বজ্রপাতে মৃত্যু: প্রতিরোধের উপায় আছে, উদ্যোগ নেই

বজ্রপাত
ছবি: হুমায়েদ উল্লাহ

চলতি বছরের বর্ষা পূর্ববর্তী মৌসুমে বজ্রপাতে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মৃত্যুর খবর আসছে।

গত মঙ্গলবার দেশের ১০ জেলায় বজ্রপাতে ১৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে নরসিংদীতে ৪ জন, পাবনা ও কুড়িগ্রামে ২ জন করে এবং সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, পটুয়াখালী, নওগাঁ, নেত্রকোণা ও চাঁদপুরে ১ জন করে মারা গেছেন।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতে ২১৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবহাওয়ার ধরন বদলে যাওয়া, বজ্রপাত বেড়ে যাওয়া, বড় গাছ কেটে ফেলার কারণে বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়ছে।

এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও পর্যাপ্ত উদ্যোগ নিয়ে এই মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব বলছেন তারা।

বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর কারণ, প্রতিকার ও সচেতনতা তৈরিতে কী করা যায় এ নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ ফারুখ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমানের সঙ্গে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ ফারুখ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের দেশে বজ্রপাতে প্রতি বছর গড়ে ৩২০ জনের মৃত্যু হয়। যেটা পৃথিবীর যে কোনো দেশের তুলনায় বেশি। সম্প্রতি দেখতে পাচ্ছি বেশ কিছু মানুষ গত কয়েক দিনের বজ্রপাতে মারা গেছে। মূলত বজ্রঝড়গুলো হয়েছে সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, পটুয়াখালী, শরীয়তপুর, নেত্রকোণা ও চাঁদপুরে। এর বাইরে পাবনা, নওগাঁতেও মানুষ মারা গেছে। এই অঞ্চল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব এলাকা থেকে উত্তর-পূর্ব এলাকার মধ্যে পড়েছে।'

অধ্যাপক ফারুখ বলেন, 'আমি ও আমার দল বজ্রপাত নিয়ে কাজ করছি, আমরা ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ভাইসালা স্যাটেলাইট থেকে গ্লোবাল লাইটনিং ডিটেকশন ৩৬০ ডিগ্রির তথ্য নিয়েছি। বাংলাদেশের আকাশসীমার মধ্যে ২ ধরনের বজ্রপাত সংঘটিত হচ্ছে। একটি মেঘ থেকে মেঘে, আরেকটি মেঘ থেকে মাটিতে। বছরে এর গড় সংখ্যা প্রায় ৭ লাখ ৮৬ হাজার। মেঘ থেকে মেঘে যে বজ্রপাত হচ্ছে, সেটা আমাদের জন্য চিন্তার বিষয় নয়। কারণ সেটার জন্য আমাদের প্রাণহানি হচ্ছে না। আমরা এখন পর্যন্ত তথ্যগুলো আলাদা করতে পারিনি—কোনটা মেঘ থেকে মাটিতে আসছে।'

'তবে, বাংলাদেশের আকাশসীমায় বছরে যে প্রায় ৭ লাখ ৮৬ হাজার বজ্রপাত সংঘটিত হচ্ছে সেটা আমাদের জন্য যথেষ্ট চিন্তার কারণ,' যোগ করেন তিনি।

'বজ্রপাতের তথ্য আমরা সফটওয়্যারে প্লটিং করে দেখেছি, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব থেকে উত্তর-পূর্ব ও সরাসরি উত্তর-পূর্ব কোণাকুণি এলাকা অর্থাৎ সুনামগঞ্জ-সিলেট অঞ্চলে অধিকাংশ বজ্রপাত হচ্ছে।'

তিনি বলেন, 'বজ্রপাতের সংখ্যা বাড়ছে বিধায় মানুষ মারা যাচ্ছে বেশি। আমরা মানুষের ভেতরে সচেতনতা সেভাবে সৃষ্টি করতে পারিনি। সরকার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়—দায়িত্বটা আমাদের সবার। সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে আমাদের জেলে ও কৃষক, তাদের কাছে আমরা বজ্রপাতের পূর্বাভাস পৌঁছাতে পারছি না। তারাও নিশ্চয়ই তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহের কাজে বাইরে যাচ্ছেন এবং যাওয়ার পরে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।'

'ইদানিংকালে আমরা আরেকটি জিনিস দেখতে পাচ্ছি শর্টটার্ম থান্ডার ক্লাউড ও শর্টটার্ম থান্ডার স্টর্ম। সারা দিন মোটামুটি রৌদ্দোজ্জ্বল হঠাৎ বিকেলের পরে বা সন্ধ্যার দিকে দেখা যাচ্ছে মেঘ তৈরি হচ্ছে, কিছুক্ষণ বজ্রঝড় থাকছে, আবার স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। এই বিষয়ে মানুষ আসলে খুব বেশি ওয়াকিবহাল নয়,' বলেন তিনি।

