বিশেষ

সাংস্কৃতিক বাজেট বৃদ্ধি কেন জরুরি

আসছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। যেকোনো বাজেটই হলো সীমিত সম্পদ দিয়ে প্রয়োজনের চূড়ান্তসম্ভব অর্জনের পরিকল্পনা। আর বাজেটকে সুষ্ঠু করতে এই সম্পদের ভেতরে নির্ভরযোগ্য একটি সাধ্যাধীন প্রস্তাবনা দেওয়া হয়।

যেকোন দেশের বাজেটে– সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হয় মৌলিক প্রয়োজনকে। মৌলিক বিষয় নিশ্চিতের পর জাতীয় জীবনে যা গুরুত্বপূর্ণ সেখানে অগ্রাধিকার দিতে হয়। কেউ হয়তো দেয় শিল্পকে, কেউ আবার দেয় অন্য কিছুকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সামাজিক সুবিচার ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা ঐতিহ্য সংরক্ষণ, সংস্কৃতির চর্চা, মানবসম্পদ অর্জনে তরুণদের প্রশিক্ষণকে। অথচ তা বরাবরে উপেক্ষিত থাকছে। বছরের পর বছর যায় বাজেট আসে, কেউ ফিরে চায় না সাহিত্য সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের বিষয়টি। ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা দৃশ্যমান হচ্ছে ক্রমশ।

একটু স্থির হয়ে ভাবলে দেখব- সামাজিক সংকটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সংস্কৃতি চর্চা। আর সাংস্কৃতিক চর্চাই পারে মানবীয় গুণাবলির উৎকর্ষ সাধন করে দেশকে এগিয়ে নিতে। তারুণ্যের শক্তিকে যথাযথ স্থানে ব্যবহার করতে। মনে রাখতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা ছাড়া শিল্পকলার বিকাশ সম্ভব নয়। এর মধ্য দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো দীর্ঘস্থায়ী হয়। সমাজ টিকে থাকে সংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনে। এই বিষয়ে দেশের বাজেট প্রণয়নকারীদের আন্তরিকতা ও সচেতনতার দরকার অত্যন্ত বেশি।

হ্যাঁ, আমরা এটা জানি দেশের সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে হয়তো সব চাহিদার সবটুকু মেটানো সম্ভব নয়। তবে অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি সমাজ সুস্থ রাখার উপকরণ নিয়েও ভাবতে হবে। প্রসঙ্গত ২০২১-২২ অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, 'সরকার বাঙালি সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য, শিল্প, সংগীত, নাটক ইত্যাদি সুকুমার শিল্পের সৃজনশীল উন্নয়ন ও বিকাশে কাজ করে যাচ্ছে। দেশজ সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিকাশ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সমকালীন শিল্প-সাহিত্যের গবেষণা, প্রদর্শন, প্রকাশনা, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো চিহ্নিতকরণ, খনন, সংস্কার, সংরক্ষণ ও প্রদর্শন, সৃজনশীল সৃষ্টিকর্মের কপিরাইট সংরক্ষণসহ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উদযাপন, একুশে পদক প্রদান, বাংলা নববর্ষসহ জাতীয় দিবসগুলো উদযাপনে নিয়মিত অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে।' কিন্তু বাস্তবায়নে সংস্কৃতি খাতে সরকারের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে হতাশ হতে বাধ্য হন সংস্কৃতি কর্মী ও সংগঠকদের।

ফলে বাজেট প্রণয়ণ যাদের দায়িত্ব অর্থমন্ত্রী, সংসদসহ জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব, এই কাজে নিয়োজিত বিশেষজ্ঞ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিবিধ পর্যায়ের সচিব। তাদের সবার পর্যটন ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ব্যবস্থাপনায় চূড়ান্ত সম্ভব জ্ঞান, বোধ ও আন্তরিকতা দরকার। প্রয়োজন দেশ ও দশের প্রতি মমতা। মনে রাখতে হবে  সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিঃসন্দেহে আমাদের শক্তি। 

