যুদ্ধের পথে ইরান-আজারবাইজান?
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানি দেশটির উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় প্রতিবেশী আজারবাইজানকে 'পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সুপ্রতিবেশী সুলভ আচরণের' পরামর্শ দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি 'ইসরায়েলসহ আঞ্চলিক শত্রুদের ফাঁদে পা না দেওয়ার' আহ্বানও জানিয়েছেন।
অন্যদিকে, আজারবাইজানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আয়েখান হাজিজাদা ইরানি মুখপাত্রের এমন বার্তার জবাবে বলেছেন, কূটনীতিক শিষ্টাচার না মানায় এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে ১৯৬১ সালের ভিয়েনা সম্মেলনের নীতি লঙ্ঘন করায় আজারবাইজানে ইরানি দূতাবাস থেকে ৪ কর্মীকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আজারবাইজানের হাজিজাদা মনে করেন, ইরানের নাসের কানানি যা বলেছেন তা 'পক্ষপাতমূলক ও আবেগাশ্রিত'।
গত শনিবার ইরানি সংবাদমাধ্যম তেহরান টাইমস এ তথ্য জানিয়েছে।
একই দিনে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক বিশ্লেষণে প্রশ্ন রাখা হয়েছে—আজারবাইজান ও ইরানের উত্তেজনা কি যুদ্ধের দিকে যাচ্ছে?
ইরান-আজারবাইজান সম্পর্ক
ইরান ও আজারবাইজানের সম্পর্ক একদিকে যেমন ঐতিহাসিক, অন্যদিকে তেমনি জটিল। জাতিগতভাবে আজারবাইজানিরা তুর্কি বংশোদ্ভূত। ধর্মীয় দিক থেকে তারা শিয়া মতাবলম্বী।
ইরানের উত্তরপূর্ব ও মধ্যাঞ্চলে বিশাল অঞ্চলজুড়ে আজেরিদের বাস। শব্দগত দিকে থেকে আজেরি অর্থ 'পাহাড়ি তুর্কি'। আজারবাইজান পৃথক রাষ্ট্র হওয়ায় সেখানকার আজেরিরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আজারবাইজানি হিসেবে পরিচিত। তারা ইরানের আজেরিদের মতোই জাতিগত ও ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে এক ও অভিন্ন।
শত শত বছর ধরে মূলত ইরানের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় পূর্ব আজেরিস্তান প্রদেশে বসবাস করেও আজেরিরা প্রভাবশালী ফারসি ভাষা ও সংস্কৃতির কাছে নিজেদের 'তুর্কি' সত্ত্বা বিকিয়ে দেননি। ইরানের সঙ্গে তাদের সংঘাত মূলত রাজনৈতিক অধিকার সংশ্লিষ্ট। ধারণা করা হয়, প্রায় সাড়ে ৮ কোটি জনসংখ্যার দেশ ইরানে মোট জনসংখ্যার ৩ ভাগের একভাগ আজেরি।
ইরান বিশ্বের সব শিয়া মতাবলম্বীদের নেতৃত্ব দিতে চায়। সেই আশায় ইরান সরকার শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিবেশী ইরাকের মতো আজারবাইজানের ওপরও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে আসছে বহু বছর ধরে।
ইরাকের ওপর ইরানের প্রভাব অনেকাংশে সুদৃঢ় হলেও আজারবাইজানের পরিস্থিতি এর বিপরীত।
সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র আজারবাইজান ১৯৯১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর নিজের নিরাপত্তার জন্য ইরানকে হুমকি মনে করতে শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে ইরানের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী তুরস্ক ও ইসরায়েলের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে আজারবাইজান।
ইরান-আর্মেনিয়া সখ্যতা
আজারবাইজানের প্রতিবেশী আর্মেনিয়ার সঙ্গে ইরানের সুসম্পর্ক সুপ্রাচীন। সদ্য স্বাধীন আজারবাইজান নিজ দেশের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলে আর্মেনীয় অধ্যুষিত স্বায়ত্তশাসিত নাগোর্নো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে অপর সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র আর্মেনিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
আর্মেনিয়ার সহায়তায় নাগোর্নো-কারাবাখ প্রথমে নিজেদের আজারবাইজান থেকে স্বাধীন ও পরে আর্মেনিয়ার সঙ্গে একীভূত করার ঘোষণা দিলে অঞ্চলটি বিরোধপূর্ণ হয়ে উঠে। গত ৩০ বছর ধরে সেই সংঘাত চলে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে জাতিগতভাবে মিত্র তুরস্ক আজারবাইজানের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়।
অন্যদিকে, নাগোর্নো-কারাবাখ বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান চেয়ে ইরান তার পুরোনো বন্ধু আর্মেনিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করে চলছে, যা আজারবাইজানের চক্ষুশূল। আবার নিরাপত্তা ইস্যুতে ইসরায়েলের সঙ্গে আজারবাইজানের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা ইরানের শিরঃপীড়ার কারণ।
