‘ইতালির স্কুলগুলো হিমবাহের মতো হারিয়ে যাচ্ছে’
ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডের সীমান্তবর্তী ইতালির আধা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল আওস্তা উপত্যকার পাহাড়ি গ্রাম চামপরচারের স্কুলের খেলার মাঠটি শত বছর ধরে শিশুদের হুল্লোড়ে মুখরিত ছিল। তাদের উচ্ছলতা স্থানীয়দের মনে গ্রামটির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা জাগাত।
এসবই এখন ইতিহাস।
গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে সেই স্কুলমাঠটিতে সুনসান নীরবতা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ স্কুলটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। কেননা, সেখানে মাত্র ২ শিশু ভর্তি হতে এসেছিল। এমন ভাগ্য অন্য স্কুলের ক্ষেত্রেও হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গত সোমবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এ তথ্য জানিয়েছে।
ইতালিতে মাত্র ১ ডলারে বাড়ি বিক্রির সংবাদ প্রায়ই বিশ্ব গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়। ইউরোপে এক সময়ে প্রভাববিস্তারকারী এই দেশের এমন চিত্রের কারণ, সেখানকার গ্রামগুলো ধীরে ধীরে জনশূন্য হয়ে পড়ছে।
ইতালিতে শিশু জন্মের হার 'বিপদজনক হারে' কমে যাওয়ায় এখন সেখানে ক্রমাগত স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
সমাজ টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন স্কুল
চামপরচারের শিশুদের গুচ্ছ স্কুলের প্রধানশিক্ষক স্তেফানিয়া গিরোদো গ্রান্ত বলেছেন, 'যখন একটি স্কুল বন্ধ হয়, তখন বুঝতে হবে গ্রামটি মরে যাচ্ছে। একটি গ্রামের ভবিষ্যৎ টিকে থাকে সেখানকার শিশু জন্মের হারের ওপর।'
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইতালির জনসংখ্যা যে প্রতিনিয়ত কমছে তা হাসপাতালগুলোর প্রসূতি ও নবজাতক বিভাগের ছোট বিছানাগুলো খালি পড়ে থাকার দৃশ্য দেখে বলে দেওয়া যায়।
এতে আরও বলা হয়, ইতালির ইতিহাসে ২০২২ সালে সবচেয়ে কম সংখ্যক শিশু জন্ম নেয়। ওই বছর দেশটিতে জন্ম নেয় ৩ লাখ ৯৩ হাজার শিশু। দেশজুড়ে শ্রেণিকক্ষগুলো খালি পড়ে আছে।
দেশটির শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করা সংবাদমাধ্যম তুত্তোসকুওলার তথ্যে বলা হয়েছে, গত দশকে ইতালির স্কুলগুলোয় ৩০ শতাংশ বা ৪ লাখ ৫৬ হাজার ৪০৮ কম শিশু ভর্তি হয়েছে।
এই হারে যদি শিশু শিক্ষার্থীর হার কমতে থাকে তাহলে সরকারি হিসাবে ২০৩৪ সালের মধ্যে ইতালিতে ৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীর সংখ্যা হবে ১৪ লাখের কম। ফলে দেশটিতে আরও অনেক স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে।
তুত্তোসকুওলার পরিচালক গিওভান্নি ভিসসিগুয়েরা গণমাধ্যমকে বলেন, 'ইতালির স্কুলগুলো গলিত হিমবাহের মতো হারিয়ে যাচ্ছে। জীবন রক্ষার জন্য যেমন পানির প্রয়োজন, তেমনি সমাজ টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন স্কুল।'
তিনি মনে করেন, ইতালিতে শিশুদের স্কুলের সংখ্যা যেহেতু ক্রমাগত কমছে, সেহেতু এর প্রভাব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলোতেও পড়বে।
নারীরা সন্তান নিতে উৎসাহী না
গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে ইতালিতে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে এরপর থেকে দেশটিতে শিশু জন্মের হার কমতে থাকে। ২০২০ সালে সেখানে একজন নারীর সন্তান জন্ম দেওয়ার সক্ষমতার গড় হার ছিল ১ দশমিক ২৪, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নে সর্বনিম্ন।
একই সঙ্গে দক্ষিণ ইউরোপের এই দেশটিতে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এটি সরকারের তহবিলের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।
ইতালিতে গত ২০ বছরে শতবর্ষী মানুষের সংখ্যা ৩ গুণ বেড়ে ২২ হাজারে দাঁড়িয়েছে।
শিশু জন্মের হার কমার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ দেখানো হয়েছে। এগুলো হচ্ছে—ভালো চাকরি পেতে তরুণদের লড়াই। অনেক অন্তঃসত্ত্বা নারী সংসার সামলাতে গিয়ে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। শিশু জন্মের পর তাদের অনেককে চাকরিতে ফিরতে বেশ বেগ পেতে হয়।