ফলে এই দেশের ক্ষেত্রে বাজেটটি হতে হবে সাংস্কৃতিক অগ্রাধিকার দিয়ে। ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছিল প্রগতিশীল ও সংস্কৃতিক রাষ্ট্র হিসেবে। অনেকগুলো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে  অর্জন হয় রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ত্ব। বিশেষত দেশভাগের পরে ভাষা আন্দোলন ও বিবিধ সংগ্রামের পথ ধরেই মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী আত্মত্যাগ ও সংগ্রামে আসে আমাদের বিজয়। প্রতিষ্ঠিত হয় সোনার বাংলাদেশ। সে সময় শক্তি হিসেবে প্রেরণা দেয় সাংস্কৃতিক মানুষজন। আজ সেই বিষয়টি উপেক্ষিত থাকলে আমাদের আগামী হবে অন্ধকার...

এটা মনে রেখে, ভাত কাপড় বাসস্থান স্বাস্থ্য আর শিক্ষার পরেই অগ্রাধিকার দিতে হবে ইতিহাস-ঐতিহ্য, মূল্যবোধ ও বাংলাভাষাসহ বিবিধ লোকজ সংস্কৃতির ধারন, রক্ষণ ও বিকাশের সকল উপায় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে। আবহমান বাংলার ঐতিহ্য, মূল্যবোধের ধারক-বাহক গ্রামীন লোকসংস্কৃতি মরমী গান, সারী-জারী, মুর্শিদী, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, পুঁথিপাঠ, কবিয়ালী-কাওয়ালী, খোদাবন্দনা ও না'ত সাহিত্য, পালাগান ও যাত্রা, বাউল গান, ঐতিহ্যবাহী খেলাধূলা ইত্যাদির সমর্থনে বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি। সঙ্গে মফস্বলের লোকশিক্ষামূলক যে পাঠাভ্যাস ও গণ মানুষের পাঠাগার আন্দোলন এবং অন্যান্য তৃণমূল আন্দোলন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আবার দেখা যায় নিবেদিত সংস্কৃতিকর্মীকে রাজনৈতিক নেতারা ব্যবহার করেও সঙ্কটে পাশে থাকেন না। যা খুবই দুঃখজনক।  

চিন্তা–চেতনাশক্তি ও সময় বিবেচনায় সাংস্কৃতিক বাজেটের বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। এটা কেবল শহরে শিল্পকলার বরাদ্দ নয় বরং গ্রামগঞ্জেও ব্যাপকভাবে যেন হয়। সংস্কৃতির বিকাশের সকল উপায়- ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগকে কাছে নিতে হবে। অবশ্যই তৃণমূল পর্যায়ে যাতে সংস্কৃতিচর্চাটা বাড়ে, সে জন্য বরাদ্ধ যথাযথভাবে পৌঁছানোর জন্য নজর দিতে হবে। মাথায় নিতে হবে- রাষ্ট্রের বহুমাত্রিক সঙ্কটে দেশব্যাপী সংস্কৃতির জাগরণ দেহের রক্তের মতো উপকারী। তাই সবর্ত্র সাংস্কৃতিক সংগঠন কিংবা ব্যক্তি উদ্যাগকেও দিতে হবে প্রণোদনা। আত্মপরিচয়ের দাবীপূরণে ও বিশ্বজনীন সুনাম বৃদ্ধিতে মোট বাজেটের কমপক্ষে ১ শতাংশ সংস্কৃতি ক্ষেত্রে দেওয়া উচিত। 

ঢাকা ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক।

Comments

The Daily Star  | English

Tax-free income limit may rise to Tk 3.75 lakh

The government is planning a series of measures in the upcoming national budget to alleviate the tax pressure on individuals and businesses, including raising the tax-free income threshold and relaxing certain compliance requirements.

12h ago