বইয়ের জগতে বাজেটের প্রভাব
শিক্ষার্থী হিসেবে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে যাই ফিল্ডে। সেখানে কথার প্রসঙ্গে একজন ব্যবসায়ী প্রশ্ন করলেন, 'প্রতি বছর যে সরকার বাজেট না কী যেন দেয়, ওটার পরপরই অনেক কিছুর দাম বেড়ে যায়। তাইলে ওইটা দেওয়ার দরকারটা কী?' তার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে থেমে যাই, কী দেব! আসলেই তো প্রতিবারের বাজেট নিয়েই পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ হয় গণমাধ্যমে। অথচ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে বাজেট যে শুধুই দাম বৃদ্ধির কারণ। এর জবাব কার কাছ থেকে পাবে?
চলতি বছর একুশে বইমেলা শেষে বাংলা একাডেমির দেওয়া তথ্যমতে, ২০২৩ মেলায় এসেছেন ৬৩ লাখ ৫৩ হাজার ৪৬৩ জন মানুষ। প্রায় কোটির কাছাকাছি মানুষ বইমেলায় এলেও বেশিরভাগ প্রকাশকেরই দাবি, তারা ব্যবসায়িকভাবে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। কাগজের দাম প্রায় দ্বিগুণ হওয়ার পাশাপাশি বইমেলায় সন্তোষজনক ব্যবসা করতে না পারা বইয়ের বাজারে বড়সড় প্রভাব ফেলেছে। ঠিক এই সময়ে বাজেট ঘোষণার পর বইয়ের জগতে এর প্রভাব কেমন হতে পারে?
লেখকেরা এখন আর কলম দিয়ে লেখেন না। টাইপরাইটারের যুগ পেরিয়ে কম্পিউটারে করেন লেখালেখি। তবে প্রুফ দেখা থেকে শুরু করে হিসেবসহ বইয়ের বাজারে কলমের চাহিদা আছে। এবারের বাজেটে বাড়ছে কলমের দাম। বইয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত যে কোন কিছুর দাম বৃদ্ধি হলে এর প্রভাব পড়বে বইয়ে। এ বছর কাগজের দাম বাড়ায় বইয়ের দাম বেড়েছিল অনেক বেশি। কলমের দাম বাড়লে বইয়ের দামেও হেরফের হতে পারে।
দেশে বইয়ের পাঠকদের একটা বড় অংশ হলো শিক্ষার্থী। যাদের বেশিরভাগেরই নিজস্ব কোন আয় নেই। অভিভাবক থেকে নেয়া অর্থ জমিয়ে বই কিনেন। তাদের জন্য বইয়ের সামান্যতম মূল্য বৃদ্ধিও চাপ সৃষ্টি করে। তাছাড়া কলমের দাম বাড়লে বই কেনা ও কলম কেনা উভয় স্থানেই আগের চেয়ে বেশি অর্থ গুনতে হবে।
এবারের বাজেটে প্লাস্টিক পণ্যের উপর ভ্যাট ৫ শতাংশের পরিবর্তে ৭.৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। বই মুদ্রণের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ পেস্টিং করার সময় আগে পলিথিন ব্যবহার করা হতো। বই ছাপার জন্য ট্রেসিং পেপারের পৃষ্ঠাগুলিকে ফর্মা আকারে সাজানোকে বলে 'পেস্টিং'। তবে এখন আর পলিথিন বা প্লাস্টিকের প্রলেপ ব্যবহার করা হয় না। তবে প্রচ্ছদ লেমিনেটিং করার জন্য গ্লোসি পেপারের মত হালকা প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। বাজার সিন্ডিকেটের কারণে প্লাস্টিকের পণ্যের সঙ্গে সঙ্গে এরকম পলিথিনেরও দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাতিঘর প্রকাশনীর প্রকাশক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন বলেন, 'সরকার ১০ পয়সা বাড়ালে বাজারে সেটিকে ১ টাকা বাড়িয়ে দেয়া হয়। বাজারকে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণের আওতায় না আনলে, প্লাস্টিক পণ্যের উপর ভ্যাটের প্রভাব পড়বে বইয়ের বাজারে।'
তবে বহুদিন পর কম্পিউটারের দাম কমার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যা অন্যান্য শিল্পের মত বই শিল্পেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বড় প্রকাশনীগুলো বাদে বেশিরভাগ বইয়ের প্রকাশনীর কার্যালয়ে কম্পিউটার নেই। বাংলাবাজারের বিশেষ কিছু কম্পিউটারের সেবা দেয়া দোকানের উপর নির্ভর করছে শ'খানেক বইয়ের প্রকাশনী। করোনার সময়ে কম্পিউটারের চাহিদা তৈরি হলে দাম বেড়ে যায়। কিন্তু এবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কম্পিউটার, মডেম, সেটআপ বক্সসহ ২২ ইঞ্চি থেকে ছোট মনিটরকে ভ্যাট অব্যাহতির আওতায় আনা হয়েছে। এতে কম্পিউটার সংক্রান্ত জিনিসপত্রের দাম কমার সম্ভাবনা আছে।
