শিশুকে কি স্মার্টফোন থেকে দূরে রাখা সম্ভব, কী হবে বাবা-মায়ের ভূমিকা
আজকালকার শিশুরা আগের চেয়ে অনেক এগিয়ে, এ কথা পূর্ববর্তী প্রজন্মের অনেকেই বলে থাকেন। এ বলার পেছনে থাকে কখনো গর্ব, আবার কখনো কিছুটা আক্ষেপ। আক্ষেপের একটা কারণ হয়তো অনেক কম বয়সে প্রযুক্তির সঙ্গে অতি মেলামেশার বিষয়টি। দুনিয়ার সঙ্গে হালনাগাদ হলেও এতে বেড়ে উঠার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যে বিঘ্ন ঘটে, তা তো অস্বীকারের উপায় নেই।
সে বিষয়ে আলাপ হয়েছিল ন্যাশনাল মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট এইড প্রশিক্ষক ও ঢাকার ডিপিএস এসটিএস স্কুলের সাইকোলজিস্ট পরমা প্রীতি মল্লিকের সঙ্গে।
শিশুকে স্মার্টফোন থেকে দূরে রাখা কি আদৌ সম্ভব?
এমন প্রশ্নও মনে আসা অস্বাভাবিক নয় দিন দিন আরও সমৃদ্ধ হতে থাকা এই ডিজিটাল বিশ্বে। তবে এক্ষেত্রে প্রাথমিক যে চ্যালেঞ্জটি আসে, তা হচ্ছে অনেকে খেতে চায় না স্মার্টফোন ছাড়া। মোবাইল না দিয়ে তাহলে ওই সময় কীভাবে খাওয়াবেন বাবা-মা?
পরমা এ বিষয়ে বলেন, 'শিশুকে স্মার্টফোন থেকে দূরে রাখা অবশ্যই সম্ভব। তবে সেটা নির্ভর করবে তার বাবা-মা বা কেয়ারগিভার পর্যায়ের ব্যক্তিদের ওপর। আমাদেরকে ব্যাপারটার মূলে ফেরত গিয়ে জানতে হবে যে কীভাবে শিশুটি মোবাইল দেখে খেতে অভ্যস্ত হয়েছিল।
অর্থাৎ কার্যের কারণে গিয়ে আমাদের এই বিষয়টির দিকে নজর দিতে হবে। এ ছাড়াও একটা জিনিস মাথায় রাখা দরকার যে, আমাদের সংস্কৃতিতে খাওয়ার সময়টা পারিবারিক বন্ধন আরও জোরদার করার জন্য উপযুক্ত সময়। বড়রাও কিন্তু অন্তত একবেলা একসঙ্গে খাওয়ার মাধ্যমে এই বিষয়টি মেনে চলেন। বাবা-মায়ের সঙ্গে শিশুর ''কোয়ালিটি টাইম'' কাটানোর জন্য এটি একটি ভালো সুযোগ। এ সময় গল্প বলাও ভালো চর্চা।'
অন্যথা হলে কী করা যায়, সে সমাধানও বাতলে দিয়েছেন এই মনোবিদ, 'তবে বাবা-মা অনেক বেশি ব্যস্ত থাকলে শিশুকে যদি এক বেলাও মোবাইল দিয়ে খাওয়াতে হয়, তাহলে অন্য কোনো সময় মোবাইল দেওয়া হবে না। ছোট থেকেই এ চর্চা তৈরি করতে হবে। শিশুকেও জানতে দিতে হবে যে, দুপুরে বাবা-মা বাইরে ছিলেন তাই তুমি মোবাইল/টিভি/ল্যাপটপ/ট্যাব/আইপ্যাড দেখে খেয়েছ। কিন্তু রাতে সবাই একসঙ্গে খাব।
শিশুর অভ্যাস বদল করতে চাইলে ওরা হয়তো প্রথমে কথা শুনবে না, সেক্ষেত্রে তাদেরকে একটু করে ''ইনসেনটিভ'' দেওয়া যায়। যেমন: ওরা যদি এক সপ্তাহ কোনো গ্যাজেট ছাড়াই রাতের খাবারটা পরিবারের অন্য সবার সঙ্গে খায় তাহলে ওদের কোথাও বেড়াতে নেওয়া হবে বা খেলনা কিনে দেওয়া হবে ইত্যাদি। কাজটা সহজ নয়। কিন্তু ধৈর্য ধরলে নিশ্চয়ই অসম্ভব কিছু হবে না।'
বিনোদন হিসেবে স্মার্টফোনের বিকল্প কী?