ইরান-আজারবাইজান উত্তেজনা
ইরান-আজারবাইজান সংকট নিয়ে সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২৭ জানুয়ারি তেহরানে আজারবাইজানের দূতাবাসে সশস্ত্র হামলা হলে প্রতিবেশী দেশ ২টির সম্পর্কের স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবনতি হয়।
এরপর, আজারবাইজান তেহরানে দূতাবাস বন্ধ করে দেয় এবং সব কর্মীকে দেশে ফিরিয়ে নেয়। পাশাপাশি, আজারবাইজানিদেরকে ইরান ভ্রমণে সতর্ক করা হয়।
আজারবাইজান সরকারের অভিযোগ—তাদের দূতাবাসে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। উত্তরে ইরান বলেছে—আটক সশস্ত্র ব্যক্তি প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন যে তিনি ব্যক্তিগত রোষ থেকে হামলা চালিয়েছিলেন।
আজারবাইজানি সরকারের বরাত দিয়ে সরকারপন্থি নিউজ ওয়েবসাইট 'জালিবার' দাবি করেছে, এই হামলার পেছনে ইরানের 'বিশেষ বাহিনী'র হাত ছিল। হামলায় নিহত হন দূতাবাসের নিরাপত্তা কর্মী ওরখান আসকেরভ।
ইরান-আজারবাইজান সংঘাতের কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইরানের আশঙ্কা তার দেশের জাতিগত আজেরিরা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের দিকে ঝুঁকছে। অন্যদিকে, আজারবাইজানের অভিযোগ—ইরান সংখ্যালঘু আজেরিদের নিজ ভাষায় পড়ালেখার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। এ ছাড়া, আজারবাইজানে সরকার পরিবর্তনের চক্রান্ত করছে।
আজারবাইজানের আরও অভিযোগ—নাগোর্নো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে ইরান আর্মেনিয়াকে গোপনে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৩০ বছর ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে আজারবাইজান সুসম্পর্ক ইরান-আজারবাইজান সম্পর্ককে তিক্ত করে রেখেছে।
আলোচনায় ইসরায়েল
তেলসমৃদ্ধ আজারবাইজান ইসরায়েলে অন্যতম শীর্ষ তেল সরবরাহকারী দেশ। সেই তেল বেচা অর্থ দিয়ে আজারবাইজান ইসরায়েল থেকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ড্রোনসহ অন্যান্য অস্ত্র কেনে, যা নাগোর্নো-কারাবাখকে কেন্দ্র করে আজারবাইজান শত্রু আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করে থাকে।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার পর ইসরায়েল আজারবাইজানের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ ছিল।
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন অনুসারে, তেহরানে আজারবাইজানের দূতাবাসে হামলার কয়েক সপ্তাহ আগে আজারবাইজানের পার্লামেন্ট ইসরায়েলে দূতাবাস খোলার বিল পাস করে। বাকুর এই সিদ্ধান্তকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে তেহরান।
যুদ্ধ কি আসন্ন?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরানের সঙ্গে আজারবাইজান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তা ন্যাটো সদস্য তুরস্ককেও যুদ্ধে টেনে আনবে। কেননা, বাকুর সঙ্গে আঙ্কারার প্রতিরক্ষা চুক্তি আছে। ২০২০ সালে আর্মেনিয়ার সঙ্গে আজারবাইজানের দ্বিতীয় যুদ্ধে তুরস্ক প্রকাশ্যে আজারবাইজানকে সমর্থন দেয়। আবার, রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি আছে আর্মেনিয়ার। সেই অনুযায়ী, আর্মেনিয়ায় কোনো হামলা হলে এগিয়ে আসতে হবে রাশিয়াকে।
এমনকি, যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ করতে রুশ সেনাদের পাশাপাশি তুর্কি সেনারাও নাগোর্নো-কারাবাখে অবস্থান করছে।
শুধু তুরস্কের সঙ্গেই নয়, গ্যাস সরবরাহ করে ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করে তুলছে আজারবাইজান। প্রতিবেশী জর্জিয়া ও তুরস্কের মধ্য দিয়ে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটার পাইপলাইন তৈরি করে আজারবাইজান গত ৩১ ডিসেম্বর থেকে গ্রিস ও ইতালিসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোয় গ্যাস সরবরাহ করছে।
২০২৭ সাল থেকে গ্যাস সরবরাহ দ্বিগুণ করতে রাজি আজারবাইজান।
এখন প্রশ্ন—এমন পরিস্থিতিতে আজারবাইজান কি ভৌগলিকভাবে বড় দেশ ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে প্রস্তুত? আজারবাইজান কি আর্মেনিয়ার পাশাপাশি ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম?
