দুর্ভোগের ঝুঁকি মাথায় নিয়েই উত্তরাঞ্চলে ঈদযাত্রা
প্রতি বছর ঈদের সময় পরিবারের সবার সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে রাজধানী ছেড়ে যাত্রাপথের দুর্ভোগ মাথায় নিয়েই গ্রামের পথে পা বাড়ায় নগরবাসী। গত কয়েক বছর ধরেই ঈদের সময় দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষ ঘরে ফিরতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
সড়ক পথে বঙ্গবন্ধু ব্রিজ হয়ে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলাসহ দেশের প্রায় ২২টি জেলার মানুষ যাতায়াত করে। বঙ্গবন্ধু ব্রিজের পশ্চিম প্রান্তে উত্তরবঙ্গের রংপুর পর্যন্ত মহাসড়ক ৪ লেনে উন্নিতকরণের কাজ চলমান থাকায় গত কয়েক বছর ধরেই উত্তরের যাত্রা পথে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে ঈদে ঘরে ফেরা মানুষদের।
সবচেয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হয় বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থেকে হাটিকুমরুল এবং বগুড়া রোডের সিরাজগঞ্জের চান্দাইকনা পর্যন্ত মহাসড়কে।
চার লেনের কাজ চলমান থাকায় এবং মহাসড়ক প্রশস্তকরণ এবং বিভিন্ন স্থানে ব্রিজের কাজ চলমান থাকায় এবারের ঈদযাত্রায় বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম থেকে চান্দাইকনা পর্যন্ত প্রায় ৪১ কিলোমিটার রাস্তায় দুর্ভোগের আশঙ্কায় আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
ইতোমধ্যে ৪১ কিলোমিটার রাস্তার প্রায় ১৪টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থান নির্ধারণ করে সেগুলো মেরামত করার তাগিদ দিয়েছে পুলিশ। এসব স্থানে মেরামত কাজ শেষ করা হয়েছে বলে দাবি করেছে সড়ক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
উত্তরবঙ্গের মহাসড়কের উন্নয়ন প্রকল্পের সাসেক-২ প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক আহসানুল কবির পাভেল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, যে সব স্থান ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে সে সব স্থানে ইতোমধ্যে সংস্কার কাজ শেষ করা হয়েছে। ঈদ যাত্রাকে নিরবচ্ছিন্ন করতে বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম মহাসড়কের চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে।
এদিকে উত্তরের প্রবেশ পথে বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম মহাসড়ক থেকে চান্দাইকনা পর্যন্ত ৪১ কিলোমিটার রাস্তায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে পুলিশ।
সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, উত্তরবঙ্গসহ বেশ কয়েকটি জেলার যানবাহন বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে চলাচল করে ফলে প্রতিবছর বিভিন্ন জেলার একসাথে বিপুল পরিমান যানবাহনের চাপে উত্তরের প্রবেশ পথে সিরাজগঞ্জ অংশে যানজটের সৃষ্টি হয়।
তবে এ বছর ৪১ কিলোমিটার মহাসড়কে প্রায় ৬৫০ পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। রাস্তায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সোমবার দুপুরের পর থেকেই মহাসড়কে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা রাস্তায় কোনো যানবাহন যেন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখবে। পাশাপাশি মহাসড়কে কোনো যানবাহন অচল হয়ে গেলে দ্রুত সেগুলো সরিয়ে ফেলার জন্য চারটি রেকার রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।
সবাই সুশৃঙ্খলভাবে যানবাহন চালালে কোনো সমস্যা হবে না বলে জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা।
তবে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে শুধু রাস্তায় পুলিশ দিলেও হবে না, রাস্তা মেরামতের কাজ শেষ না হওয়ায় মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে যানবাহন নিয়ে বিপাকে পড়তে হয় ফলে দুর্ভোগের আশঙ্কা এবারও রয়েছে বলে জানান তারা।
সরেজমিনে বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে চার লেন চালু থাকলেও পুরো রাস্তায় এখনও চার লেনের সব কাজ শেষ না হওয়ায় ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
উত্তরবঙ্গের প্রবেশ পথে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম প্রান্তে নির্মাণাধীন নলকা সেতুটি মহাসড়কে যান চলাচলের দুর্ভোগের অন্যতম কারণ।
চার লেনের এ ব্রিজের নির্মাণ কাজ শেষ হলেও এখনও পুরো রাস্তার কাজ শেষ না হওয়ায় উত্তরবঙ্গগামী দুটি লেন চালু রাখা হয়েছে। ঢাকাগামী যানবাহনগুলো এখনও পুরোনো সেতু দিয়েই চলাচল করছে ফলে যানবাহনের চাপ বাড়লেও নলকা সেতু এলাকায় যানবাহন চলাচলে ধীরগতি শুরু হয়ে যায়, এবং ধীরে ধীরে পুরো মহাসড়ক জুড়েই যান চলাচলে দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়।
