যেভাবে গণঅভ্যুত্থানের নায়ক হয়ে উঠলেন শহীদ আসাদ
পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বটতলায় সংক্ষিপ্ত সভা শেষে ছাত্রদেরকে নিয়ে ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল নিয়ে যাচ্ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ঢাকা হল ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি আমানুল্লাহ মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান আসাদ।
প্রথমে পুলিশ তাদের বাধা দেয় এবং ফিরে যেতে বলে। কিন্তু, তাতে বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়েই আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে বিক্ষোভকারী ছাত্ররা 'আইয়ুব শাহীর গদিতে, আগুন জ্বালাও এক সাথে'সহ নানান স্লোগান দিতে দিতে চানখাঁরপুলের দিকে এগিয়ে যান।
মিছিলটি যখন চানখাঁরপুলের কাছাকাছি আসে তখন পুলিশ হামলা চালায়। সেসময় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের প্রায় ঘণ্টাখানেক সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে আসাদুজ্জামানসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রনেতা ঢাকা হলের পাশ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল পাদদেশে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলে আসাদুজ্জামান আসাদকে লক্ষ্য করে গাড়ি থেকে রিভলভারের গুলি ছোঁড়েন পুলিশের এক কর্মকর্তা।
গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তখনই লুটিয়ে পড়েন আসাদ। গুরুতর আহত অবস্থায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ও কৃষক আন্দোলনের সংগঠক আসাদুজ্জামান আসাদের শহীদ হওয়ার সংবাদ পেয়ে ছাত্রসমাজ চরম ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে। তার রক্তমাখা শার্ট হয়ে উঠে মুক্তির নিশানা। শহীদ আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে পরদিন ঢাকায় বের হয় শোক মিছিল। বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতা ছুটে যান মোহাম্মদপুরের 'আইয়ুব গেট'র সামনে।
প্রতিবাদের ক্ষুব্ধ প্রতীক হিসেবে 'আইয়ুব গেট'র নামফলক গুঁড়িয়ে দিয়ে রক্ত দিয়ে সেখানে লেখা হয় 'আসাদ গেট'। আসাদের শহীদ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশব্যাপী গড়ে উঠে অবিস্মরণীয় গণজাগরণ। সারাদেশে তখন একটিই স্লোগান, 'আসাদের মৃত্যু বৃথা যেতে দেব না।'
আসাদের এক রক্তমাখা শার্টেই যেন খুঁজে পাওয়া গেল মুক্তির পথ। মিছিলে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো হাজারো মানুষের গর্জন।
আসাদের মৃত্যুর পর ২৪ জানুয়ারি হরতালে পুলিশ আবারও জনতার মিছিলে গুলি চালায়। সেদিন শহীদ হন রুস্তম আলী ও স্কুলশিক্ষার্থী মতিয়ুর রহমান। এরপর আইয়ুব পতনের আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে।
আসাদের মৃত্যুর ফলশ্রুতিতে সামরিক প্রশাসক আইয়ুব খানের সরকার ২ মাসের জন্য ১৪৪ ধারা আইনপ্রয়োগ স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়।
১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. শামসুজ্জোহা হত্যাকাণ্ডের ফলে শেষ পর্যন্ত ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ও আগরতলা মামলায় অভিযুক্তদের মুক্তি দেওয়া হয়।
অবশেষে সে বছর ২৫ মার্চ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন আইয়ুব খান।
যেভাবে সৃষ্টি হয়েছিল অভ্যুত্থানের পথ
গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটের প্রস্তুতি পর্বের সূচনা হয়েছিল ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে। সে বছরের ৬ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানের জনসমাবেশে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী গভর্নর হাউস ঘেরাওয়ের ডাক দেন। সেসময়ে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন আইয়ুব খানের একনিষ্ঠ চর মোনায়েম খান।
পল্টনের সেই জনসভা থেকে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গভর্নর হাউস ঘেরাও করা হয়। এরপর মওলানা ভাসানী ৭ ডিসেম্বর সর্বাত্মক হরতালের ডাক দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে সেই হরতাল সর্বাত্মকভাবে পালিত হয়েছিল।
৭ ডিসেম্বর ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। বেশ কয়েকজন ছাত্র গুরুতর আহত হন। তাই ৮ ডিসেম্বরও সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। দোকানপাট থেকে হাট-বাজার, কল-কারখানা সর্বত্রই ছিল চূড়ান্ত ধর্মঘট। যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সমগ্র দেশ।
হরতালের পর মওলানা ভাসানী ঘোষণা দেন, শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া না হলে বাস্তিল দুর্গের মতো সেনানিবাস ভেঙে মুক্ত করা হবে মুজিবকে। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য বেশ কয়েকটি অঞ্চলে হরতালের ডাক দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী ২৯ ডিসেম্বর হরতাল পালিত হয়।
আইয়ুব খানের পেটোয়া বাহিনী ও পুলিশ নড়াইল ও নরসিংদীর হাতিরদিয়া বাজারে গুলি করে নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন আসাদুজ্জামান আসাদ। পুলিশের লাঠির আঘাতে তার মাথা ফেটে যায়।