আজারবাইজান সম্প্রতি তার ৬ নাগরিককে আটক করেছে এবং তারা ইরানের গোয়েন্দাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে দাবি করেছে। এ ছাড়া, আটককৃতদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানচেষ্টার অভিযোগও আনা হয়েছে।
তেহরানভিত্তিক ককেশীয় ও মধ্য এশিয়া বিশ্লেষক ভালি কালেজি সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেন, 'আজারবাইজান ও ইসরায়েলের সুসম্পর্কের পেছনে অনেক কারণ আছে। সবগুলোকে সরাসরি ইরানবিরোধী বলা যাবে না।'
তিনি মনে করেন, পশ্চিমের দেশগুলোয়, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে প্রভাব বিস্তার করতে এবং সেখানে প্রবাসী আর্মেনীয়দের বাকুবিরোধী অবস্থানকে অকার্যকর করতে তাদের প্রয়োজন 'ইহুদি লবি'র। সে জন্যই হয়তো বাকু ক্রমাগতভাবে তেল আবিবের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে চলছে।
তবে, ইরান ও আজারবাইজান যেভাবে নিজেদের সামরিক শক্তি প্রদর্শন করে চলছে তা একে অপরের প্রতি সরাসরি হুমকি বলে ধরে নেওয়া যায় বলে মনে করেন তিনি।
সাম্প্রতিক সংবাদ প্রতিবেদনে জানা যায়, ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড ও সেনাবাহিনী আজারবাইজান সীমান্তের কাছে কয়েক দফা উচ্চপর্যায়ের মহড়া করেছে। মহড়ায় সেনা ও বিমান বাহিনীর দক্ষতা প্রদর্শন করা হয়।
গত অক্টোবরে বিপ্লবী গার্ড আজারবাইজান ও ইরান সীমান্তে আরাস নদীতে অস্থায়ী সেতু তৈরি করে বাকুকে কঠিন বার্তা দেয়।
এর কয়েকদিন পর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুসেইন আমিরআবদোল্লাহিয়ান আর্মেনিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় সিউনিক প্রদেশে কনসুলেট উদ্বোধন করে বলেন, আর্মেনিয়ার নিরাপত্তা আর ইরানের নিরাপত্তা এক সুতোয় বাঁধা।
বিশ্লেষক ভালি কালেজি বলেন, 'গত ৩০ বছরের বেশি সময় ধরেই তেহরান-বাকু উত্তেজনা বিরাজ করছে। এখন পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। তবে তা সামরিক সংঘাতের দিকে নাও যেতে পারে। কেননা, আজারবাইজানের দূরবর্তী নাখচিভান প্রদেশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে দেশটিকে ইরানের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করতে হয়।'
তিনি মনে করেন, ইউক্রেন যুদ্ধের পর রাশিয়া ও তুরস্ক প্রতিবেশী ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে। এ ছাড়া, ইরানের সঙ্গে 'চির প্রতিদ্বন্দ্বী' সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চীন মধ্যস্থতা করছে। ইরান-আজারবাইজান যুদ্ধ বাধলেও তারা নিশ্চয় মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে আসবে।
গতকাল বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়—ইরান ও আজারবাইজানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ২ দেশের মধ্যে 'ভুল বোঝাবুঝি ও সমস্যা' দূর করতে ফোনালাপ করেছেন।
রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থাটি জানায়, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুসেইন আমিরআবদোল্লাহিয়ান ও আজারবাইজানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেয়হুন বৈরামভ 'খোলামেলা আলোচনায় বিদ্যমান সমস্যা, ভুল বোঝাবুঝি ও এসবের সমাধান নিয়ে কথা বলেছেন।'
তাহলে যুদ্ধের প্রসঙ্গ কেন?—এর জবাবে স্মরণ করা যেতে পারে যে, ইরান সরকারের সবসময়ের আশঙ্কা দেশটির ক্ষতি করতে সদা প্রস্তুত ইসরায়েলের প্ররোচনায় বা উসকানিতে আজারবাইজানের সঙ্গে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ বেধে গেলে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না। এ প্রসঙ্গে আরও স্মরণ করা যেতে পারে যে পশ্চিমের প্ররোচনায় ১৯৮০ সালে প্রতিবেশী ইরাক আকস্মিক হামলা করে ইরানের ওপর, যা দীর্ঘ ৮ বছর ধরে চলেছিল।
Comments