আল কাদির ট্রাস্ট মামলা নিয়ে যা জানা গেল
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পিটিআই প্রধান ইমরান খানকে মঙ্গলবার ইসলামাবাদ হাইকোর্ট প্রাঙ্গণের বাইরে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি ওই আদালতে দুটি মামলার শুনানির জন্য উপস্থিত ছিলেন।
ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরে ইসলামাবাদ পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজি) আকবর নাসির খানের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি বিবৃতিতে জানানো হয়, ইমরান খানকে আল কাদির ট্রাস্ট মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যেখানে অভিযোগ করা হয়েছে, পিটিআই প্রধান এবং তার স্ত্রী একটি রিয়েল এস্টেট ফার্মের কাছ থেকে কয়েক বিলিয়ন রুপি এবং শত শত কানাল মূল্যের জমি নিয়েছিলেন।
কিন্তু, আল কাদির ট্রাস্ট মামলা কী এবং কেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে এই মামলার সঙ্গে জড়ানো হয়েছে?
সূত্রপাত
ঘটনার সূত্রপাত ৫ বছর আগে। যখন যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) আবাসন ব্যবসায়ী মালিক রিয়াজের পরিবারের সঙ্গে ১৯০ মিলিয়ন পাউন্ডের সমঝোতায় সম্মত হয়।
এনসিএ'র বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, এই চুক্তিতে যুক্তরাজ্যেরও একটি সম্পত্তি আছে- ১ হাইড পার্ক প্লেস, লন্ডন, ডাব্লু২ ২এলএইচ। যার মূল্য প্রায় ৫০ মিলিয়ন পাউন্ড এবং সব তহবিল মালিক রিয়াজের জব্দ করা অ্যাকাউন্টে জমা আছে।
পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) ক্ষমতায় আসার পরপরই ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাজ্যে রিয়াজের সম্পদের তদন্ত নিয়ে এনসিএর প্রথম রেকর্ডটি প্রকাশিত হয়।
এই সংস্থাটি ২০১৯ সালের ১৪ আগস্ট এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেছিল, 'এনসিএকে মোট ১০০ মিলিয়ন পাউন্ডের বেশি অর্থের ৮টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জব্দের আদেশ দেওয়া হয়েছে। যেগুলো বিদেশি ঘুষ ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একটি শুনানির পর জড়িত এক ব্যক্তির কাছে থাকা প্রায় ২০ মিলিয়ন পাউন্ড জব্দ করা হয়েছে।'
ডন বলছে, সেই বছরের শুরুর দিকে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট রিয়াজের রিয়েল এস্টেট ফার্ম বাহরিয়া টাউন লিমিটেডের সমঝোতা হিসেবে ৪৬০ বিলিয়ন রুপির প্রস্তাব গ্রহণ করেন। 6তখন ফার্মটি করাচির মালির জেলায় হাজার হাজার একর জমি অবৈধভাবে অধিগ্রহণ করেছে বলে প্রমাণিত হয়েছিল।
এনসিএ'র রায়ের কয়েক ঘণ্টা পর মালিক রিয়াজ টুইট করেছিলেন, ৪৬০ বিলিয়ন টাকার জরিমানার বিপরীতে জব্দ হওয়া অর্থ সুপ্রিম কোর্টে যাবে। পরবর্তীতে ওই অর্থ পাকিস্তান সরকারের অ্যাকাউন্টের পরিবর্তে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। ৩ ডিসেম্বর এনসিএ যখন এই সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছিল, তখন প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহিতা বিষয়ক বিশেষ সহকারী মির্জা শাহজাদ আকবর দাবি করেছিলেন, এই অর্থ সরাসরি দেশে আসবে।
পরে এই অস্পষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে শাহজাদ আকবর বলেন, সুপ্রিম কোর্ট কি সরকারের অংশ নয়? সুতরাং যদি সেই টাকা শীর্ষ আদালতে যায়, তার মানে এই যে অর্থ দেশে আসা।
যুক্তরাজ্যসহ এই মামলায় জড়িত পক্ষের গোপনীয়তা রক্ষার ধারার কথা উল্লেখ করে তিনি এই অর্থের উৎস এবং কীভাবে এটি বিদেশে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল তা জানাতে অস্বীকার করেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, 'আমরা যুক্তরাজ্য সরকারের সঙ্গে গোপনীয়তার একটি বন্ড স্বাক্ষর করেছি। তাই আমরা মামলার বিশদ নিয়ে কথা বলতে পারছি না।'
ইমরানের বিরুদ্ধে মামলা
২০২২ সালের জুনে মালিক রিয়াজ ও তার মেয়ের মধ্যে একটি টেলিফোন কথোপকথনের কথিত অডিও ফাঁস হয়। এরপর বিষয়টি আবার সামনে আসে। ওই কথপোকথানে দুজনকে ইমরান খানের স্ত্রী বুশরা বিবির বন্ধু ফারাহ খান ওরফে গোগির প্রসঙ্গে কথা বলতে শোনা যায়। রিয়াজের মেয়ে হিসেবে ধারণা করা ওই নারী তার বাবাকে বলেন, ফারাহ তাকে বলেছিলেন- (সাবেক) ফার্স্ট লেডি তাকে ৩ ক্যারেটের হীরার আংটি নিতে মানা করেছেন। তিনি ৫ ক্যারেটের একটি আংটি দাবি করেছেন।
অবশ্য পরে রিয়াজ রাজনৈতিক বিষয়ে তার ভূমিকার কথা অস্বীকার করেন। তিনি একটি টুইটে দাবি করেছিলেন, তাকে ও তার মেয়েকে দায়ী করে ফাঁস হওয়া অডিও ক্লিপটি 'বানোয়াট'।
এর এক সপ্তাহ পর ১৪ জুন ইমরান ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলায় রিয়েল এস্টেট ফার্মকে রক্ষায় ৫০০ কোটি রুপি ও শত শত কানাল জমি গ্রহণের অভিযোগ করেন পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ।
ইসলামাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে সানাউল্লাহ বলেন, বাহরিয়া টাউন অবৈধভাবে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত এক পাকিস্তানি নাগরিকের কাছে ৫ হাজার কোটি রুপি স্থানান্তর করেছে। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি এই লেনদেনকে চিহ্নিত করেছিল এবং পরবর্তীতে তৎকালীন পিটিআই সরকারকে অবহিত করেছিল।
সানাউল্লাহ দাবি করেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আগের প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহিতা বিষয়ক সহকারী শেহজাদ আকবরকে বিষয়টি সমাধানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আকবর পুরো বিষয়টি 'নিষ্পত্তি' করেছিলেন এবং ৫০ বিলিয়ন রুপি যা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি এবং জাতীয় কোষাগারের অন্তর্ভুক্ত ছিল তা বাহরিয়া টাউনের দায়বদ্ধতার সঙ্গে সমন্বয় করেছিলেন।
দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই অভিযোগের পরের দিন ফেডারেল মন্ত্রিসভা তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। ইমরান ও তার স্ত্রী বুশরা এই মামলায় জড়িত বলে অভিযোগ তাদের।
সানাউল্লাহর মতে, আল-কাদির ট্রাস্টকে শত শত একর জমি দান করেছিল বাহরিয়া টাউন। এসব চুক্তিতে রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারের দাতা এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরানের স্ত্রী বুশরা খানের স্বাক্ষর আছে।
তিনি বলেন, অলাভজনক সংস্থার মাত্র দুজন ট্রাস্টি ছিলেন ইমরান খান এবং বুশরা বিবি। 'ফারাহ শেহজাদী'র কাছে আরও ২৪০ কানাল স্থানান্তর করা হয়েছে।
এনএবি'র উদ্যোগ
রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী মালিক রিয়াজ ও পিটিআই চেয়ারম্যান ইমরান খানের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ব্যুরো (এনএবি) গত ১ ডিসেম্বর আদালতে হাজির হতে বলেছিল।
এনএবি নোটিশে বলা হয়েছিল, ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি অর্ডিন্যান্স-১৯৯৯-এর ১৯ নম্বর ধারায় মামলার তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে পরিচিতদের কলআপ নোটিশ, ক্ষমতার অপব্যবহার, আর্থিক লাভ এবং যুক্তরাজ্য থেকে প্রাপ্ত অর্থ উদ্ধারে বিশ্বাস ভঙ্গ এবং অবৈধভাবে রেকর্ড সিল করার অভিযোগের তদন্ত করা হচ্ছে।
এতে বলা হয়, ক্ষমতার অপব্যবহার, আর্থিক লাভ এবং বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগের তদন্তে জানা গেছে- রিয়াজ মালিক ও অন্যরা পাকিস্তান সরকারের কাছে তহবিল ফেরত দিতে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সির সঙ্গে আদালতের বাইরে একটি নিষ্পত্তি চুক্তি করেছিল।
নোটিশে আরও বলা হয়, 'এছাড়া মেসার্স বাহরিয়া টাউন আল কাদির ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির জন্য ঝিলাম জেলার সোহাওয়া তহসিল মৌজা বরকলায় অবস্থিত ৪৫৮ একর, ৪ মারলা এবং ৫৮ বর্গফুট জমি দান করেছে। অতএব, আপনার কাছে তথ্য/প্রমাণ যাই থাকুক না কেন উক্ত অপরাধগুলো কমিশনের সঙ্গে সম্পর্কিত।'
ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইমরান খানের স্ত্রী ট্রাস্টের অন্যতম আস্থাভাজন বলে অনেকের দাবি।
এর আগে, এনএবি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মন্ত্রিসভার ২১ জন সদস্যকে নোটিশ পাঠিয়েছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গোলাম সারওয়ার খান, মুরাদ সাঈদ, পারভেজ খাত্তাক, শাফকাত মাহমুদ, শিরিন মাজারি, আলী হায়দার জাইদি, হাম্মাদ আজহার এবং জুলফি বুখারি।
বুখারিকে প্রাথমিকভাবে ২৯ নভেম্বর এনএবি তলব করেছিল। তবে বেশ কয়েকটি শুনানিতে অনুপস্থিত থাকার পরে চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি তিনি হাজির হয়েছিলেন।
গতকাল মঙ্গলবার ইমরান ইসলামাবাদ হাইকোর্টে অন্য মামলায় হাজির হওয়ার সময় রেঞ্জার্স কর্মীরা তাকে আটক করেন। গ্রেপ্তারের কয়েক ঘণ্টা পর দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আল-কাদির ট্রাস্ট মামলায় ইমরানকে গ্রেপ্তার করেছে ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ব্যুরোর (এনএবি) কর্মকর্তারা।
দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এনএবি দুর্নীতির মামলায় পিটিআই প্রধানের বিষয়ে নোটিশ জারি করেছে। তাকে উপস্থিত হতে এবং তদন্তে অংশ নিতে বলেছে। মামলাগুলোতে ডকুমেন্টারি প্রমাণ থাকায় ইমরান জড়িত থাকলে ব্যাপক তদন্তের প্রয়োজন ছিল না।
তিনি বলেন, 'তার উচিত ছিল হাজির হয়ে জবাব দেওয়া। কিন্তু তিনি তা না করে নোটিশ বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করেছেন। আদালত বলেছেন, আইন তার নিজের ধারায় চলবে। এ কারণে এনএবি তাকে গ্রেপ্তার করেছে।'
Comments