কেন্টাকিতে গ্রীষ্মযাপন

কেন্টাকিতে গ্রীষ্মযাপন

স্প্রিং অর্থাৎ বসন্তকালীন সিমেস্টার শেষ হয়ে যায় মে মাস নাগাদ। এর পরের ৩ মাস এখানে দীর্ঘ গ্রীষ্মকালীন ছুটি। যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষক, শিক্ষার্থী সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে এই বিরতির জন্য। 

এখানকার অত্যধিক যান্ত্রিক জীবনে মানুষ যেমন পরিশ্রম করে, আবার কিছুটা সময় তারা রেখে দেয় জীবনকে উপভোগ করার জন্যেও। পেশাগত জীবনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনেও যাতে ভারসাম্য বজায় থাকে, সেভাবেই প্রত্যেকের শিডিউল করা থাকে।

তিন মাস ছুটি; শুনতে অনেক দীর্ঘ মনে হচ্ছে! তবে চাইলে অনেক শিক্ষক, গবেষক এবং শিক্ষার্থী এই সময়টাতেও কাজ করে। অনেক টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টকে দেখেছি শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর পাশাপাশি আইসক্রিম পার্লারে কাজ করতে। জিজ্ঞেস করায় উত্তর দিয়েছিল, 'একাডেমিক পরিবেশের বাইরে নতুন কিছুর অভিজ্ঞতা নিতে চাই! আর আমি তো বয়স্ক হয়ে যাইনি। ফ্রি আইসক্রিম খাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া কেন করব?'   

আমার এখানে পরিবার নেই। তবে ডর্মে খরচা আছে। আবার গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময়ে টিচিং অ্যাসিসটেন্টের বরাদ্দ কাজ নেই। উপরন্তু আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী হওয়ায় বেশ কিছু বাঁধাধরা আছে ক্যাম্পাসের বাইরে কাজ করবার জন্য। সব কিছু মিলিয়ে একাডেমিক পরিবেশও একঘেয়ে লাগছিল (কেন না এখানে এত গবেষণাপত্র, বই পড়তে হয় প্রতিদিন যে পড়ার টেবিল বা লাইব্রেরিতেই চলে যায় ৮-৯ ঘণ্টা। ক্লাস, লেকচার তো ভিন্ন হিসেব)। সে হিসাব করেই এই গরমের ছুটিতে পড়াশোনার জগতের বাইরে দুটো খণ্ডকালীন সামার-জব করতে হয়েছে, ক্যাম্পাসের মধ্যেই। গ্রীষ্মের এই ৩ মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে যত কনফারেন্স হয়েছে সেসব দেখভাল করা। আর এ যাবৎকালীন গণযোগাযোগের যেসব বিষয় পড়েছি তা বাস্তবে প্রয়োগ করা। ইন্টার্নশিপের জন্য ল্যাটিনো যে প্রান্তিক জনগণ আছে, যারা নিজ ভূমি মেক্সিকো, সালভাদর, পানামা, নিকারাগুয়ার মতো মধ্য আমেরিকা মহাদেশের দেশ থেকে আসেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ। কীভাবে নিজেদের স্বাস্থ্য অধিকার, শিক্ষার অধিকার নিয়ে প্রবাসেও সচেতন হতে হয়, ভিন দেশের ভাষায় যোগাযোগে দক্ষ হওয়া যায়; প্রত্যেকটি কাজ করতে হয়েছে। 

যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছরই হাজারখানেক মাইগ্রেন্ট, ইমিগ্রান্ট মানুষ আসে সেন্ট্রাল আমেরিকা, ভিয়েতনাম, আফগানিস্তানেড় মতো দেশ থেকে। যাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও থাকে না। স্প্যানিশ বা আরবি ছাড়া অনেকে ইংরেজিতেও কথা বলতে জানে না। এমন অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে যারা স্প্যানিশটুকুও পড়তে পারে না, শুধু মাতৃভাষা হওয়ায় বুঝতে পারে। অথচ এসব মানুষ কত মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এক ভিন দেশে এসে অন্ন সংস্থানও করে নিয়েছে এবং মানবেতর জীবনযাপন করে চলেছে। 

ভিয়েতনামের এক ১৩ বছরের স্কুলশিক্ষার্থীকে ইংরেজি শেখানোর দায়িত্ব ছিল এই ৩ মাস। যতবারই তাকে জিজ্ঞেস করেছি, 'আজকের দিন কেমন গেছে', ততবারই সে উত্তর দিয়েছে, 'আমি বাড়ির কথা খুব মনে করি। আমি বাড়ি যেতে চাই'। ১৩ বছরের কৈশোরের এক শিক্ষার্থীর জন্য নতুন পরিবেশ আবদ্ধ মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। তার ওপর বাইরে মানুষের সঙ্গে কথা বলবার ভাষাটাও যখন জানা নেই। মেক্সিকোর আরেকজন নারীকেও ইংরেজি শেখাবার দায়িত্ব ছিল, যিনি ১৫ বছরে একবারও নিজ দেশে যেতে পারেননি বিভিন্ন আইনি জটিলতায়। তার উত্তরটাও ছিল অনেকটা একই রকম, 'মা-বাবা, বোনদের কথা খুব মনে পড়ে। এখানে না আসলেও কি খুব খারাপ থাকতাম?' 

আমার এই ৩ মাসের ইংরেজি ভাষার শিক্ষার্থীরা নিজ ভূমি ছেড়ে নতুন এক দেশে না আসলে ভালো থাকত নাকি থাকত না, তার উত্তর দেওয়া আসলে কারও পক্ষেই সম্ভব না। ইরাক থেকে যিনি এসেছেন মাইগ্রেন্ট হিসেবে, তার হয়তো যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। নয়তো নিজ মাতৃভূমির সঙ্গে ওপর দেশের এমন রূঢ় সম্পর্ক থাকবার পরেও এখানেই কেন আসা? 

ভিন দেশের প্রান্তিক এসব মানুষের সঙ্গে, তাদের নিয়ে কাজ করবার সময় গ্রীষ্মকালে অন্তত নিজের বাড়ি না যাবার আক্ষেপটা ভুলে থাকা যেত। অন্তত স্বস্তি বোধ করতাম এই ভেবে যে, আমার মাতৃভূমি তো যুদ্ধবিদ্ধস্ত নয়। পড়াশোনা শেষ করেই যাওয়া যাবে প্রিয় পথটাতে!

 

নাদিয়া রহমান: প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।

Comments

The Daily Star  | English

Elections entirely Bangladesh's internal matter: Shafiqul

'Wounds caused by crimes against humanity perpetrated by AL still fresh,' says CA's press secretary

55m ago