বিলুপ্তপ্রায় সার্কাসের রুদ্ধশ্বাস ঝলক

ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

'হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো পঞ্চাশের যুগে ঢাকার বুকে প্রমোদ ভেলায় চেপে এসেছিল মাদ্রাজ তথা ভারতবর্ষ থেকে বিখ্যাত কমলা সার্কাস তাদের বিপুল বহর নিয়ে।...পল্টনজুড়ে কমলা সার্কাসের বহর আঁট হয়ে ঘাঁটি গাড়ল। যেন বা এক সার্কাস নগর, ছোট ছোট তাঁবুর ঘর, তাতে সার্কাসের খেলোয়াড় ও কর্মী বাহিনীর সংসার। সারিবদ্ধ বড় বড় খাঁচা, পশুরাজ সিংহ, বেড়াল মামা, বাঘ মশাই, মক্ষী-প্রেমী ভালুক, রামসখা বানর-বিরস নয়নে অরণ্য ধ্যানে মগ্ন।'

সম্পাদক-সাহিত্যিক মীজানুর রহমান তার 'ঢাকা পুরাণ' গ্রন্থে ঢাকায় প্রথম কোনো সার্কাস দলের আগমন এবং তাদের বিচিত্র ও রুদ্ধশ্বাস সব ক্রিয়াকাণ্ডের চিত্রকল্প এঁকেছিলেন ঠিক এভাবেই।

ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

সার্কাস দেখেনটি বা নাম শোনেননি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। বাংলার লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী বিনোদন মাধ্যমগুলোর একটি হলো এই সার্কাস, যা বহু আগে থেকেই এ দেশীয় জনসাধারণের চিত্তবিনোদনের খোরাক জোগানোর পাশাপাশি লোকজীবনের সৃজন ও মননচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে এসেছে।

ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

লোকসংস্কৃতি গবেষক সাইমন জাকারিয়া বলছেন, বাংলাদেশে সার্কাসের দলগুলো হয় মূলত পরিবারকেন্দ্রিক। একজন মূল মালিক থাকেন। তার পরিবার, জ্ঞাতিগোষ্ঠীদের নিয়েই দল গড়ে ওঠে। একটি দলে ১০০–১৫০ জন লোক থাকে। অনেক বড় তাঁবু ফেলতে হয়, অনেক সরঞ্জাম আনতে হয়। বিশালাকার গ্যালারিও নিজেদেরই বসাতে হয়। এ জন্য অনেক লোক, অনেক শ্রমের প্রয়োজন হয়। আর সার্কাসের উপযোগী বড় ও স্থায়ী মাঠের দরকার হয়। আর ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন স্থানে সার্কাসের আয়োজন করতে হলে একটি স্থানে অন্তত ১৫ দিন প্রদর্শনী না করলে লোকসান হয়। ঢাকায় এখন আর তেমন মাঠ নেই। মফস্বলের জেলাগুলোতেও ইদানীং লম্বা সময় ধরে তেমন কোনো মেলার আয়োজন হয় না। আবার শুধু লোকবল হলেই চলে না, সার্কাসের জন্য হাতি, বাঘসহ নানা রকম প্রাণীও প্রয়োজন। এসব প্রাণী রাখার অনুমোদন পাওয়া যায় না। এসব কারণেই সার্কাস প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।

ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

বাংলাদেশের সার্কাস দলগুলোর মধ্যে একসময় বিখ্যাত ছিল বরিশালের লক্ষণ দাসের রয়েল বেঙ্গল সার্কাস। তিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। পরে তার ছেলেরা সোনার বাংলা সার্কাস নাম দিয়ে দলটি চালু করেছিলেন। খুব জনপ্রিয় হয়েছিল এই দলটি। এ ছাড়া সেভেন স্টার সার্কাস, দি রওশন সার্কাস, দি ক্যাপিটাল সার্কাস, দি লায়ন সার্কাস—এই দলগুলোও একসময় সারা দেশে ঘুরে ঘুরে সার্কাস করেছে।

ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

আবার অবিভক্ত ভারতে জাতীয়তাবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত প্রিয়নাথ বসুর 'গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস' স্বদেশি আন্দোলনের সময় অনেকের গর্বের বিষয় হয়ে উঠেছিল।

সার্কাসের সেই সুদিন আর নেই। বাংলাদেশে মুক্তবাজার অর্থনীতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিনোদনের ধরন ও রুচির পরিবর্তন, আয়োজনে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবসহ বিবিধ কারণে খুবই জনপ্রিয় এই সাংস্কৃতিক মাধ্যমটির নিয়মিত কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে।

ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

এরপরেও সার্কাসের একটি-দুটি দল বছরভর দেশের বিভিন্ন জায়গায় খেলা দেখিয়ে যাচ্ছে। তেমন একটি দল হলো 'দ্য নিউ জনি সার্কাস'। সম্প্রতি দলটি তাঁবু ফেলেছে খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার জলমা ইউনিয়নের কাজীবাছা ও শোলমারী নদীর মোহনার কাছাকাছি জায়গায়।

ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

অতীত গৌরবের সেই ঝলক কিছুটা হলেও ফিরিয়ে আনা দ্য নিউ জনি সার্কাসের রুদ্ধশ্বাস একটি শো থেকে ছবিগুলো তুলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের আলোকচিত্রী হাবিবুর রহমান।  

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh bank reform plan 2025

Inside the 3-year plan to fix banks

Bangladesh has committed to a sweeping overhaul of its troubled financial sector, outlining a detailed three-year roadmap as part of its latest agreement with the International Monetary Fund.

11h ago