দ্রুত সংবাদ পাঠানোর কোনো ব্যবস্থা না থাকায় হাতিরদিয়ায় পুলিশের গুলিতে আন্দোলনকারীদের শহীদ হওয়ার সংবাদ পৌঁছানোর ক্ষেত্রে কী করা যেতে পারে এর উপায় পাওয়া যাচ্ছিল না। সেই পরিস্থিতিতে আসাদ নিজেই পুলিশের লাঠির আঘাতে আহতাবস্থায় ও মিছিলে গুলির সংবাদ পৌঁছে দিতে সাইকেলে চেপে ঢাকায় আসেন। তখন তার মাথা ছিল ব্যান্ডেজে মোড়ানো।
প্রখ্যাত সাংবাদিক ও রাজনীতিক নির্মল সেন তখন চাকরি করতেন দৈনিক পাকিস্তানে। আসাদ নির্মল সেনের কাছে সংবাদটি পৌঁছে দিলেন। আসাদের শহীদ হওয়ার পর নির্মল সেন লিখেছিলেন, 'সেদিন আসাদ এসেছিল খবর দিতে, আজ এল খবর হয়ে।'
এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে একপর্যায়ে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া ও মেনন গ্রুপ)।
ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপেই ছিলেন আসাদুজ্জামান আসাদ। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে আরও ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ৮ নেতা।
১৪ জানুয়ারিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ থেকে ঘোষিত ১১ দফা কর্মসূচি ছিল তেমনই এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। এই কর্মসূচির মধ্যে ঐতিহাসিক ৬ দফা ছিল সংযুক্ত। বাকি ৫ দফা ছিল ছাত্র সমাজের দাবি নিয়ে। দেশব্যাপী এই কর্মসূচি আলোড়ন সৃষ্টি করে। এটি জোরদারের লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালের ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
সেদিন ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল বের করায় পুলিশ ছাত্রদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালায়। এর প্রতিবাদে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে আহ্বানে ডাকা হয় ছাত্র ধর্মঘট। ১৮ জানুয়ারি পালিত হয় এই ধর্মঘট।
তখনই পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। তখন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আটক ছাত্রদের অতিসত্বর মুক্তি ও ১১ দফা বাস্তবায়নের জন্য ২০ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক ধর্মঘটের ডাক দেয়।
আসাদের পুরো নাম আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। তার জন্ম ১৯৪২ সালের ১০ জুন নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার ধানুয়া গ্রামে। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এমএ শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী।
বাংলা সাহিত্যে শহীদ আসাদ
শহীদ আসাদকে নিয়ে বাংলায় আছে অসংখ্য লেখা। আছে কবিতা। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা শামসুর রাহমানের 'আসাদের শার্ট'। তিনি এ কবিতায় শহীদ আসাদের শার্টকে দেখেছেন 'আমাদের প্রাণের পতাকা' হিসেবে। শার্টের বোতামকে উপমা দিয়েছেন নক্ষত্রের মতো বলে। শামসুর রাহমান লিখেছেন—
'গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।
বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে
নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো
হৃদয়ের সোনালী তন্তুর সূক্ষতায়
বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট
উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে।
ডালীম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর- শেভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি-চূড়োয়
গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম
আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,
চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা'
কবি হেলাল হাফিজ 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়'তে গণঅভ্যুত্থান নিয়ে লিখলেন—
'এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
মিছিলের সব হাত
কণ্ঠ
পা এক নয়।'
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস 'চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসেও তুলে ধরেছেন শহীদ হওয়ার পর আসাদের শার্ট নিয়ে অবিস্মরণীয় মিছিলকে।
'আসাদের রক্ত- বৃথা যেতে দেবো না!' পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দেখতে চেষ্টা করে ওসমান, না হে, মিছিলের মাথা দ্যাখা যায় না। অনেক সামনে উঁচু একটা বাঁশের মাথায় উড়ে আসাদের রক্তমাখা শার্টের লাল ঝাণ্ডা। বাঁশের মাথায় এই শার্ট হলো দস্তিদারের হাতের লাল লন্ঠন। নদীর জাহাজ নয়, নদীই আজ ছুটতে শুরু করেছে দস্তিদারের লাল লন্ঠনের পেছনে। এই পাগলপারা জলোস্রোতকে আজ সামলায় কে?'
আহমদ ছফা 'ওঙ্কার' উপন্যাসেও তুলে এনেছেন আসাদের শার্ট নিয়ে সমুদ্রের গর্জনের মতো ধাবিত হওয়া সেই মিছিলকে।
আজ শহীদ আসাদের ৮১তম জন্মবার্ষিকী। গণতান্ত্রিক সংগ্রামে ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে শহীদ আসাদ থাকবেন অবিস্মরণীয় পথিকৃৎ হয়ে। জন্মদিবসে তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
সূত্র: শহীদ আসাদ/ হায়দার আকবর খান রনো
আসাদ থেকে গণঅভ্যুত্থান/ মোস্তফা কামাল
Comments