সাংবাদিককে পিটিয়ে হত্যা ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’?

জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলায় সাংবাদিক গোলাম রব্বানি নাদিমকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাকে 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা' বলে দাবি করেছেন জেলার পুলিশ সুপার নাছির উদ্দিন আহমেদ।

শুধু তাই নয়, তিনি বলেছেন, নাদিমকে আঘাত করা হয়েছে মেরে ফেলার জন্য নয়, সতর্ক করার জন্য।

এখানে প্রশ্ন দুটি—

১. পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে একজন সাংবাদিককে তার চলন্ত মোটরসাইকেল থামিয়ে এলোপাতাড়ি মারধর করে মেরে ফেলার ঘটনাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কী করে 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা' বলে দাবি করলেন—যেখানে ওই সাংবাদিক দীর্ঘদিন ধরে প্রাণনাশের হুমকি পেয়ে আসছিলেন? শুধু তাই নয়, তিনি নিজের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ফেসবুকে ভিডিও বার্তাও দিয়েছিলেন। তার মানে, হঠাৎ করে তার ওপর হামলা হয়েছে, বিষয়টি এমন নয়।

তাছাড়া সাংবাদিক নাদিম জামালপুরের বেশ পরিচিত মুখ ছিলেন। তার ওপর কী ধরনের প্রাণনাশের হুমকি ছিল, সেটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর না জানার কোনো কারণ নেই। অথচ, জেলা পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তা বলে দিলেন, এটি 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা'।

২. পুলিশ সুপার কী করে জানলেন বা নিশ্চিত হলেন যে হত্যা করার উদ্দেশ্যে নাদিমকে মারা হয়নি? হামলাকারীরা কি তাকে জানিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়েছিল, না কি তার সঙ্গে পরামর্শ করেছিল? তিনি কী করে বললেন যে এই হামলার উদ্দেশ্য হত্যা করা নয়? যেখানে সিসি ক্যামেরার ফুটেজে এটি স্পষ্ট যে তার ওপর মারমুখী আক্রমণ হয়েছে এবং প্রত্যক্ষদর্শীও বলছেন যে নাদিমের মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। কারো মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করা হয় সতর্ক করার জন্য, নাকি মেরে ফেলার জন্য?

সাংবাদিক নাদিম ৭১ টেলিভিশনের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন। সেই টেলিভিশনের একটি লাইভ অনুষ্ঠানে পুলিশ সুপার দাবি করেছে, জামালপুরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই ভালো। কিন্তু নাদিমের হত্যার ঘটনাকে তিনি 'বিচ্ছিন্ন' বলে দাবি করলে অনুষ্ঠানের অতিথি সিনিয়র সাংবাদিক ও ডিবিসির সম্পাদক প্রণব সাহা তাকে প্রশ্ন করেন, এরকম একটি ঘটনাকে তিনি কী করে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দাবি করলেন?

পুলিশ সুপার তার খুব স্পষ্ট জবাব দিতে পারেননি। এমতাবস্থায় গত ১৬ জুন পুলিশ সুপারের এই বক্তব্য প্রত্যাহার এবং সাংবাদিকদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছে জামালপুর অনলাইন জার্নালিস্ট নেটওয়ার্ক।

কীভাবে নাদিমকে খুন করা হলো?

নাদিম হত্যার ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন তার সহকর্মী ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আল মুজাহিদ। তার ভাষ্য, ঘটনার দিন ১৪ জুন বুধবার রাত সোয়া ১০টার দিকে তিনি গোলাম রব্বানির সঙ্গে উপজেলার পাটহাটি মোড় দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। দুজনকে আলাদা দুটি মোটরসাইকেলে করে যেতে সিসিটিভির ফুটেজেও দেখা গেছে।

একটি বাইকে থাকা সাংবাদিক নাদিমকে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে পেটাতে পেটাতে সিসিটিভির আওতার বাইরে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। এরপরের ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা দিয়েছেন আল মুজাহিদ। তিনি বলেন, সন্ত্রাসীরা প্রথমে ব্যস্ততম এলাকায় চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে টেনেহিঁচড়ে নাদিমকে নামায়। তাকে উপর্যুপরি কিল-ঘুষি দিতে দিতে অন্ধকার টিঅ্যান্ডটি সড়কে নিয়ে যায়। সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিল আরও ১৫–২০ জন। সবাই মিলে যে যেভাবে পারছিল রব্বানিকে পেটাচ্ছিল। আর দূর থেকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন মূল অভিযুক্ত সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নেতা মাহমুদুল আলম ওরফে বাবু।

একপর্যায়ে কেউ একজন লাথি মেরে পাশে থাকা একটি দেয়ালের ইট ভাঙে। চেয়ারম্যানের ছেলে সেই ইট হাতে নিয়ে রব্বানিকে আঘাত করে। এ সময় নাদিম বাঁচার জন্য কাকুতি-মিনতি করছিলেন। তবু তাকে নির্মমভাবে মারছিল তারা। একপর্যায়ে মৃত ভেবে তাকে ফেলে সবাই চলে যায়। রব্বানির স্বজন ও সুহৃদরা জানাচ্ছেন, সংবাদ প্রকাশকে কেন্দ্র করে সাংবাদিক গোলাম রব্বানির ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম ওরফে বাবু। বিভিন্ন সময় তিনি নাদিমকে হুমকিও দিয়েছেন।

