সাদিক আবদুল্লাহর বাদ পড়া ও পরবর্তী ঘটনাক্রম নিয়ে যা জানা গেল
পাঁচ সিটির মেয়র পদে প্রার্থী বাছাইয়ে গত শনিবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড যে আলোচনায় বসে সেখানে প্রাধান্য পায় বরিশাল।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গণভবনে অনুষ্ঠিত সেই বৈঠকে খুলনা, গাজীপুর, রাজশাহী ও সিলেটের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের চূড়ান্ত করতে সময় লাগেনি।
কিন্তু বরিশালের জন্য শেখ হাসিনার সঙ্গে বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ সভাপতির ফুপাতো ভাই আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয়।
এসময় মনোনয়ন বোর্ডের অন্য সদস্যরা নীরব ছিলেন।
অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা যায়, বরিশালের মেয়র পদের জন্য হাসনাত তার ছেলে বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে মনোনীত করতে শেখ হাসিনার কাছে বারবার অনুরোধ করতে থাকেন।
তবে উপস্থিত ৩ জন বোর্ড সদস্য জানান, মনোনয়ন ফরম সংগ্রহকারীদের নাম বৈঠকে রাখার পর হাসনাতের ছোট ভাই আবুল খায়ের আবদুল্লাহকে সমর্থন দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।
বোর্ডের বাকি সদস্যরাও প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছেন।
ছেলের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে হাসনাত বলেন, সাদিক আবদুল্লাহ বর্তমান মেয়র এবং শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী।
একাধিক সূত্র জানায়, এসময় আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, 'মেয়র পদের টিকিট না পেলে সাদিকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে, আমার নিজের ক্যারিয়ারও শেষ হয়ে যাবে।'
তবে শেখ হাসিনা জানিয়েছেন এটি তিনি করবেন না। এসময় বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদিক তার জন্য বা হাসনাতের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবেন না বলেও জানান তিনি, বলেন সভায় থাকা একাধিক সূত্র।
এসময় ছেলেকে বাছাই করা না হলে তাকেও সবকিছু থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে বলেন হাসনাত। তিনিও আর রাজনীতিতে থাকবেন না বলে জানান।
সূত্র জানায়, এক পর্যায়ে হাসনাত অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় শেখ হাসিনা তার ব্যক্তিগত চিকিৎসককে ডেকে পাঠান। চিকিৎসক হাসনাতের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে জানান তার শারীরিক অবস্থা উদ্বেগজনক নয়।
বিরতির পর হাসনাত তার ছেলেকে মেয়র পদে এবং খায়েরকে বরিশাল-১ আসন থেকে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার প্রস্তাব দেন।
জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খায়েরকে মেয়র প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করা হবে এবং সময় হলে আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ড বরিশাল-১ আসনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বলে, বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রক্তক্ষয়ী স্মৃতি স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, গণহত্যায় খায়েরকে গুলি করা হয়েছিল। তারপরও তিনি কিছুই পাননি এবং কখনও কিছু চাননি এবং তাই তাকে একটি সুযোগ দেওয়া উচিত।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গুলি করে হত্যা করে একদল সেনা সদস্য। এদিন খায়ের ও হাসনাতের বাবা আবদুর রব সেরনিয়াবাতকেও তার মিন্টো রোডের বাসায় গুলি করে হত্যা করা হয়।
সেরনিয়াবাত তখন সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী ছিলেন। ওই রাতে তার পরিবারের ছয় জনকে হত্যা করা হয়।
আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ দলের কোনো পদে নেই। তিনি যুবলীগের আগের কমিটির সদস্য ছিলেন। বরিশালেও তার কোনো দলীয় পদ নেই।
খায়ের বরিশাল শহরের স্থায়ী বাসিন্দাও নন এবং মাঝে মধ্যে সেখানে যান।
প্রায় দুই মাস আগে মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বরিশাল যান তিনি এবং দুই ভাই আলাদাভাবে সব কাজ শেষ করেন।
বরিশালে এটি প্রচলিত যে হাসনাত ও খায়েরের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব রয়েছে।
খায়ের নগরীর বাংলাবাজার এলাকায় তার ভাড়া বাসায় মায়ের জন্য অনুষ্ঠানটি করেন।
পরে নগরীর কালীবাড়ি রোডে আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তিনিও ওই বাড়ির একজন, কিন্তু সেখানে তাকে যেতে দেওয়া হয় না।
সূত্র জানায়, নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করতে আগামীকাল বরিশাল যেতে পারেন খায়ের।
হাসনাত আবদুল্লাহ বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্য এবং একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য।
অন্যদিকে সাদিক আবদুল্লাহ বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র হওয়ায় বাবা-ছেলে তাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের কোনো জায়গা না দিয়ে জেলার আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন।
বরিশাল জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে মেয়র প্রার্থী হিসেবে শুধু সাদিকের নাম প্রস্তাব করেছিল। যদিও আরও কয়েকজন মেয়র প্রার্থী ছিলেন। মেয়র পদে মোট সাত জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র কিনেছেন।
বরিশাল মেয়র ও বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর সাদিক আবদুল্লাহ লঞ্চ, স্পিডবোট ও বাস টার্মিনাল দখলের জন্য বদনাম কুড়িয়েছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
২০২১ সালের আগস্টে এক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাড়িতে হামলার ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতির বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
এ ঘটনায় বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনও তাকে গ্রেপ্তারের দাবি জানায়।
এছাড়াও স্থানীয়রা বলছেন, দলের সিনিয়র নেতাদের অসম্মান ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার অনেক অভিযোগও আছে সাদিকের বিরুদ্ধে।
তার মেয়াদকালে তিনি হোল্ডিং ট্যাক্স প্রায় চার গুণ বৃদ্ধি করেন যা নগরবাসীকে ক্ষুব্ধ করে। এছাড়া ভবনের নকশা অনুমোদন প্রক্রিয়া তিনি দীর্ঘায়িত করেছিলেন।
গতকাল সিলেটে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও যুক্তরাজ্য দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী গণভবনে আওয়ামী লীগ সভাপতির সঙ্গে দেখা করেন এবং ফুলের তোড়া দিয়ে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী তাকে মেয়র নির্বাচনের জন্য সর্বাত্মক প্রচারণায় নামতে বলেন ও দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে কাজ করতে বলেন।
আনোয়ারুজ্জামান আজ সিলেটে যাবেন ও আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করবেন।
গাজীপুরের নেতা-কর্মীরা টঙ্গীতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খানের সঙ্গে দেখা করেছেন।
অন্যদিকে খুলনা ও রাজশাহী মহানগরের নেতাকর্মীদের মধ্যে কোনো উত্তেজনা নেই কারণ তারা অনেক আগেই নিশ্চিত হয়েছিলেন যে বর্তমান মেয়ররাই আবারও দলের টিকিট পেতে যাচ্ছেন।
Comments