বিশেষ নিবন্ধ

প্রাণচঞ্চলে বর্ষবরণ ও কাজী নজরুল ইসলাম

বাঙালির গ্রামীণ-সংস্কৃতিতে কালবৈশাখী ঝড় ধ্বংসের বার্তাবাহক। প্রাণঘাতী কালবৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডব বাঙালির অভিজ্ঞতায় সুখকর ছিলো না বিধায় চৈত্রের শেষে বৈশাখে উৎপন্ন ও প্রবাহিত স্থানীয় ঝড়টির নামকরণ 'বৈশাখী ঝড়' হয়নি, হয়েছে 'কালবৈশাখীর ঝড়'। 'কাল' দ্বারা সময় বা ঋতুকে নয়, নির্দেশিত হয়েছে সর্বনাশ-ধ্বংস-অনাসৃষ্টির নেতিবাচকতা। জীবন যখন কৃষিনির্ভর, মানুষের ঘরবাড়ি যখন বাঁশ-কাঠ-ছন-পাতায় নির্মিত, মানুষের আশ্রয় তখন বড়জোর টিনের চালা কিংবা আধা টিন ও আধা ইটের দেয়াল, তখন কালবৈশাখীর আগমন বিপদজনকই বটে। 

বৈশাখে বজ্রঝড়ের সঙ্গে অতিরিক্ত শিলাবৃষ্টি হলে ফসলের যে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়, তা কখনো কখনো কৃষকের জন্য সারা বছরের কান্না! বৈশাখ আউশ-আমন-বোরো ধানের ও তোষা পাটের মাস হওয়ায় কালবৈশাখী ঝড় প্রায়শই বাঙালির আশংকার কারণ। কালবৈশাখী ঝড়ে লণ্ড-ভণ্ড হওয়ার আশংকা থাকলেও ঋতুচক্রে বৈশাখ বাঙালির বর্ষবরণের মাস। 

খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে প্রথম মেসোপটেমিয়ায় নববর্ষের প্রচলন ঘটে। জুলিয়াস সিজার ইংরেজি নববর্ষের প্রবর্তন করেন খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ অব্দে। বাংলা নববর্ষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সম্রাট আকবরের নাম। হিজরি চান্দ্র মাস ও বাংলা সৌরসনকে ভিত্তি করে প্রবর্তিত বাংলা সন তার সিংহাসনে আরোহণের সময়কাল ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে কা‌র্যকর হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বাংলা সন প্রথমে 'ফসলি সন' ও পরে 'বঙ্গাব্দ' নামে পরিচিতি পায়। মুঘোল আমলে বৈশাখের প্রথম দিন 'পুণ্যাহ' উৎসবে বাংলার ভূস্বামীরা কৃষক-সাধারণের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করতো বলে জানা যায়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর জমিদারদের বিলুপ্তি ঘটলে 'পুণ্যাহ' উৎসব 'হালখাতা' অনুষ্ঠানে নূতন মাত্রা পায়। 

জীবন-জীবিকা, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রকৃতিনির্ভর বাঙালি সংস্কৃতিচেতনার রূপায়ণ ঘটেছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায়। যে কারণে কালবৈশাখী ঝড় ও বৈশাখবরণ তার কবিতায় শুধু অনন্য কাব্যরূপই পায়নি, হয়েছে ভীষণভাবে ও নূতনরূপে আদৃত। কালবৈশাখী ঝড় ও বৈশাখবরণ নজরুলের কবিতা বাঙালির চিন্তা-চৈতন্য ও অন্তঃকরণে যে নব তরঙ্গ এনেছে, তা আর কোথাও নেই। কালবৈশাখী ঝড়কে সর্বনাশ-ধ্বংস-অনাসৃষ্টির নেতিবাচকতা থেকে অবমুক্ত করে উজ্জীবনের প্রতীকরূপে প্রতিষ্ঠা করেছেন নজরুলই।

কালবৈশাখী ঝড়ের শব্দবন্ধ কিংবা চিত্রকল্প নজরুলের অনেক কবিতাতেই বিদ্যমান। তার বিখ্যাত অগ্নি-বীণা কাব্যগ্রন্থের 'বিদ্রোহী' কবিতায়ও রয়েছে কালবৈশাখীর ঝড়-তরঙ্গ :

আমি   ধূর্জটি, আনি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর!

আমি   বিদ্রোহী আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাত্রীর!

বল   বীর—

চির   উন্নত মম শির!