তিনি বলেন, 'বজ্রপাত এমন একটি দুর্যোগ আমরা চাইলেই এটি ম্যানিপুলেট বা কন্ট্রোল করতে পারি না। কোনো একটি সুনির্দিষ্ট জায়গায় বজ্রপাতকে আটকে রাখার মতো প্রযুক্তি আমাদের এখনো নেই। পৃথিবীর অনেক দেশেই এটা এখন সম্ভব। আলাস্কা, কানাডার মতো জায়গায় যারা আবহাওয়ার রূপান্তর ঘটাতে পারে ও একে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারে। সেটা করতে পারলে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। এ ধরনের প্রযুক্তি আমাদের দেশে প্রচলন ও এর সঙ্গে মানিয়ে নিতে আমাদের আরও সময় দরকার।'

বজ্রপাত থেকে রক্ষায় সচেতনতার বিকল্প নেই জানিয়ে তিনি বলেন, 'সরকারের পক্ষ থেকে যেসব স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল সেগুলো কতটুকু মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে সেটা নিয়ে আমাদের সন্দেহ রয়েছে। যেখান থেকে পূর্বাভাস পাওয়া সম্ভব হবে। সেগুলো ঠিক মতো কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে না। সেটা করলে তো মানুষ জানতেন এবং নিজেদের রক্ষা করতে পারতেন,' বলেন তিনি।

অধ্যাপক ফারুখ বলেন, 'হাওরে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছেন। সেখানে শেল্টার জোন থাকলে কৃষক আশ্রয় নিতে পারতেন ঝড়ের সময়। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, হয়তো সেগুলোর বাস্তবায়ন সেভাবে হয়নি। পূর্বাভাস সক্ষমতা আরও শক্তিশালী করা দরকার।'

তিনি বলেন, 'বজ্রপাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হতে পারে তালগাছ লাগানো। এর মধ্যে মধ্যবর্তী, অন্তর্বর্তী বা স্বল্প মেয়াদি পরিকল্পনার কাজগুলো নিশ্চয়ই চলতে থাকবে। সেটা হতে পারে শেল্টার জোন তৈরি করা, পূর্বাভাস দেওয়ার প্রক্রিয়া আরও শক্তিশালী করা এবং সেটা একেবারে নিরক্ষর মানুষের কাছে পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া।'

তাল ও সুপারি গাছ লাগানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, 'হাওর এলাকায় মানুষ মারা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। বোরো ধান এখনো মাঠে আছে। একরের পর একর মাঠে কোনো শেল্টার জোন নেই, কোনো লম্বা গাছ নেই। সেখানে যদি তালগাছ বা বিকল্প হিসেবে সুপারি গাছ জমির আইলগুলোতে লাগানো যায়, সেগুলোর জন্য মূল ফসল ধানের কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ তালগাছ ও সুপারি গাছের শেকড় ট্যাপ রুট সিস্টেম; সরাসরি মাটির কিছুটা নিচে লম্বা হয়ে চলে যায়,' বলেন তিনি।

গওহার নঈম ওয়ারা ও ড. এম এ ফারুখ (বাম থেকে)

তবে বাংলাদেশে বজ্রপাতের সংখ্যা বাড়েনি, মৃত্যু আগের চেয়ে বেড়েছে বলে মনে করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা।

তার ভাষ্য, 'বজ্রপাতের সংখ্যা আগের চেয়ে বাড়েনি। এখনো আগের মতো একই রকম বজ্রপাত হচ্ছে। তবে এখন বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়ছে।'

এই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞের মতে, বজ্রপাতে মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ বড় গাছ কেটে ফেলা। তিনি বলেন, 'আমরা সব গাছ কেটে ফেলছি। বড় গাছ কিছু নেই এখন আর। এটাই মূল কারণ। আবার জনসংখ্যাও আগের থেকে বেড়েছে। সেটাও একটা কারণ।'

'যারা বজ্রপাতে আহত হচ্ছে, তাদের চিকিৎসার জন্য কোনো প্রটোকলও নেই। বজ্রপাতে আহত কাউকে হাসপাতালে নেওয়া হলে কী চিকিৎসা দেওয়া হবে, এর কোনো প্রটোকল নেই। তৎক্ষণাৎ উপসর্গ দেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। বজ্রপাতে যারা মারা যান, তাদের বেশিরভাগ দরিদ্র মানুষ। সেজন্য এই বিষয়ে নিয়ে আমাদের কোনো চিন্তা নেই। এটাকে দুর্যোগের তালিকার মধ্যে নেওয়া হয়েছে। মরে গেলে দাফনের জন্য অর্থ দেওয়া হয়। ব্যস কাজ শেষ!' যোগ করেন তিনি।

