বউ-শাশুড়ি কি বন্ধু হতে পারেন

ছবি: সংগৃহীত

মিতা রহমানের (ছদ্মনাম) বিয়ে হয়েছে ৫ বছর। স্বামী, সন্তান, শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে বেশ স্বচ্ছন্দেই থাকার কথা তার। কিন্তু প্রায়ই শাশুড়ির সঙ্গে মনোমালিন্য সুখের সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করে। নানা কাজে শাশুড়ির তাকে নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই

রুমানা (ছদ্মনাম) একজন ব্যাংকার। ব্যাংকের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরে পুরোটা সময় সংসারে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতেও শাশুড়ি খুশি নন রুমানার ওপর। সারাদিনের ব্যস্ততার পর শাশুড়ির অসন্তোষ তার মনেও বিরূপ প্রভাব ফেলে।

আলেয়া বেগম (ছদ্মনাম) একজন শাশুড়ি। ছেলের বউয়ের সঙ্গে প্রায়ই মনোমালিন্য চলতে থাকে তার। তিনি মনে করেন, ছেলের বউ তাকে যথেষ্ট সম্মান দেন না, তার পরামর্শ গুরুত্বের সঙ্গে নেন না। তিনি বেশ কষ্ট পান বিষয়টি নিয়ে।

বউ আর শাশুড়ির মধ্যে এই দ্বন্দ্ব, দূরত্ব আর অসন্তোষ যেন পরিবারের সাধারণ সমস্যায় পরিণত হয়েছে। তবে কি সম্পর্কের ধরনটিই এমন? বউ-শাশুড়ি কি বন্ধুর মতো হতে পারেন না?  এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন মনোবিদ শুভাশীষ কুমার চ্যাটার্জি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকল্যাণ ও পরামর্শদান কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক (মনোবিজ্ঞান) হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি।

শুভাশীষ কুমার চ্যাটার্জি বলেন, 'ছেলের বউয়ের কাছ থেকে শ্বশুরবাড়ির লোকজন অনেক বেশি প্রত্যাশা করে থাকেন, বিশেষ করে শাশুড়িরা। তারা চান ছেলের বউ হবে রূপে-গুণে, শিক্ষা-দীক্ষায় একদম সর্বগুণসম্পন্ন। প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলে তারা পুত্রবধূকে অযোগ্য বলে মনে করেন। এই টার্মটাকে বলা হয় ''অল অর নাথিং থিংকিং''। এই সমস্যার পেছনে একটি বড় কারণ হিসেবে কাজ করে, শাশুড়ির প্রতি তার শাশুড়ির করা বাজে আচরণের স্মৃতি। তার ব্যক্তিগত হতাশা ছেলের বউয়ের ওপর উগড়ে দেন। এই প্রবণতাকে বলা হয়, ''ব্যাটার্ড বেবি সিনড্রোম''।'

'আমাদের দেশে বিয়ের আগে থেকেই মেয়েকে শাশুড়ি সম্পর্কে বিভিন্ন সাবধান বাণী শুনিয়ে বড় করানো হয়। যেমন- ''ঘরের কাজ তো কিছু পার না, শাশুড়ির কথা শুনতে হবে'', ''রান্না ভালো না হলে শাশুড়ি গালমন্দ করবে'' ইত্যাদি। তাই শাশুড়ির প্রতি কোমলভাব তৈরি হওয়ার পরিবর্তে মনে জন্মায় ভয় আর বিদ্বেষ। অন্যদিকে, শাশুড়িরা মনে করেন, পুত্রবধূ এলে সংসারের কর্তৃত্ব চলে যাবে বউয়ের হাতে। এই নিরাপত্তাহীনতা থেকে তারা ছেলের বউয়ের প্রতি কঠোর হন', যোগ করেন তিনি।

