১৫ বছরে বিদেশে যাওয়া শিক্ষার্থী বেড়েছে ৩ গুণ

প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স

দেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেলেও গত ১৫ বছরে বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ গুণ বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৫ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়া সত্ত্বেও মানসম্মত উচ্চশিক্ষার অভাব, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং দেশে কর্মসংস্থানের সীমিত সুযোগসহ বেশ কয়েকটি কারণে শিক্ষার্থীদের দেশ ছাড়ার প্রবণতা কমানো যাচ্ছে না।

ইউনেস্কোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে অন্তত ৪৯ হাজার ১৫১ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ৫৮টি দেশে পড়াশোনার জন্য গিয়েছেন।

২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ১১২ এবং ২০০৮ সালে ছিল ১৬ হাজার ৬০৯।

২০০৮ সাল থেকে উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে সরকার ২৫টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে এবং ৫৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়েছে।

বর্তমানে দেশের ৫৩টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও তাদের অধিভুক্ত কলেজ এবং ও ১১১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৪ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছে।

তবে শিক্ষাবিদরা বলছেন, অধিকাংশ নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, দক্ষ অনুষদ ও গবেষণা সুবিধার অভাব রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক সদস্য দিল আফরোজা বেগম বলেন, শিক্ষার মান নিশ্চিত না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে খুব বেশি লাভ নেই।

দিল আফরোজা বেগম সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা ভবন নির্মাণের দিকে মনোযোগ দিচ্ছি, কিন্তু মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ভালো শিক্ষক নিয়োগ, গবেষণা সুবিধা, আধুনিক গবেষণাগারসহ অন্যান্য বিষয়ে মনোযোগ দিচ্ছি না।'

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান পরিমাপের কোনো ব্যবস্থা নেই। কিন্তু, আন্তর্জাতিক র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পারফরম্যান্স খারাপ।

২০২৩ সালের টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাঙ্কিং অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ৬০১ থেকে ৮০০তম স্থানের মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) রয়েছে ১ হাজার ২০২ থেকে ১ হাজার ৫০০ এর মধ্যে।

১৩টি সূচকের ওপর ভিত্তি করে ১০৪টি দেশের ১ হাজার ৭৯৯টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এই র‌্যাঙ্কিং করা হয়েছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক টাইমস এশিয়া ইউনিভার্সিটি র‍্যাঙ্কিং ২০২৩ এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি যথাক্রমে ১৮৬তম ও ১৯২তম স্থানে রয়েছে। এই র‌্যাঙ্কিং করা হয়েছে ৩১টি অঞ্চলের ৬৬৯টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, 'নতুন কিছুই শিখছিলাম না। বিশেষ কিছু শেখার বা এবং গবেষণার স্বাধীনতাও তেমন নেই। আমি যে খাতে কাজ করতে চাই তার জন্য সংশ্লিষ্ট দক্ষতা বাড়াতেও কোনো সহযোগিতা পাচ্ছি না।'

যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের জন্য চেষ্টা করছেন তিনি।

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের কাছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, জাপান ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলো উচ্চশিক্ষার জন্য জনপ্রিয় গন্তব্য হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক শিক্ষার্থী এর বাইরের দেশগুলোকেও বেছে নিচ্ছেন।

ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী, সর্বোচ্চ ১১ হাজার ১৫৭ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। এরপরই আছে যুক্তরাষ্ট্র ও মালয়েশিয়া। দেশ ২টিতে শিক্ষার্থী সংখ্যা যথাক্রমে ৮ হাজার ৬৬৫ ও ৬ হাজার ১৮০ জন।

ফরেন অ্যাডমিশন অ্যান্ড ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি কাজী ফরিদুল হক বলেন, পড়াশোনার খরচ তুলনামূলক কম হওয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাজারো শিক্ষার্থী সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ায় যাচ্ছেন।

তিনি দাবি করেন, 'অনেক শিক্ষার্থী, বিশেষ করে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা এসব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে যায়।'

ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে অ্যাফিলিয়েটেড। এ কারণে যারা যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরাসরি ভর্তি হতে পারেন না, তাদের পছন্দের তালিকায় থাকে এসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়।

বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আগে তো শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত কিংবা খুব মেধাবী শিক্ষার্থীরাই বিদেশে পড়াশোনা করতে যেতো। কিন্তু এখন আর্থিক সচ্ছলতার কারণে উচ্চ-মধ্যবিত্তের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত পরিবারও তাদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠাতে পারে।'

শিক্ষা পরামর্শদাতা সংস্থাগুলোর মতে, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা স্নাতক সম্পন্ন করার জন্য বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেতে পছন্দ করে। তবে, বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা সাধারণত স্নাতকোত্তর কোর্সের জন্য বিদেশে যায়।

দিল আফরোজা বেগম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা বেড়েছে এবং এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সাধারণত পাঠ্যক্রমের পার্থক্যের কারণে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় সমস্যায় পড়ে।

তিনি বলেন, 'এ ছাড়া, সীমিত চাকরির বাজার, সেখানেও স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির কারণে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়ে দিতে চান।'

তবে অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, বড় সংখ্যক সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষার অভাব একটি বড় সমস্যা।

তিনি বলেন, 'এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশের ঘাটতি রয়েছে। এর বেশিরভাগেরই শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করার জন্য পর্যাপ্ত গবেষণা সুবিধা এবং মানসম্পন্ন ফ্যাকাল্টি নেই।'

'দুঃখজনকভাবে, এ দেশে শিক্ষার বিষয়টি কেবল পরীক্ষা ও সনদকেন্দ্রিকই রয়ে গেছে, জ্ঞানকেন্দ্রিক নয়। আমরা সংখ্যার দিকে জোর দেই, মানের দিকে না', যোগ করেন তিনি।

অধ্যাপক আবদুল মান্নান ও দিল আফরোজা বেগম দুজনেই বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণেও অনেক শিক্ষার্থী উন্নত শিক্ষা ও জীবনের জন্য বিদেশে চলে যায়।

অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, বাংলাদেশ এই শিক্ষার্থীদের মেধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। কারণ, এসব এই শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে আসেন না।

Comments

The Daily Star  | English

Nowfel gained from illegal tobacco trade

Former education minister Mohibul Hassan Chowdhoury Nowfel received at least Tk 3 crore from a tobacco company, known for years for illegal cigarette production and marketing including some counterfeit foreign brands.

5h ago