এমনকি, অনেক অন্তঃসত্ত্বা নারীকে চাকরি থেকে ছাঁটাইও করা হয়।
এসব দেখে অন্য নারীরা সন্তান নিতে উৎসাহী হন না।
সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ
ইতালির মিলান-বিকোক্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ববিদ জিওরজিয়া সেরুঘেত্তি দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, 'অর্থনৈতিক সংকট ও সরকারি সহায়তার অভাবে ইতালিতে শিশু জন্মের হার কমেছে। এ ছাড়া, দীর্ঘদিন ধরে নারীদের মধ্যে সন্তান নেওয়ার প্রবণতা কম দেখা যাচ্ছে।'
তার মতে, শিশু লালন-পালন নিয়ে নতুন মা-বাবাদের ভাবনার পরিবর্তন হয়েছে। তারা তাদের সন্তানদের বড় করে তোলার পেছনে খরচের কথা ভাবেন। তারা সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে সবসময় চিন্তিত থাকেন।
গত কয়েক দশক ধরে ইতালির সরকারগুলো তরুণদের সংসারী হতে উৎসাহ দিচ্ছে। এর অংশ হিসেবে শিশু জন্মের হার বাড়াতে দম্পতিদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
প্রতি মাসে একটি শিশুর পরিবারকে ৫০ ইউরো থেকে ১৭৫ ইউরো পর্যন্ত দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একটি শিশু ২১ বছর পর্যন্ত সরকারি সহায়তা পাবে।
কিন্তু, এসব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
সম্প্রতি, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি বলেছেন, তার রক্ষণশীল সরকার দেশকে নিম্ন জন্মহার থেকে উচ্চ জন্মহারে ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর।
'পরিসংখ্যানের চেয়েও পরিস্থিতি ভয়াবহ'
সম্প্রতি, লন্ডনভিত্তিক ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসে এক পাঠকের চিঠিতে বলা হয়েছে, 'ইতালির জনসংখ্যা সংকট পরিস্থিতি পরিসংখ্যানের চেয়েও ভয়াবহ'।
চিঠিতে সিটি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের বেইস বিজনেস স্কুলের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর জন ব্যাটেসন লিখেছেন, 'ইতালির জাতীয় পরিসংখ্যান এজেন্সির হিসাবে ১৮৬১ সালের পর ইতালিতে জন্মহার এখন সর্বনিম্ন।'
ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের হিসাবে, বর্তমানে ইতালির জনসংখ্যা ৫ কোটি ৮৯ লাখ। জাতিসংঘের হিসাবে ২০৭০ সালে তা কমে ৪ কোটি ৪৩ লাখে নেমে আসবে।
অনেকের মতো প্রফেসর জন ব্যাটেসন মনে করেন, এই সংখ্যা আশাব্যঞ্জক। তবে ইতালির একেক অঞ্চলে জন্মহার অবস্থা একেক রকম। কোনো কোনো অঞ্চলে জন্মহার আশঙ্কাজনকভাবে কম।
জাতিসংঘের বরাত দিয়ে প্রফেসর জন ব্যাটেসন জানান, ২০১৫ সালে ইতালির জনসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬ কোটিতে পৌঁছলেও গত ৫৫ বছরে সেখানকার জনসংখ্যা ২৭ শতাংশ কমেছে।
তিনি বলেন, ইতালির জাতীয় পরিসংখ্যান এজেন্সি নারীর সন্তান জন্ম দেওয়ার সক্ষমতার হার ১ দশমিক ৫ ধরে তাদের জনসংখ্যার হিসাব করছে। ১৯৭৬ সালে দেশটিতে একজন নারীর সন্তান জন্ম দেওয়ার সক্ষমতার গড় হার ছিল ২ দশমিক ১। ১৯৯৬ সালে এটি ১ দশমিক ২০-এ নেমে আসে। ২০১০ সালে তা বেড়ে ১ দশমিক ৪৫ এ দাঁড়ালেও এরপর আবার কমতে শুরু করে।
বয়স্কদের দেশ ইতালি
ইতালির জাতীয় পরিসংখ্যান এজেন্সির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটিতে সন্তান ধারণে উপযুক্ত নারীর সংখ্যা কম। প্রথম সন্তান নেওয়া নারীর গড় বয়স ৩২ বছর ৪ মাস। এ ছাড়া, সরকার যে প্রণোদনা দেয় তা খুবই নগণ্য হওয়ায় জন্মহার বাড়াতে তা তেমন কাজে আসছে না।
ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, গত বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বয়স ৪৪ বছরের বেশি। ইতালিতে এটি প্রায় ৪৭ বছর।
গত বছর ইতালির মোট জনসংখ্যা ১ লাখ ৭৯ হাজার বা ৩ শতাংশ কমেছে। দেশটিতে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা প্রতিনিয়ত কমছে। সেখানে কর্মী বা শ্রমিক পাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। সন্দেহ নেই এই পরিস্থিতি দেশটির অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
Comments