এখানে শিবের ধূম্ররূপী-রূপ ধূর্জটির সঙ্গে একজন আরাধ্য বীর সমার্থক হয়েছে। শিবের মাথার জটায় তথা ধূর্জটি-জটা-জালে নদীরূপিনী দেবী গঙ্গাকে অবরুদ্ধ করে রাখার পৌরাণিক আখ্যান বিনির্মাণ হয়েছে সৃষ্টির অভিপ্রায়ে। অকাল-বৈশাখীর ঝড় শুধু ধ্বংসই নয়, তা সৃষ্টির বার্তাবহ— মহাপ্রলয়ের নটরাজ-শিব-ধূর্জটির চিত্রকল্পে সে-কথাই প্রকাশমান।

'বিদ্রোহী' কবিতায় ঝড়ের আর একটি রূপকল্প রয়েছে; কিন্তু তা কালবৈশাখী কি-না, নির্দেশিত হয়নি। পূর্বাপর আলোচনা ও ব্যাখ্যা থেকে বলা যায়, এই ঝড় কালবৈশাখীর অনুগামী। কালবৈশাখী ঝড় থেকে ধ্বংস ও সৃষ্টির যে গতিতত্ত্ব ও জীবনমন্ত্র কবি লাভোদ্ধার করেছেন, তাই হয়েছে তার কবিসত্তার প্রেরণা ও পাথেয় :

ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া

স্বর্গ-মর্ত-করতলে,

তাজি  বোররাক আর উচ্চৈশ্রবা বাহন আমার

হিম্মৎ-হ্রেষা হেঁকে চলে!

'ঝড়' নামক একটি দীর্ঘকবিতা রয়েছে নজরুলের বিষের বাঁশী কাব্যগ্রন্থে। যেখানে তক্ষক-ঝড়ের রূপকে আত্মজাগরূক দ্রোহী কবির সমাজবিপ্লবের এষণা হয়েছে বাঙ্ময় : 

ঝড়— ঝড়— ঝড়   আমি— আমি   ঝড়—

ক্কড়ক্কড় ক্কড়্—

বজ্র-বায়ু দন্তে-দন্তে ঘর্ষি চলি ক্রোধে!

ধূলি-রক্ত বাহু মম বিন্ধ্যাচল সম রবি-রশ্মি-পথ রোধে।

এখানে ঝড়ের বেগ ক্রোধে রূপান্তরিত হয়েছে এবং সেখান থেকে উৎপন্ন হয়েছে দাঁতে দাঁত ঘর্ষণের ধ্বনিরূপম। বিন্ধ্যাচল পর্বত যেমন রবি-রশ্মির পথ রোধে সক্ষম তেমনি শক্তি-সামর্থ্য-সম্ভাবনায় উন্নত হয়েছে ঝড়-রূপী কবির মনোবাঞ্ছা। কবিতাটির শেষ স্তবকে 'তক্ষক-ঝড়' ও 'লাল-ঘোড়া' হয়েছে সমার্থক, একে অপরের পরিপূরক এবং একই চেতনাজাত।

'কাল-বৈশাখী' নামক নজরুলের একটি কবিতা সংযুক্ত হয়েছে সন্ধ্যা কাব্যগ্রন্থে। 'সন্ধ্যা' এখানে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা-সূর্যহীন সময়ের প্রতীক। যে কারণে কবির কল্পনায় কালবৈশাখী ঝড় এখানে জ্বালা নিয়ে আসেনি; আসলে তা হতো জীবন-রঙ্গে অন্য এক ভারতভূমি :

কাল-বৈশাখী আসিলে হেথায় ভাঙিয়া পড়িত কোন্ সকাল

ঘুণ-ধরা বাঁশে ঠেকা-দেওয়া ঐ সনাতন দাওয়া, ভগ্ন চাল।

এলে হেথা কাল-বৈশাখী

মরা গাঙে যেত বান্ ডাকি,

বদ্ধ জাঙাল যাইত ভাঙিয়া, দুলিত এ দেশ টালমাটাল।

শ্মশানের বুকে নাচিত তাথৈ জীবন-রঙ্গে তাল-বেতাল।। 

রূপকীঅর্থে ভগ্ন চাল, মরা গাঙ আর বদ্ধ জাঙাল সরাতে কালবৈশাখী ঝড়ের স্বপ্ন-প্রত্যাশী কবি নজরুলের সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থের নাম ঝড়। এ-গ্রন্থের প্রথম কবিতার নাম 'উঠিয়াছে ঝড়'। যেখানে ঝড়ের আর্তনাদে মূর্ত হয়েছে জাতীয় জাগরণ ও উদ্দীপনাসূচক মুক্তির আহ্বান, মুক্তির বার্তা :

উঠিয়াছে ঝড়, কড় কড় কড় ঈশানে নাকাড়া বাজিয়া তার,

ওরে ভীরু, ওঠ, এখনি টুটিবে ধমকে তাহার রুদ্ধ দ্বার!

এখানে ঝড়-ভীতু ভীরুদের জাগরূক হয়ে মুক্তির প্রত্যয়ে প্রলয়-রণের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কবি। ঝড় এখানে উন্মেষ ও জাগরণ, ঝড় এখানে মুক্তি, ঝড় এখানে রুদ্ধ দ্বার ভেঙে প্রাণ বিকাশের দ্যোতক। 

কালবৈশাখী ঝড় ও বৈশাখবরণ বিষয়ক কাজী নজরুল ইসলামের শ্রেষ্ঠতম কবিতার নাম 'প্রলয়োল্লাস'। অগ্নি-বীণা কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা এটি। বহু ব্যঞ্জনায় অভিব্যঞ্জিত কবিতাটির প্রথম স্তবকেই ধ্বনিত হয়েছে নবীনের পতাকাবাহী কালবৈশাখী ঝড়ের আগমন ধ্বনি ও অভিনন্দন প্রক্রিয়া:

তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!

তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!

ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল্-বোশেখির ঝড়।

তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!

তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!

এখানে 'নূতন' ও 'কাল্-বোশেখির ঝড়' তারুণ্যের নির্দেশক। নতুন ও পুরাতন, নবীন ও প্রবীণ, তারুণ্য ও বার্ধক্যের প্রকৃতিগত দ্বন্দ্ব এবং নতুন-নবীন-তারুণ্যের অনিবার্য জয়ের মহিমা হয়েছে কীর্তিত, কাব্যরূপময়। কবি কালবৈশাখীর মধ্যে অনাগত প্রলয়-নেশার যে নৃত্য-পাগল নবীন বা তারুণ্যকে অবলোকন ও আকাঙ্ক্ষা করছেন, সে বা তিনি বা তারা সিন্ধু-পারের সিংহ-দ্বার ভেঙে উদ্ধার ও অবমুক্ত করবে মৃত্যু-গহন অন্ধ-কূপের মৃতবৎ নির্জীব মানুষদের। এই মানুষগুলো যে আমিত্বহীন, আত্মজাগরণ ও চৈতন্যরহিত, এরা যে জীর্ণ-বৃদ্ধ-ভীরু-পরাধীন-পদাবনত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এ কবিতায় কবি সর্বনাশ-ধ্বংস-অনাসৃষ্টির নেতিবাচকতার বিপরীতে কালবৈশাখী-সদৃশ নূতন-নবীন-তরুণদের দেখলেন ও দেখালেন সৃষ্টি ও মুক্তির দূতরূপে। অসুন্দরকে ছেদন করতে, জীর্ণ আর পুরাতনকে ভাঙতে, সিংহ-চিহ্নিত প্রবল রাজশক্তিকে প্রতিহত করতে ভয়ঙ্করের বেশে বজ্র-শিখার মশাল জ্বেলে যে নব-শক্তির আবির্ভাব কবি-কল্পনায় ও প্রকৃতিলোকে উদ্ভূত— কবির চেতনায় তা সুন্দর, চির-সুন্দর! কবির যুক্তি, আকাঙ্ক্ষা, উল্লাস ও আহ্বানের আরেকটি অনন্য স্তবক :

ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর? —প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন!

আসছে নবীন— জীবন-হারা অ-সুন্দরে করতে ছেদন!

তাই সে এমন কেশে বেশে

প্রলয় বয়েও আসছে হেসে—

মধুর হেসে!

ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির-সুন্দর!

তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!

তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!

কবিতাটির শেষ স্তবকে কবি অভিব্যঞ্জনার আশ্রয়ে নতুন বছরে প্রথম মাস বৈশাখকে ও বৈশাখের নির্দেশক কালবৈশাখী ঝড়কে এবং কালবৈশাখী-রূপী নূতন-নবীন-তরুণকে বরণ করলেন বাঙালি-চেতনায়, বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-প্রথায় :

ঐ ভাঙা-গড়া খেলা যে তার কিসের তবে ডর?

তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!—

বধূরা প্রদীপ তুলে ধর্!

কাল ভয়ঙ্করের বেশে এবার ঐ আসে সুন্দর!—

তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!

তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!

এখানে প্রদীপ প্রজ্বলনে মাঙ্গলিক শোভাযাত্রা কিংবা অভিযাত্রার বিষয়টি এসেছে। নারী ও পুরুষের যুগ্মরাগে যে আনন্দধ্বনি, সেখানে সৃষ্টি ও উর্বরতার প্রতীক হিসেবে নারী-বধূ-রমণীরা হয়েছে অগ্রগামী। 

নজরুলের কবিতায় বৈশাখ বহু আদৃত একটি বাংলা মাস। নির্জীব ভারতবর্ষে শৈত্যপ্রবাহে শীতল বাঙালিকে বৈশাখের রৌদ্রকরোজ্জ্বল দীপ্তিতে রাঙিয়ে তুলতে এবং বৈশাখী গতিতে প্রাণচঞ্চল করতে নজরুলের কাব্যপ্রয়াস লক্ষ্য করা যায় প্রথমাবধি। তার এই প্রয়াস শেষ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে একই চেতনায়। এইভাবে বৈশাখ সব সময়ই সুন্দরের আধার— ধ্বংসোত্তর সৃষ্টির দ্যোতক। তার ভাবনায় কালবৈশাখী ঝড় বৈশাখেরই প্রবলতম আগমনী-সংগীত— জরাগ্রস্ত-পুরাতনবিরুদ্ধ ভয়ঙ্কর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধক।

Comments

The Daily Star  | English

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

2h ago