এবারের বাজেটে ই-কমার্সের ডেলিভারি চার্জ কমানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এটিকে খুব সাধারণ ইস্যু মনে হলেও, বইয়ের বাজারে এর ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। গত কয়েক বছরে অনেকেই ই-কমার্স হিসেবে বই বিক্রিকে বেছে নিয়েছেন। বড় থেকে মাঝারি এমনকি স্বল্প বিনিয়োগের উদ্যোক্তারাও বইয়ের ব্যবসার দিকে ঝুঁকছে। সেখানে ডেলিভারি চার্জ বড় একটি বিষয়। অনেকসময় বইয়ের দামের চেয়ে ডেলিভারি চার্জ বেশি হয়। তাছাড়া ঢাকা ও ঢাকার বাইরের ডেলিভারির চার্জে বড় ধরনের হেরফের দেখা যায়। শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ এসব উদ্যোগের ভোক্তা হওয়ায়, চার্জ কমলে বই কেনার আগ্রহ বাড়বে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেও বইয়ের ই-কমার্স চালাচ্ছেন অনেকে। বর্তমানে শুধু ফেসবুক প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে প্রায় দুইশ বই বিক্রির উদ্যোগ রয়েছে। যারা দেশের বিভিন্ন স্থানে চাহিদা অনুযায়ী বই সরবারহ করছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগে ই-কমার্সে বড় একটি 'ফ্যাক্টর' হয়ে দাঁড়িয়েছে ডেলিভারি। নিজস্ব প্যাকেজিং ব্যবস্থা না থাকায় অনেক সময়ই ডেলিভারিকৃত বইটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অথচ ডেলিভারি চার্জ কমাতে পারছে না তারা। নিজস্ব ডেলিভারি সুবিধাও দেয়া সম্ভব না হওয়ায় বেশ সংকটে পড়েছে এই ধরনের উদ্যোক্তারা।
তবে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বাজেটে বাইসাইকেলের দাম বাড়ার কথা বলা হয়েছে। বাইসাইকেলের যন্ত্রাংশের আমদানি শুল্ক ১০ থেকে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছে। বেয়ারিং ও কব্জার দামও বাড়তে পারে। ডেলিভারি চার্জ কমলেও ডেলিভারি সাধারণত দেয়া হয় বাইসাইকেলে। ডেলিভারিতে অধিকাংশ ব্যক্তিই বাইসাইকেলে পণ্য আনা নেয়া করেন। বাইসাইকেল ও তার কলকব্জার দাম বাড়লে ই-কমার্স ডেলিভারি চার্জেও বাড়বে।
নিজস্ব বাইসাইকেল রয়েছে এমন অনেক শিক্ষার্থী ই-কমার্সের ডেলিভারির সঙ্গে যুক্ত। রাজধানীতে বসবাসকারী ই-কমার্স থেকে অর্ডার করা বইয়ের পাঠকেরা বেশিরভাগ সময়ই এক দিনের মধ্যে ডেলিভারি আশা করেন। তাদের চাহিদা রক্ষা করতে সাইকেলের দিকেও মনোযোগ দিতে হয়। বাইসাইকেলের যন্ত্রাংশের দাম বাড়লে এর প্রভাব যে বইয়ের জগতেও পড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রতি বছর বিশাল কলেবরে একুশে বইমেলা আয়োজন করা হলেও বইয়ের ব্যবসা নিয়ে রাষ্ট্রের আন্তরিকতা নেই বললেই চলে। বইয়ের সঙ্গে জড়িত আইনগুলোর কার্যকরণও প্রায় শূন্যের কোটায়। অহরহ পাইরেসি কিংবা বইয়ের বাজারের সিন্ডিকেট যেন সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার উপর ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বাজেট বইয়ের জগতে মিশ্র প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মহামারির পর পুরো অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে বইয়ের বাজার প্রসঙ্গ সবসময়ই উপেক্ষিত থেকেছে। প্রস্তাবিত বাজেটও বই প্রকাশ ও বিপণন নিয়ে নেই কোন ইতিবাচক চিন্তা...
প্রসঙ্গে সময় প্রকাশনের প্রকাশক ফরিদ আহমেদ বলেন, 'যারা বাজেট প্রণয়ন ও প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতরা সৃজনশীল বই নিয়ে তেমন একটা ভাবেন না। তাই জাতীয় বাজেট কখনই প্রকাশনা শিল্প বান্ধব হয় না। এতদিন ধরে কাগজের দাম বৃদ্ধির জটিলতা সমাধানেও কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি তারা।'
Comments