাসক্ত শিশুদের চিকিৎসার জন্য তাদের কোনো চিকিৎসাকেন্দ্র নেই। যার ফলে চিকিৎসা নিতে মাদকাসক্ত পথশিশুদের মাদকসেবী নিরাময় কেন্দ্রেই যেতে হয়।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী মাদকাসক্তদের জন্য দেশে সর্বমোট ৩৬২টি নিরাময় কেন্দ্র আছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় মাদক নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা চারটি।

বেসরকারি কেন্দ্রে ৪ হাজার ৮৪৬টি শয্যা থাকলেও সরকারি নিরাময় কেন্দ্রে শয্যা সংখ্যা মাত্র ১৭৯টি; যা প্রয়োজনের তুলনায় ভীষণ অপ্রতুল বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্র ব্যয়বহুল হওয়ায় পথশিশুদের সেখানে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ থাকে না।

প্রতিকার কি

পথশিশুদের ড্যান্ডি গ্রহণ থেকে বিরত রাখতে জনসচেতনতাকেই একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে মানছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (নিরোধ শিক্ষা) মো. মানজুরুল ইসলাম বলেন, 'পথশিশুরা যেন কোনভাবেই ড্যান্ডি না পায় তাই আমরা নানা ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। যেহেতু ড্যান্ডির আঠাটি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার্য পণ্য তাই আমরা এটিকে নিষিদ্ধও করতে পারব না। অন্যদিকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নিবন্ধন পেলেও মুচি বা রিকশাচালক সহ ক্ষুদ্র পেশাজীবীদের নিবন্ধনের মাধ্যমে এটি দেওয়া সম্ভব হবে না। তাই আমরা বিক্রেতাদের বারবার বলছি তারা যেন কোনভাবেই শিশুদের কাছে এটি বিক্রি না করেন। কখনো আবার এমনও হয় পথশিশুরাই রিকশার গ্যারেজ বা জোড়া দেওয়ার কথা বলে মাদক হিসেবে গ্রহণের জন্য আঠাটি কিনে থাকে। এক্ষেত্রে আমরা বিক্রেতাদের বলেছি তারা যেন বিষয়টি অন্তত যাচাই-বাছাই করেই বিক্রি করেন। এক্ষেত্রে সচেতনতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।'

জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজীর আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পথশিশুদের ড্যান্ডি বা মাদক থেকে বিরত রাখতে হলে সরকারকেই বিশদাকারে ভাবতে হবে। এমনভাবে পরিকল্পনা করতে হবে যেন তারা পূর্বের জায়গায় ফিরে না যায়। এক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। দায়সারা ভাব ছেড়ে সরকারকে এই ধারণা পোষণ করতে হবে যে এটি এক ধরনের ইনভেস্টমেন্ট। চিকিৎসার অপ্রতুলতা এবং তাবৎ বিষয় নিয়েই সরকারকে ভাবতে হবে। এছাড়া প্রতিকার সম্ভব নয়।'

Comments

The Daily Star  | English

Admin officers protest plan for more non-admin deputy secretaries

Non-admin officers announce strike tomorrow, demanding exam-based promotions

2h ago