পুঁজিবাদী স্বার্থের কাছে বন্ধুত্বের কী দাম

ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

পুঁজিবাদ এখন যেমন উলঙ্গ তেমনি বেপরোয়া। এখন সে পুরোপুরি ফ্যাসিস্ট আকার নিয়েছে। লজ্জা ভয় হায়াজ্ঞান সব খুইয়েছে, যা ইচ্ছা তাই করছে এবং করবে। আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন সে বিপজ্জনক। মুনাফা ছাড়া কিছু চেনে না।

ধরা যাক গ্রেট ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথের কথা। তার সাম্রাজ্যে এক সময়ে সূর্য অস্ত যেত না, অতবড় সাম্রাজ্য আর কারও ছিল না। তিনি ছিলেন গ্রেট ব্রিটেনের স্বাধীনতা, দেশপ্রেম ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। একালে রাজতন্ত্রের অবস্থানটা দৃষ্টিকটু, এমনটা বলা হয়েছে; উঠিয়ে দিলে খরচ বাঁচে, এমন মত যে শোনা যায়নি তাও নয়। তবু রাজতন্ত্র আছে; রানি জীবদ্দশায় শুধু তার দেশের নন, ব্রিটিশ কমনওয়েলথেরও প্রধান ছিলেন। তার নিরাপত্তার জন্য ছিল নিশ্ছিদ্র রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। অথচ ধরা পড়েছিল যে অন্য ধনীদের মতো তিনিও গোপনে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। স্বয়ং রানিই যদি এমন দেশদ্রোহী হন তবে তার প্রজারা কি শিখবে? প্রজা অপরাধ করলে রাজা শাস্তি দেন, রাজা অপরাধ করলে শাস্তি দেয় কে? বোঝা যাচ্ছে পুঁজিবাদ রানিকেও ছাড়েনি, তিনিও টাকা চেনেন। তার নিরাপত্তা অন্যে দেয়, তিনি নিরাপত্তা দেন তাঁর টাকার। টাকা কত মহৎ!

ইংল্যান্ডের ইতিহাসে আরও একজন রানি এলিজাবেথ ছিলেন। তিনি প্রথম এলিজাবেথ (১৫৩৩-১৬০৩), ইনি ছিলেন দ্বিতীয়। প্রথম এলিজাবেথের সময়েই ইংল্যান্ড পুঁজিবাদের পথ ধরেছিল। ইংরেজ নৌবাহিনী তখন দুর্ধর্ষ, স্পেনের নৌবহরকে সে হারিয়ে দিয়েছে, সমুদ্র গেছে উন্মুক্ত হয়ে, দুঃসাহসী জলদস্যুরা জাহাজ নিয়ে বের হয়ে পড়েছে বাণিজ্য করবে বলে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠিত হয়েছে, রানি তাদেরকে সনদ লিখে দিয়েছেন, তারা এসে হানা দিয়েছে আমাদের এই সুজলা সুফলা বাংলাদেশেও। পুঁজিবাদের ওই বিকাশকালে ইংরেজরা যেখান থেকে পারে যে ভাবে পারে যত পারে সম্পদ লুণ্ঠন করেছে, সেই সম্পদ জাহাজ বোঝাই করে নিয়ে গেছে নিজেদের দেশে। ডাকাত হলেও তারা বেশ দেশপ্রেমিকই ছিল বলতে হবে। লুণ্ঠিত সম্পদের জোরে নিজের দেশে তারা শিল্পবিপ্লব ঘটিয়েছে, উপনিবেশ স্থাপন করেছে যত্রতত্র। পুঁজিবাদ এগিয়ে গেছে দুর্ধর্ষ গতিতে। দ্বিতীয় এলিজাবেথের কিংবা তাঁর পুত্র নতুন রাজা চার্লসের কালে পুঁজিবাদ আর দেশপ্রেমিক নেই, তার অধীনে প্রত্যেকে এখন নিজের তরে; টাকা আনার চেয়ে টাকা পাচারে অধিক উৎসাহী। উত্তরসূরি ছাড়িয়ে গেছে পূর্বসূরিকে।

বিশ্বায়নের মাহাত্ম্য গাইতে গাইতে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা বিশ্বময় পুঁজি ও পণ্য পাঠাচ্ছিল, ছড়িয়ে পড়ছিল সর্বত্র; ট্র্যাম্প সাহেব আওয়াজ দিয়েছেন উল্টা রকমের, বলছিলেন আমি রক্ষণশীল, আমি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, আমেরিকার উন্নতি চাই, বিশ্ব যদি মরে বা মরুক গিয়ে; আমেরিকাকে বাঁচানো চাই। তার আমেরিকা শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টানদের আমেরিকা। এখানে বাইরের লোককে ঢুকতে দেওয়া হবে না। ওদিকে আবার তিনি এতটাই স্বদেশপ্রেমী যে প্রেসিডেন্ট হবার তৎপরতার কালে গোপনে রাশিয়ানদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, সাহায্য সহযোগিতার খোঁজে। আর ব্যক্তিগত মানসম্মানের কথা যদি ওঠে তবে তার যে তিনি পরোয়া করেন না তার প্রমাণ চতুর্দিকে পাওয়া যাচ্ছে, বিশেষভাবে পাওয়া যাচ্ছে ভুক্তভোগী মহিলারা যে তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির যেসকল অভিযোগ এনেছিলেন তা থেকে। এ ব্যাপারে অবশ্য আমেরিকার অতীত প্রেসিডেন্টবৃন্দেরও কারো কারো বিস্তর খ্যাতি রয়েছে। তবে তিনি মনে হয় সকলের সুখ্যাতিকে মলিন করে দিয়েছিলেন; নানাক্ষেত্রে, এবং যৌন হয়রানির ক্ষেত্রেও।