পরমা বলেন,'স্মার্টফোন থেকে দূরে রাখার জন্য বিকল্প কোনো অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। যদি ঢাকার কথাই বলি, এখানেও এখন নানা রকম অ্যাকটিভিটিসের জায়গা তৈরি হয়েছে। সপ্তাহান্তে বা বিকেলে কোনো ধরনের খেলাধুলা, আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটস, গানবাজনা, নাচ, নাটক, অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব এসবে শিশুদের ভর্তি করে দেওয়া যায়। এতে ওদের মধ্যকার যে চঞ্চলতা, তা ইতিবাচক একটা মাধ্যম পাবে। মস্তিষ্ক আরও সক্রিয় হবে, সেইসঙ্গে সামাজিকীকরণেরও উন্নতি ঘটবে। নিজস্ব একটা সার্কেল তৈরি হবে।'
বিনোদন মানে শুধুই স্মার্টফোন বা গ্যাজেট নয়
পরমা জানান, স্মার্টফোন বা অন্যান্য ডিজিটাল গ্যাজেটই যে বিনোদনের মাধ্যম নয়, এই ভাবনার চর্চা কথা ও কাজে শিশুদের সামনে প্রকাশ করতে হবে। সেজন্য তাদের সঙ্গে ঘরোয়া পরিসরেও বিভিন্ন খেলাধুলা যেমন পুরোনো দিনের আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে ঘিরে থাকা 'নাম-দেশ-ফুল-ফল', 'চোর-পুলিশ', 'ষোলগুটি', 'লুডু' ইত্যাদি খেলা যায়।
মেমোরি গেম বা বাজারে কিনতে পাওয়া যায় এমন কিছু বোর্ড গেমও ভালো পদ্ধতি। এতে একইসঙ্গে বড়দের মানসিক চাপমুক্তিও হবে, শিশুদের লালনপালনেও একটা সুস্থ ভারসাম্য বজায় থাকবে। শিশুরা পারিবারিক বন্ধনের ইতিবাচক দিকগুলো শিখবে, যা তাদের পরবর্তী জীবনে আত্মবিশ্বাসী ও বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।
স্ক্রিনটাইম ব্যবহারের সময়সীমা
বর্তমান যুগ ডিজিটাল যুগ আর এ যুগে মোবাইল না দেওয়াটা আবার অসম্ভব বলেও মনে হতে পারে অনেকের কাছে। সম্ভব হলে ২ বছর বয়স পর্যন্ত স্ক্রিনটাইম সাপ্তাহিক ১-২ ঘণ্টার মতো রাখা যেতে পারে, তবে আদতে সংখ্যাটা ০ হওয়াই উচিত। মনস্তাত্ত্বিক ও চিকিৎসাগত গবেষণারও সেই মতামত বলে জানান পরমা প্রীতি মল্লিক।
তিনি জানান, আরেকটু বড় শিশু হলেও এভাবেই স্ক্রিনটাইম বরাদ্দ করে দিতে হবে এবং এই বিষয়টি একটু আদর ও শাসনের মিশেলে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিনোদনের জন্য কোনোভাবেই ডিজিটাল পর্দার প্রতি নির্ভরতা যাতে তৈরি না হয়, সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।
বাবা-মায়ের ভূমিকা
এই আসক্তির পেছনে বাবা-মায়ের আচরণ কতটা ভূমিকা রাখে, সেদিকেও আলোকপাত করেছেন মনোবিদ পরমা।
তিনি বলেন, 'এই বিষয়টি অবশ্যই ভুলে যাওয়া চলবে না যে শিশুরা কখনো নিজে থেকে স্মার্টফোনের ব্যবহার জানবে না, ওরা আমাদের কাছ থেকেই শেখে। এটা তাদের ''পর্যবেক্ষণমূলক শিখনের'' একটা অংশ।
ষাটের দশকে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, শিশুরা সরাসরি পর্যবেক্ষণমূলক শিক্ষা থেকে আক্রমণাত্মক বা অ-আক্রমণাত্মক আচরণ শেখে। মা-বাবা ও পরিবারের বাকিদের সবার আচরণই শিশুরা সচেতন বা অবচেতনভাবে শিখতে থাকে। তাই আমরা যদি ওদের সামনে মোবাইল ফোন কম ব্যবহার করি, তাহলে ওরাও সেটাই শিখবে।'
করণীয় কী
অনেকেই এখন ব্যবসা বা অফিসের অনেক কাজ স্মার্টফোনে করে থাকেন। যদি বাবা-মার মোবাইলে ব্যস্ত থাকা শিশুর আসক্তির একটা কারণ হয়ে থাকে, কিন্তু বাবা-মাকে কাজের কারণে মোবাইলে ব্যস্ত থাকতে হয় অনেকটা সময়, তবে বাবা-মায়ের করণীয় কী হবে শিশুকে মোবাইল থেকে দূরে রাখতে?
পরমা জানান, শিশুকে অবশ্যই দিনে আলাদা কোয়ালিটি টাইম দিতে হবে। ওদের বোঝাতে হবে যে, মোবাইলটা বড়দের প্রয়োজনীয় ব্যবহারের জিনিস, এর বেশি কিছু নয়।
ডিজিটাল ডিভাইসের কাজের অংশটা বেশি জানতে দিতে হবে, বিনোদনেরটা নয়। যেমন তারা চাইলেই স্কুলের কোনো প্রজেক্টের জন্য গ্যাজেট ব্যবহার করতে পারে কিন্তু অবসর সময় কাটানোর জন্য নয়, এই চিন্তাটি মাথায় গেঁথে দিতে হবে। অবসরের জন্য তাদের কাছে খুলে দিতে হবে সৃজনশীলতার মুক্ত দুয়ার।
বিষয়টি চ্যালেঞ্জ মনে হলেও পরমা মনে করেন, একটু ধৈর্য ধরতে পারলেই ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব।
তিনি বলেন, 'ছোট থেকে শিশুদের শেখানো হয় যে কীভাবে খেতে হয়, কাপড় পরতে হয়, হাত ধুতে হয়, লেখাপড়া করতে হয়– একইভাবে স্মার্টফোনের বদলে বিকল্প বিনোদন বা মস্তিষ্কচর্চার কাজগুলোও একটু ধরে ধরে শেখাতে হবে। সামান্য ধৈর্য ধরে এগোলে এই ''এপিডেমিক'' পরবর্তী জীবনে মোকাবিলা করতে হবে না।'
Comments