করণীয় নিয়ে গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, 'সবার আগে বড় গাছ কাটা বন্ধ করে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত যেসব জায়গায় মানুষ বেশি মারা যাচ্ছে, সেখানে লাইটনিং অ্যারেস্টার স্থাপন করতে হবে। তা স্থাপনের প্রযুক্তি সব জায়গায় একই রকম হবে না। যেখানে মাঠ, সেখানে একরকম, বিলের মধ্যে অন্যরকম হবে। কয়েকটা প্রকল্প হাতে নিয়ে এই কাজটা করতে হবে। নেপালে তারা এটা করে ভালো ফল পেয়েছে।'

'আমাদের এখানেও প্রযুক্তি আছে। যেমন: অনেক প্রত্যন্ত পল্লী বিদ্যুতের ক্যাম্প আছে। সেখানে তো কেউ মারা যাচ্ছে না বজ্রপাতে। কারণ সেখানে এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। সুতরাং যত দ্রুত সম্ভব আমাদের লাইটনিং অ্যারেস্টার স্থাপন করতে হবে। মাঠপর্যায়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় সরকারকে এই দায়িত্ব দিতে হবে,' বলেন তিনি।

বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখন তথ্যপ্রাপ্তি সহজ হয়ে গেছে, আগে বজ্রপাতে মৃত্যু হলেও এত দ্রুত জানা যেত না। জলবায়ু পরিবর্তনের দিক থেকে দেখলে, দীর্ঘ দিনের ওয়েদার প্যাটার্ন চেঞ্জ হয়েছে। মুনসুন রেইনফল কিছুটা শিফট হয়ে গেছে এবং প্রি-মুনসুন সিজনের রেইনফল বেড়ে গেছে। এই সময় সাধারণত বজ্রপাত বেশি হয়। বৃষ্টি বেড়ে যাওয়ায় বজ্রপাতও বেড়ে গেছে।'

তিনি বলেন, 'লোক সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় হতাহতের সংখ্যা বেড়ে গেছে। আগে যেখানে ১ জন লোক থাকত, এখন সেখানে ৫ জন লোক থাকে। আগে বড় বড় গাছ ছিল, বজ্রপাত হলে গাছের ওপর পড়ত। বড় গাছগুলো কারণে-অকারণে কেটে ফেলা হয়েছে।'

'ধান খেতে বড় গাছ থাকলে সেখানে বজ্রপাত হতো। গাছ না থাকায় কৃষক আক্রান্ত হচ্ছেন,' যোগ করেন তিনি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'বজ্রপাতে প্রাণহানি রোধে সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। বজ্রপাতের পূর্বাভাস যেহেতু বেশি আগে করা যায় না, সাধারণত ৩-৪ ঘণ্টা বড়জোর। বড় মডেলে দেখলে ২৪ ঘণ্টা আগে বোঝা যায় এই এলাকায় হবে, কোথায় হবে সেটা জানা যায় রাডারের মাধ্যমে।'

লাইটনিং অ্যারেস্টার স্থাপন বড় ক্ষেত্রে সমাধান না বলে মনে করেন এই আবহাওয়াবিদ। বজলুর রশিদ বলেন, 'দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর কিছু জায়াগায় এটি বসিয়েছে কিন্তু খুব বেশি সুফল এখনো পাওয়া যায়নি।'

এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০১৬ সালে বাংলাদেশে বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এরপর থেকে বিভিন্ন সময় চিহ্নিত করা হয়েছে কোন কোন এলাকায় বেশি বজ্রপাত হয়। ইতোমধ্যে কিছু লাইটনিং অ্যারেস্টার বসানো হয়েছে, তবে এর রেডিয়াস খুব বেশি না।'

তিনি বলেন, 'আমাদের বিস্তৃত খোলা জায়গা, লাইটনিং অ্যারেস্টার অসংখ্য দরকার। এখন খুব বেশি আগে বলা যায় না কখন বজ্রপাত হবে, কোথায় হবে। ওই সময়ের মধ্যে লোকজনকে সরিয়ে আনাও সম্ভব হয় না। এর যে দাম তাতে গ্রামে খোলা জায়গায় বসানো বড় কঠিন।'

'যে কারণে আমরা মিটিং করে ঝড়ের সময় বা সম্ভাব্য যে সময়ে ঝড় হতে পারে সেই সময় নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলেছি,' মিজানুর রহমান বলেন।

তিনি আরও বলেন, 'এই উদ্যোগগুলো পর্যাপ্ত নয়। পরবর্তীতে নতুন করে প্রকল্প নেওয়া হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

$14b lost to capital flight a year during AL years

Bangladesh has lost around $14 billion a year on average to capital flight during the Awami League’s 15-year tenure, according to the draft report of the committee preparing a white paper on the economy.

7h ago