পুঁজিওয়ালাদের ভাবটা এখন এই রকমের যে বিশ্বায়নের দিন শেষ। বিশ্বায়নের নয়, দিন শেষ আসলে পুঁজিবাদেরই। আচ্ছাদনে-বাদশাহি কিন্তু ভেতরে-পুঁজিবাদী সৌদি আরবের শাসকেরাও এখন আর নিরাপদে নেই। গৃহকলহ আগেও ছিল, এখন তা প্রকাশ্য গৃহযুদ্ধের আকার নিচ্ছে। বড় বড় 'রাজপুত্র'দের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে, তাদেরকে আটকও করা হয়েছিল, কিন্তু আবার খবর পাঠানো হয়েছিল যদি টাকা দাও তাহলে ছাড়া পাবে। ব্রিটেনের রানি টাকা পাচার করেন, সৌদি আরবের বাদশাহ টাকা ঘুষ নেন। রাজা-বাদশাহদের ওপর নিজের কর্তৃত্ব দেখে টাকা হাসে, আহ্লাদে আটখানা হয়। মানসম্মান, খ্যাতিসম্ভ্রম, লজ্জাশরম, সবকিছুই এখন টাকার কাছে দাসানুদাস।

পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে কথিত ভারত বর্তমানে পুরোপুরি পুঁজিবাদী। সেখানে আকাশচুম্বী ধনপতিরা রয়েছে, পাশাপাশি রয়েছে পথের ভিখারি। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কন্যা এসেছিলেন হায়দারাবাদে। পাছে তিনি ভিক্ষুকদের দেখে ফেলেন তাই শহরের সকল ভিক্ষুককে জেলখানাতে ঢোকানো হয়েছিল; দু'চারজন লুকিয়ে-টুকিয়ে থাকতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল ধরে দিতে পারলে ভিক্ষুক প্রতি নগদ পাঁচশ' রুপি করে দেওয়া হবে। তাতে সাময়িক ভাবে শহরটি ভিক্ষুকশূন্য হয়েছিল হয়তো, কিন্তু ভিক্ষুক তো আছে, কেবল ভিক্ষুক নয় অনাহারী মানুষ রয়েছে, রয়েছে শত শত গরিব কৃষক, জীবনের ভার বহন করতে অক্ষম হয়ে যারা আত্মহত্যা করে, আছে বনাঞ্চলে বসবাসকারী সেই মানুষেরাও যাদেরকে ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে খনিজসম্পদ আহরণের ও শিল্প-কারখানা তৈরি করার তৎপরতা চলছে। কলকাতা শহর ঢাকা থেকে উন্নত বলেই জানতাম; তার একটা প্রমাণ সেখানে মেয়েরা নিরাপদে চলাফেরা করতে পারতো, এখন দেখা যাচ্ছে সেই কলকাতাতেও শিশু ধর্ষণ চলছে; অত্যন্ত দামী এক স্কুলের দু'জন শিক্ষক অভিযুক্ত হয়েছে স্কুলেরই এক শিশুছাত্রীকে ধর্ষণের দায়ে। বোঝা যাচ্ছে যে ঢাকা কলকাতা এখন পরস্পরকে চ্যালেঞ্জ করবে, কে কতটা উন্নতি করেছে তা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে।

তবে ভারত যে এগিয়ে আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেখানে গায়ে গরুর মাংসের গন্ধ পাওয়া গেছে এমন গুজবে মানুষ মারা হয়। সেখানে 'জাতির পিতা' মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিল যে নাথুরাম গডসে তার নামে মন্দির উঠেছে, আর যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের সদস্যরা গান্ধী হত্যার উস্কানি দিয়েছিল তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় অসীন হয়। জোর করে নয়, ভোটের জোরেই। যে তাজমহল পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি বলে কথিত এবং যাকে নিয়ে ভারতের খুবই গৌরব, যেটি দেখার জন্য দেশি বিদেশি পর্যটকদের ভিড়ের শেষ নেই, সেটাও ভেঙে ফেলাটা দরকার এমন ভাব করা হচ্ছে; কারণ ওই সৃষ্টিটি অপবিত্র, ওর নিচে নাকি একসময়ে পবিত্র এক মন্দির ছিল। এমন কি পাঠ্যসূচি থেকে মুসলিম শাসকদের ইতিহাস প্রত্যাহার করে শিক্ষার্থীদের ইতিহাস জ্ঞান থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। মোগল সরাই-এর নাম পরিবর্তন করে হিন্দু জাতীয়তাবাদী আরএসএস নেতা দীন দয়ালের নাম দিয়েছে। পুঁজিবাদী উন্নতির অসাধ্য কী?