এদিকে দুর্ভোগের এসব শঙ্কা মাথায় নিয়েই মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকেই ঘরমুখো মানুষের চাপ বাড়তে থাকবে বলে জানা গেছে।
বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রওশন ইয়াজদানি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, প্রতিদিন নিয়মিত ১৮ থেকে ২০ হাজার যানবাহন বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে চলাচল করে, ঈদের সময় সে সংখ্যা দ্বিগুণেরও উপরে উঠে যায় ফলে সমস্যার সৃষ্টি হয়।
উপরন্তু চালকরা প্রায়ই দ্রুত পৌঁছানোর তাগিদে নিয়ম ভেঙে ওভারটেক করার চেষ্টা করে ফলে সড়কে শৃঙ্খলা নষ্ট হয়। সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পুলিশ সদস্যরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
বুধবার থেকে ঈদের আনুষ্ঠানিক ছুটি শুরু হলেও মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকেই ঈদে ঘরমুখো মানুষের চাপ বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম মহাসড়কে বাড়তে থাকবে বলে জানান তিনি। এবং গত বছরের তুলনায় এ বছর যানবাহনের চাপ আরও বাড়বেও মনে করেন তিনি।
উল্লেখ্য গত বছর ঈদের আগের চার দিনে বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম মহাসড়ক দিয়ে প্রায় দেড় লাখের বেশি যানবাহন পারাপার হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২০ হাজারের বেশি মোটরসাইকেল রয়েছে। এছাড়া প্রাইভেট যানবাহন রয়েছে।
প্রায় দুই দশক ঢাকায় বসবাসরত শাকিলা আফরোজ জয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই ঈদে বাড়ি ফিরতে রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে হয়েছে। সড়ক পথের দুর্ভোগের জন্য গত বছর ট্রেনের টিকিট কেটেও একইভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এ বছর ট্রেনের টিকিট কাটার আগেই সব শেষ হয়ে গেছে, ফলে বাড়ি ফেরার চিন্তা বাদ দিলেও ঈদ ঘনিয়ে আসায় যেভাবেই হোক বাড়ি ফিরতে হবে বলে জানান জয়া।
যানবাহনের টিকিটের ব্যবস্থা করতে না পারলে প্রয়োজনে ঈদের আগের দিন ভেঙ্গে ভেঙ্গে আরিচা-কাজিরহাট হয়ে বাড়িতে ফিরবেন বলে জানান তিনি।
পশ্চিম রেলের বিশেষ আয়োজন
সড়ক পথের বিড়ম্বনা এড়াতে গত কয়েক বছর ধরেই ট্রেনে যাত্রির চাপ বাড়ছে। ঈদে ঘরমুখো মানুষের কথা চিন্তা করে রেলওয়ের পশ্চিম বিভাগ উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের যাত্রীদের জন্য নিয়মিত চলাচলকারী ট্রেনের পাশাপাশি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে।
রেলওয়ের পশ্চিম জোনের পরিবহন কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ১৮ এপ্রিল মঙ্গলবার থেকেই রেলের ঈদ যাত্রা শুরু হবে। ইতোমধ্যে ১৮ এপ্রিল থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত চার দিন প্রতিদিন ২৬ হাজারের বেশি টিকিট ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। চারদিনের লক্ষাধিক টিকিট শেষ ট্রেন যাত্রার আগে ২০ শতাংশ সিট নাম্বার ছাড়া (স্ট্যান্ডিং টিকিট) বিক্রি করা হবে বলে জানান তিনি। গত বছরের তুলনায় এ বছর রেলেও যাত্রি সংখ্যা বাড়বে বলে জানান তিনি।
রেলের পশ্চিম জোনের পাকশি বিভাগের পরিবহন কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, প্রতিটি ট্রেনেই অতিরিক্ত বগি সংযোজন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সেগুলো রেলওয়ের বিভিন্ন ওয়ার্কশপে প্রয়োজনীয় মেরামতের কাজ করা হয়েছে।
বগি নিয়ে সংকট না থাকলেও ট্রেনের শিডিউল ঠিক রাখা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। পরিবহন কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ হলে শিডিউল টাইমে ট্রেন চলাচল করা কঠিন হয়ে পড়ে। রেল কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে ব্যাপক সতর্কতা নিয়েছে বলে জানান তিনি।
নৌ-পথে আরিচা-কাজিরহাট রুটে ৭টি ফেরি চালু থাকবে
বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পূর্বে উত্তরবঙ্গের মানুষের একমাত্র পথ ছিল আরিচা-কাজিরহাট নৌপথ। প্রাচীন এ নদী পথটি এখন শুধু মালবাহী ট্রাক পারাপারের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে গত কয়েক বছরের যাত্রী চাপ দেখে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্পোরেশন এ বছর আরিচা-কাজিরহাট নৌপথে ৭টি ফেরি চালু রাখবে বলে জানিয়েছে ঘাট কর্তৃপক্ষ।
আরিচা ঘাটের ম্যানেজার আবু আবদুল্লা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, সড়ক পথের দুর্ভোগ আর দূরত্ব কমাতে অনেকেই নদী পথ দিয়ে চলাচল করবে। গত বছর ৪টি ফেরি দিয়ে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ হাজার যাত্রী পারাপার হলেও এবার প্রায় দ্বিগুণ সক্ষমতা নিয়ে ঘাট চালু রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।
Comments