শুভাশীষ কুমার চ্যাটার্জি বলেন, 'পারস্পরিক বোঝাপড়া আর সহানুভূতি থাকলে বউ-শাশুড়ির অম্লমধুর সম্পর্কে মধুর ভাগ বাড়তে পারে। বউ-শাশুড়ি পরস্পরের পাশে থেকে সাহায্য করছেন, এমন উদাহরণও আছে অনেক।'

আরিফা একজন ই-কমার্স উদ্যোক্তা। বেশ সফলভাবে চলছে তার অনলাইন শপের কাজ। শুরুর দিকে শাশুড়ির ততটা সমর্থন না পেলেও পরে তিনি আরিফার কাজে উৎসাহ দিয়েছেন।

আরিফা বলেন, 'আমার শাশুড়ি একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। প্রথমে তিনি বিষয়টি নিয়ে আগ্রহী না থাকলেও আমার কঠোর পরিশ্রম আর ব্যবসার সফলতা দেখে তিনি আমাকে বিভিন্নভাবে উৎসাহ দিয়েছেন, পাশে থেকেছেন। এটি আমার চলার পথকে আরও মসৃণ করেছে।'

এদেশের সমাজ ব্যবস্থায়, বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্বকে বেশ স্বাভাবিকভাবে দেখা হয়। এই সমস্যাটি সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করলেও তেমন কোনো কার্যকরী  উদ্যোগ নেন না পরিবারের পুরুষ সদস্যরা।

এ ব্যাপারে মনোবিজ্ঞানী শুভাশীষ কুমার চ্যাটার্জি বলেন, 'বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্ব নিরসনে বাড়ির পুরুষদের ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকলেও তারা বিষয়টি এড়িয়ে যান। এক্ষেত্রে শ্বশুরের ভূমিকা হয় প্যাসিভ আর পুত্রের ভূমিকা হয় প্যাসিভ-এগ্রেসিভ।'

বউ-শাশুড়ির চিরায়ত দ্বন্দ্ব নিরসনে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন তিনি-

  • পরিবার একটি বাগানের মতো, যা সতেজ ও সুন্দর থাকতে পারে যখন পরিবারের সদস্যরা সম্পর্কের প্রতি যত্নবান হবেন। পুত্রবধূর ভুলে গেলে চলবে না, পরিবারে শাশুড়ি গুরুজন। তাই তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রাখা জরুরি।
  • অন্যদিকে শাশুড়িকে মনে রাখতে হবে, একটি ভিন্ন পরিবার থেকে তার ছেলের বউ এই বাসায় এসেছেন। তাকে এই পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় দিতে হবে, কোনো ভুলত্রুটি হলে রেগে না গিয়ে বুঝিয়ে বলতে হবে।
  • অন্য পরিবারের সঙ্গে নিজের পরিবারের তুলনা করা যাবে না। কার বাড়ির বউ কী করল, কোন শাশুড়ি কাকে কী দিলো এসব তুলনায় যাওয়া চলবে না।
  • মানুষ প্রশংসা পেতে পছন্দ করে। তাই ছেলের বউ আর শাশুড়ির মধ্যে ভালো কাজের প্রশংসা আর গঠনমূলক সমালোচনার চর্চা থাকলে দুজনের সম্পর্ক সুন্দর হয়।
  • এ দ্বন্দ্ব নিরসনে বাড়ির পুরুষ সদস্যদেরও এগিয়ে আসতে হবে। রাগারাগি বা তর্কাতর্কি নয়, পারস্পরিক আলোচনা আর সমঝোতার মাধ্যমে সম্পর্কের বোঝাপড়া বাড়ানো সম্ভব।
  • প্রয়োজনবোধে, পরিবারের সদস্যদের কাউন্সিলিং করানো যেতে পারে। যেহেতু বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্বকে এদেশে স্বাভাবিক ভাবা হয়, তাই এ ব্যাপারে কমিউনিটি বেজড সচেতনতা তৈরি করা খুব প্রয়োজন।

Comments

The Daily Star  | English

Wave of attacks targets houses, businesses of AL leaders

Demolition work on Dhanmondi-32 was on going till filing of this report at 1:30am

27m ago