বছরের প্রথম প্রান্তিকে গাড়ি বিক্রি কমেছে ৩১ শতাংশ
বেশি দাম এবং সার্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে গাড়ি বিক্রি উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে বলে জানিয়েছেন এ শিল্পখাত সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) তথ্যে দেখা যায়, জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে ২৮৬৭টি গাড়ি বিক্রি হয়েছে। প্রতি মাসে গড়ে বিক্রি হয়েছে ৯৫৫ ইউনিট। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১৩৯১টি। এই পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের একই প্রান্তিকের তুলনায় গাড়ি বিক্রি কমেছে ৩১ শতাংশ।
শিল্পখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন গত তিন মাসের গড় বিক্রি এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম।
বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বলেন, এই বছরের প্রথম প্রান্তিকের বিক্রি গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। এমনকি মহামারির কারণে লকডাউনের কারণে ব্যবসায় ক্ষতি হলেও গড় বিক্রি এর চেয়ে ভালো ছিল।
২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারির সবচেয়ে খারাপ সময়েও প্রতিমাসে গড় বিক্রি ছিল ১০৩৩ ইউনিট করে।
এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দাম বৃদ্ধি, তারল্য সংকটের কারণে মানুষ বিলাসবহুল পণ্য কিনছেন না। অন্যদিকে আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় চাহিদামতো গাড়ির মডেলও বাজারে পাচ্ছে না গ্রাহক।
ডলারের ঘাটতির কারণে গত এক বছরে টাকার মান কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। সেইসঙ্গে ডলারের দাম বাড়ার কারণে গাড়ির দাম বেড়ে গেছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ।
গত এক বছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০ শতাংশ কমে যাওয়ায় ডলার সংকটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি, বিশেষ করে অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল পণ্য আমদানি কমাতে নিয়ম কঠোর করতে বাধ্য হয়।
গত বছরের জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে বিলাসবহুল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলার সময় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত অগ্রিম নিতে বলেছিল। অর্থাৎ বিদেশ থেকে গাড়ি আনতে এলসি খুলতে গাড়ি আমদানিকারকদের শতভাগ মার্জিন দিতে হবে।
শহিদুল ইসলাম বলেন, এতে করে গত কয়েক মাসে আমদানি কমেছে অন্তত ৬০ শতাংশ।
তারপরও টাকার বিপরীতে ডলার আরও শক্তিশালী হতে পারে এই আশঙ্কায় কিছু খুচরা বিক্রেতা বেশ ভালো সংখ্যক গাড়ি আমদানি করেছে।
তাদের আশঙ্কা অমূলক নয়, কারণ টাকার অবমূল্যায়নের জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক সরবরাহে বাধা, পণ্যের উচ্চমূল্য এবং জ্বালানি সংকটের মতো বিষয়গুলো এখনও বিদ্যমান।
রিকন্ডিশন্ড গাড়ির আমদানিকারক এইচএনএস গ্রুপ জানিয়েছে, গত তিন মাসে তাদের বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। কোম্পানিটি সাধারণত প্রতি মাসে প্রায় ১৩০টি ইউনিট বিক্রি করে তবে এটি এখন প্রতি মাসে ৬০ থেকে ৭০ ইউনিটে নেমে এসেছে।
এইচএনএস গ্রুপের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম বলেন, ব্যবসায়ীরা শতভাগ মার্জিন দিলেও ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে আগ্রহী নয়।
মোটরসবে লিমিটেডের বিক্রি এই বছর প্রায় ৪০ শতাংশ কমেছে।
রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানিকারকের স্বত্বাধিকারী আরিফ খান বিপু বলেন, সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে গাড়ি কেনা বন্ধ করে দিয়েছে।
'এটি গাড়ির বাজারে প্রভাব ফেলেছে। এছাড়া, আমরা এলসি খুলতে পারছি না। তাই, গত কয়েক মাসে গাড়ির বিক্রি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।'
বিপু বলেন, বাংলাদেশের জন্য রিকন্ডিশন্ড গাড়ির প্রধান সরবরাহকারী জাপান থেকে গাড়ির চালান আসতে দেরি হচ্ছে কারণ রপ্তানিকারকরা পেমেন্টের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার আগে শিপমেন্ট করেন না।
দাম কমাতে এবং বর্তমান কঠিন সময়ে শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারকে আগামী বাজেটে হাইব্রিড গাড়ি ও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মাইক্রোবাসের শুল্ক পুনর্গঠনের পরামর্শ দেন তিনি।
তিনি বলেন, 'জ্বালানি খরচ কমাতে এবং পরিবেশ রক্ষায় সরকারের হাইব্রিড গাড়ি আমদানিতে উৎসাহিত করা উচিত।'
সেইসঙ্গে উচ্চবিত্তরাই যেহেতু বেশি দামের গাড়ি কেনেন তাই এ ধরনের গাড়িতে শুল্ক বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
জার্মানির অডি-ব্র্যান্ডের গাড়ির পরিবেশক প্রোগ্রেস মোটরস ইমপোর্ট লিমিটেড-এর কান্ট্রি প্রধান (বিক্রয়) সাফায়েত বিন তৈয়ব বলেন, দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রিমিয়াম এবং নন-প্রিমিয়াম গাড়ির বিক্রি কমে গেছে।
তার তথ্য মতে, কোম্পানিটি আগে প্রতি মাসে ১২টি গাড়ি বিক্রি করত যেখানে এখন এটি ছয় থেকে সাতটিতে নেমে এসেছে।
তবে, সাফায়েত বলেন, অডি গাড়ির চাহিদা আছে কিন্তু এলসি খুলতে অসুবিধার কারণে প্রয়োজনীয় সংখ্যক গাড়ি আমদানি করতে না পারায় চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
একই কথা বলেন সুজুকি কার বাংলাদেশের চিফ অপারেটিং কর্মকর্তা চিরঞ্জীব রায়।
তিনি বলেন, আমরা চাহিদা অনুযায়ী সুজুকি গাড়ি আনতে পারছি না।
শহিদুল ইসলাম এবং সাফায়েত বিন তৈয়ব দুজনই পরিস্থিতি উন্নয়নের কোনো আশু সম্ভাবনা দেখছেন না বলে জানান।
শহিদুল বলেন, 'বৈশ্বিক অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। যেহেতু বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে অনেকখানিই একীভূত হয়েছে।
অন্যদিকে সাফায়েত বলছেন, পরিস্থিতির উন্নতি না হলে অটোমোবাইল বাজার এই বছর কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে।
Comments