চলচ্চিত্র তৈরি করে ভারতের চলচ্চিত্রব্যবসায়ীরা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামায়। আমেরিকার হলিউডের পরেই তো ভারতের বলিউডের স্থান। সেই বলিউডে ছবি তৈরি হয়েছে 'পদ্মাবতী' নামে। পদ্মাবতী সেই নায়িকা যাকে নিয়ে হিন্দি ভাষার কবি মালিক মোহাম্মদ জয়সী পদুমাবত নামে কাব্য লিখেছিলেন সেই ১৫৪০ সালে, এক শ' বছর পরে আলাওল বিখ্যাত হয়েছেন ওই কাব্যটি বাংলায় অনুবাদ করে। তাঁরা দু'জনেই বেঁচে গেছেন, খ্যাতিও পেয়েছেন, একালে জন্মালে খবর ছিল; পদ্মাবতীর গল্প নিয়ে ওই চলচ্চিত্রটি তৈরি করতে গিয়ে কেবল প্রযোজক নন, নায়ক নায়িকারাও যে বিপদে পড়েছেন সেটা তো বাস্তব সত্য। তাঁদের মাথার ওপর টাকা ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে দিল্লির বাদশাহ আলাউদ্দিন খিলজি যে পদ্মাবতীর রূপ দেখে আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাতে হিন্দু জাতির ভীষণ অপমান হয়েছে। পদ্মাবতী অবশ্য বিজয়ী খিলজিকে মেনে নেননি, তাকে ধিক্কার দিয়ে এবং ক্ষত্রিয়দের রাজধর্মের অনুরোধে জ্বলন্ত আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মসম্মান রক্ষা করেছেন, কিন্তু তাতে কি আসে যায়? মুসলমান বাদশাহ হিন্দু রানির ওপর চোখ ফেলেছিল অপরাধ হিসেবে এটা কম কিসে? পুঁজিবাদী ভারতে গো-রক্ষার নাম করে যদি মানুষ মারা চলতে পারে তাহলে রানির মান রক্ষার জন্য অভিনেত্রীকে ছাড় দেওয়া হবে কেন? তা সে রানি কল্পিত হোন, কি ঐতিহাসিকই হোন তাতে কি? ধর্মব্যবসা যে পরিমাণ স্থায়ী মুনাফার প্রতিশ্রুতি দেয় চলচ্চিত্র ব্যবসার প্রতিশ্রুতি তার কাছে হার মানতে বাধ্য।

ভারতের শাসকেরা বলছেন বন্ধুত্বের দিক থেকে বাংলাদেশ তাদের চোখের মণি। ওদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাষ্ট্রীয় সফরে গেছিলেন মিয়ানমারে, সেখানে রোহিঙ্গাদের পক্ষে একটি কথাও বলেননি, বরং এমন ভাব-ভঙ্গি করে এসেছেন যাতে বোঝাই যায় ভারত আছে ওই খুনিদের সঙ্গেই। বিশ্বের প্রায় সর্বত্র রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিসূচক আওয়াজ উঠেছে, ভারত নীরব; উপরন্তু যে নিরুপায় রোহিঙ্গারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন চেষ্টা চলছে তাদেরকে ঘাড়ে ধরে হন্তারকদের বন্দুকের নিচে ঠেলে পাঠাবার। পারলে বাংলাদেশেই পাঠিয়ে দেয়। বিপদেই পরীক্ষা হয় বন্ধুত্বের। এই সঙ্কটে নিকটতম বন্ধুর কাছে প্রত্যাশিত ছিল সর্বাধিক সমর্থন। ভারত পারতো মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নিন্দা করতে, বিশ্বসভাতে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা ও বাংলাদেশের বিপদটাকে তুলে ধরতে, পারত গণহত্যার দায়ে সামরিক বর্বরদেরকে অভিযুক্ত করতে, আন্তর্জাতিক আদালতে খুনিদের বিচার দাবি করতে। কিন্তু হায়, এমনকি মৌখিক সহানুভূতিটাও পাওয়া গেল না। স্বার্থের কাছে বন্ধুত্বের কী দাম?

Comments

The Daily Star  | English

Road accidents killed 583 in April: Jatri Kalyan Samity

Bangladesh Jatri Kalyan Samity (BJKS), a passenger welfare platform, said that a total of 583 people were killed and 1,202 injured in 567 road accidents across the country in the month of April, citing media reports

49m ago