সাংবাদিক নাদিমের হত্যার ঘটনায় কয়েকটি মৌলিক প্রশ্ন সামনে আসছে:

১. গোলাম রব্বানি নাদিম কাজ করতেন দেশের দুটি প্রভাবশালী গণমাধ্যমের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে। একটি ৭১ টেলিভিশন, আরেকটি বাংলা নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম—যেটির মালিকানা প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপ।

প্রশ্ন হলো, নাদিম যদি এরকম কোনো প্রভাবশালী গণমাধ্যমের প্রতিনিধি না হয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট পত্রিকা বা স্থানীয় কোনো পত্রিকার সাংবাদিক হতেন এবং একইভাবে মারধরের শিকার হয়ে নিহত হতেন, তাহলে দেশের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কী প্রতিক্রিয়া হতো? টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এই বিষয়টি নিয়ে লাইভ অনুষ্ঠান কিংবা পত্রিকাগুলো বড় আকারে সংবাদ পরিবেশন করতো? যেহেতু নাদিমকে হত্যা করা হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতার নির্দেশে, সুতরাং তিনি যদি সরকারের সমালোচক হিসেবে পরিচিত কোনো গণমাধ্যমের সাংবাদিক হতেন, তখন কি একইরকম প্রতিক্রিয়া দেখা যেতো?

২. সিটি ক্যামেরার ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, নাদিমের ওপর আক্রমণ হয়েছে এবং সেই ছবি দেখেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেশ কয়েকজনে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু সিসি ক্যামেরায় যদি এই ঘটনা ধরা না পড়তো, তাহলে কি অপরাধীরা ধরা পড়তো বা যেহেতু অপরাধীরা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং মূল অভিযুক্ত একজন জনপ্রতিনিধি—ফলে ক্যামেরায় ধরা না পড়লে কি আদৌ তাদের অভিযুক্ত করা সম্ভব হতো বা তাৎক্ষণিকভাবে তাদের ধরা হতো?

৩. সিসি ক্যামেরার ফুটেজ আছে এবং নিহত ব্যক্তি দুটি প্রভাবশালী গণমাধ্যমের কর্মী ছিলেন বলে স্থানীয় এবং জাতীয়ভাবেও এর দারুণ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। সেই প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসেবেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে অপরাধীরা ধরা পড়েছে। আশা করা যায় এই হত্যাকাণ্ডের বিচারও তুলনামূলকভাবে দ্রুতই সম্পন্ন হবে এবং অপরাধীরা সর্বোচ্চ শাস্তি পাবে। কেননা হত্যার প্রধান প্রমাণ ভিডিও ফুটেজ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যদি ভিডিও ফুটেজ না থাকতো, তাহলে কী হতো? যেসব ঘটনায় ভিডিও ফুটেজ নেই; যেসব নিহত ব্যক্তির সামাজিক-রাজনৈতিক বা অন্য কোনো বড় পরিচয় নেই; ক্ষমতার সঙ্গে যার বা যাদের যোগসূত্র কম—সেরকম মানুষদের পরিবারগুলো কি স্বজন হত্যার ন্যায়বিচার পাচ্ছে?

নাদিম হত্যা কেন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়?

ক্ষমতাবানরা সব সময় সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ মনে করেন। কেননা তারা চান সাংবাদিকরা তাদের মতো করে লিখবেন, তাদের মতো করে বলবেন। কিন্তু যখনই এতে ব্যত্যয় ঘটে, তখনই তারা সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ বা শত্রু ভাবতে থাকেন। নাদিমও ঠিক একই কারণে ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর টার্গেটে পরিণত হয়েছেন।

অর্থাৎ যারা নিজেদের অন্যায় আড়াল করতে চান, যারা অপরাধী, তারাই সাংবাদিককে ভয় পান বা প্রতিপক্ষ ভাবেন। কারণ একজন সরকারি কর্মকর্তা, একজন পুলিশ, একজন ঠিকাদার এবং অন্য যেকোনো পেশার একজন মানুষ যখন অন্যায় করেন, সেই অন্যায়টি অন্য পেশার একজন মানুষ দেখে ফেললে বা জেনে গেলে সেটি যত না ঝুঁকি তৈরি করে, একজন সৎ সাংবাদিক জেনে গেলে সেই ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যায়। কারণ একজন সৎ সাংবাদিককে টাকা দিয়ে কেনা যায় না। ফলে তিনি অন্যায়টি প্রকাশ ও প্রচার করে দেন। অপরাধীদের ভয় এখানেই। এটা ওপেন সিক্রেট যে, যেকোনো পেশার অসৎ লোকেরা সাংবাদিক ছাড়া কাউকে ভয় পান না বা তোয়াজ করেন না। ফলে সুযোগ পেলেই তারা সাংবাদিকের ওপর চড়াও হন। ক্ষমতাবানরা জানেন, তাদের অন্যায় কাজগুলো দেশের মানুষ শুধু এই সাংবাদিকদের কারণেই জানতে পারেন। ফলে গণমাধ্যমকে সব সময়ই তারা শত্রু গণ্য করেন।

অতএব প্রতিনিয়ত ঝুঁকির মধ্যে থাকা একজন সাংবাদিকের খুন হওয়া কোনো অর্থেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং এটি বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত গণমাধ্যমের ওপর চলে আসা চাপ বা গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণেরই ধারাবাহিকতা। প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে অন্য আরও অনেক ঘটনার যোগসূত্র থাকে। 

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments