দূরদর্শী বন্ধু আমার, সাহিত্যিক আলী ইমাম
সাহিত্যিক আলী ইমামের সঙ্গে পরিচয় হয় ১৯৬৭ সালের পর। কীভবে কোথায়, কার মাধ্যমে– এখন আর মনে নেই। সম্ভবত সে সময় দেশের একমাত্র কিশোর সাহিত্য মাসিক সবুজ পাতায় কর্মরত, সংগঠক শেখ তোফাজ্জল হোসেনের কিশোর সাহিত্য মজলিশ এর পুরানা পল্টনের সাহিত্যসভায়। "তোফাজ্জল ভাই" মূলত বৃহত্তর পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশে থেকে পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসা জ্যৈষ্ঠ এক কিশোর। কিছুটা অল্প বয়সেই আয় উপার্জনের জন্য শহরে এসেছিলেন।
সেখানে বিভিন্ন ধরণের কিশোর ভিন্ন শিশু সংগঠনের হলেও– সকলের আগমন ছিল অবারিত। আমি নিজে খেলাঘরের, আলী ইমাম কচিকাঁচা আসরের। সেভাবে আলী ইমামও আসতেন- আমিও যেতাম। সম্ভবত সেখানেই তার সঙ্গে পরিচয়। ঐ সাহিত্য সভাগুলোর প্রত্যেকটার দুটো অংশ হতো। প্রথম অংশে যারা আসতো, তারা স্বরচিত লেখা পড়তো। তারপর চা মুড়ি খাওয়া হতো, মাঝে মাঝে অল্প কিছু পেঁয়াজু থাকতো। আবার দ্বিতীয় অংশে লেখায় যারা অগ্রসর, তাদের ২/৩ জন ১ম অংশে পঠিত লেখাগুলোর গঠনমূলক সমালোচনা করতো। আমিও প্রায়ই এরকম সমালোচনার জন্য যেতাম, আলী ইমামও তেমন।
আমার প্রথম লেখা ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়–সবুজ পাতার মূল অংশে। যেখানে প্রতিষ্ঠিত লেখকরা প্রকাশিত হতেন। বাকী কিশোরদের লেখা ছোটদের পাতায়। এ কারণে আমাকে সতীর্থরা একটু আলাদা সম্মান দিতো বলে মনে হয়। কিন্তু আমি আলী ইমামের মতো আমার চেয়ে বেশ সাহিত্য পড়াদের অত্যন্ত সম্মান করতাম। ফলে ঢাকার উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের লালমাটিয়া মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে পুরনো ঢাকার ঠাঠারি বাজারে আলী ইমামের বাসায় চলে যেতাম। সব সময়ই উনি চা, ছানার মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। মাঝে মাঝে দুপুরের খাবারেরও ব্যবস্থা করতেন। তার বসবার ঘরের দেয়ালগুলো বইয়ে পরিপূর্ণ ছিল। প্রায়ই তিনি ঐ সব তাক থেকে একটি বই উপহার দিতেন– তার ভেতরে হাতের লেখায় সুন্দর কোন বাক্য, আমার নামসহ। দুঃখের বিষয়– যুদ্ধ, বারংবারের প্রবাস, আর গৃহহীনতাসহ জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাতে আমার নিজের সব সংগ্রহ সম্পূর্ণই হারিয়ে যায়। অন্যান্য মূল্যবান বইসহ আলী ইমামের উপহারও হারিয়ে গেছে।
বইগুলো হারিয়ে গেলেও হারানো বইয়ের বিষয়বস্তু, আর আলী ইমামের সঙ্গে দেখা হওয়ার স্মৃতি ও যা শিখেছিলাম, তা হারায়নি। আজীবনের সঙ্গী হয়ে রয়ে গেছে। আমার নিজের চিন্তা চেতনা বিকাশের অংশ হয়েছে– সেটা হয়তো তিনিও বোঝেননি। আমিও অতি সম্প্রতিই শুধু সেটা আন্দাজ করতে পারি। আমার চিন্তা চেতনার উন্মেষে তার অবদান হলো- দেশভাগ পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলাসাহিত্য, আর দেশভাগ পূর্ববর্তী ইতিহাসের নেতাজী সুভাস বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের উপনিবেশবাদ-বিরোধী বিপ্লবী চেতনা– আর এসবের ভেতর দিয়ে জাতিসত্বা হিসেবে বাঙালীয়না– এই তিনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। তার এই ভূমিকা ভুলতে পারি না।
দুই
আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে সুদূর বেলুচিস্তানে। সেখানে ভাষা সৈনিক বাবা মা আমার ভেতরে বাঙলা ভাষা আর সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বাঙালীয়ানার চেতনা লালন করেছিলেন। বাবা সেখানে কর্মযোগে আসা কিছু বাঙালিকে নিয়ে হলেও বাঙলা সাহিত্য সম্মেলনী' নামে একটি ছোট্ট সমিতি চালাতেন– তার আয়োজনে প্রতি বছর রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী পালন, বছরে রাতব্যাপী একটি বাংলা নাটক মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করতেন, মায়ের সম্পাদনায় বোলানের ডাক নামে ষাণ্মাসিক পত্রিকাও প্রকাশ করতেন।
যা ছিল দুই বাংলার বাইরে সম্ভবত প্রথম, তা না হলে দ্বিতীয় বাঙলা সাময়িকী। ঢাকা থেকে বাংলা বর্ণমালার আর অন্য বই আনিয়ে ৪/৫ বছরের আমাকে তা শিখতে উদ্বুদ্ধ করতেন। মা ভাষা আন্দোলনের গল্প বলতেন। বাবা এক সময় রবীন্দ্রনাথের কাছে তার কবিতা দেখাতেন – রবীন্দ্রনাথের কথা বলতেন, কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা শেখাতেন, "থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে– দেখব এবার জগতটাকে", সামরিক কায়দায় ছন্দে ছন্দে "চল চল চল"ও শেখাতেন। কিন্তু এসবের ভেতর দিয়েও সাংস্কৃতিক বাঙালীয়ানার ঊর্ধ্বে জাতিসত্বাগত বাঙালীয়ানার যে দিকের সঙ্গে আলী ইমাম পরিচয় করিয়ে দেন, সেখানে সেটা ছিল না। নেতাজির "আজাদ হিন্দ ফৌজ" বর্মায় এসে পৌঁছালে বাবা বর্মাতে যুদ্ধে যোগ দিতে গিয়েছিলেন, কিন্তু বাবা আমাকে নেতাজীর সঙ্গে সেভাবে পরিচিত করে দেননি আলী ইমাম যেভাবে দিয়েছি।
বাবা রবীন্দ্রনাথ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের কোন লেখকের পরিচিত করে দেননি, যেভাবে আলী ইমামের মাধ্যমে হয়েছি। তিনি হয়তো সাহিত্যের বিস্তারিত শেখাননি– শুধু সূচনামূলক একটু আধটু কথাচ্ছলেই বলেছেন– তারই পথ ধরে ওসব জগতের পথ যেন উন্মুক্ত হয়। আর তারই পথ ধরে ওসব বিষয়ে পরে আরও পড়াশোনা হয়, দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপ্তি যা আন্তর্জাতিকতাবাদী মানবতাবাদে রূপ নেয়।
তিন
ষাটের দশকে শেষে হঠাৎ শুনলাম– আলী ইমাম বিয়ে করেছেন। সে সময় আমাদের মত মধ্যবিত্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে আয় উপার্জন শুরু করার আগে কেউ বিয়ে করত না। প্রেম করে বিয়ে করাটাও স্বাভাবিক ছিল না। আরও শুনলাম কনে শিশু সাপ্তাহিকী টাপুর টুপুর-এর সম্পাদক এখলাসউদ্দীন আহমদের অতীব সুন্দরী স্বল্পবয়ষ্কা ভাগ্নি। নতুন ভাবীর নামটা এখন ভুলে গেছি। আলী ইমামও সুন্দর ছিলেন। মাথাভরা কোঁকড়া চুল, আর সদাই হাস্যোজ্জ্বল চেহারা।
আলী ইমামের নিজের বাড়ী কুমিল্লায়। এখলাস ভাইর ভাগ্নির বাড়ী বোধ হয় চাটগাঁয়ে। আবার এমনও শুনেছিলাম এখলাসউদ্দীন পশ্চিমবঙ্গের ছিলেন, যেখান থেকেই বোধ হয় উনি অনেক টাকা নিয়ে এসেছিলেন বলেই হঠাৎ করে টাপুর টুপুরের মত খুবই উন্নত সাপ্তাহিকী প্রকাশ করতে পেরেছেন বলে শুনেছি।
তবে সে সময় আমরা সব কিশোর তরুণ সতীর্থ কবি সাহিত্যিকদের কেউ কেউ খুব বেশী লেখালেখি শুরু করেছিলাম। আলী ইমাম আর আমিও এদের ভেতর ছিলাম। সকলেই পত্রপত্রিকায়ই লিখছিলাম। মঞ্চ নাটকেও কেউ কেউ ব্যস্ত হয়েছিলাম। আমি বেলুচিস্তানের শৈশবেই মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেছিলাম। আলী ইমামও কিছু নাটকে কাজ করেছিলেন। এর মধ্যে রেডিওর জন্যও নাটক লিখতে ও প্রযোজনা শুরু করলাম। আলী ইমাম সেখানেও খুব একটা এলেন না। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই টেলিভিশনে যোগ দিলেন। নানান বিষয় চিন্তা করেই তিনি টেলিভিশনেই আত্মনিয়োগ করলেন। কালক্রমে হয়ে উঠলেন টেলিভিশনের লব্ধ প্রতিষ্ঠিত প্রযোজক।
আলী ইমামের সুদূরপ্রসারী দূরদর্শী কথা ও চিন্তা বুঝেও টেলিভিশনের দিকে যাইনি আমি। ১৯৬০ সালে দেশে টেলিভিশন শুরু হলে, দেশের জ্যৈষ্ঠ বেতার প্রকৌশলী হিসেবে বাবাকে সরকার টেলিভিশন প্রকৌশলী হিসেবে ইউরোপে পাঠাতে চাইলে, তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন, টেলিভিশনের মাধ্যমে দেশে বিদেশী অপসংস্কৃতিতে ভাসিয়ে দেয়ার সম্ভাবনা দেখেন। আমিও প্রায় দেড় দশক পরে তারই এক শিষ্যের অনুরোধে, টেলিভিশনে শুধু মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে অংশ নেয়নি।
লেখালেখির জগতে আমরা সতীর্থ প্রায় সকলেই যখন পত্রপত্রিকায় লিখতে থাকি। প্রতি সপ্তাহেই বেশ কয়েকটি লেখা প্রকাশিত করে, লেখার নতুনধারাও সৃষ্টি করি, সাপ্তাহিক বিচিত্রার কলামিস্ট হিসেবে অসাধারণ জনপ্রিয়ও হই। আলী ইমাম মনোনিবেশ করেন নিরবিচ্ছিন্নভাবে শিশুসাহিত্যে। ফলে আমার লেখা সহস্রাধিকও হলেও কিন্তু আমাদের সতীর্থদের ভেতর আলী ইমাম তুলনামূলক স্থায়ী হয়ে রইল, আর আরেকটু কম হলেও যুক্ত আছেন মুনতাসীর মামুন ও শাহরিয়ার কবির।
চার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে একই তলার পাশাপাশি আলী ইমাম বাংলায়, আমি আন্তর্জাতিক সম্পর্কে– পড়াশোনা করি। আমি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্র হলেও উনার মতই বাংলার ক্লাসে গিয়েও বসতাম– বিশেষ করে মুনীর চৌধুরী স্যারের ক্লাসে। উনি বয়সে আমার দু'এক বছর বড় হলেও, যতদূর মনে পড়ে আমরা একই বর্ষের ছাত্র ছিলাম।
শাহরিয়ার কবিরও আমাদেরই বর্ষে, আলী ইমামের মতই বাংলায় ছিল। মুহম্মদ জাহাঙ্গীর, নাসিম সিদ্দিকী, শামীম তরফদারও বাংলায়ই ছিল। মুনতাসীর মামুন আমাদের এক বছর ওপরে, ইতিহাসে ছিল। সে সময় আমার চেয়ে দু'য়েক বছর বড় বা এক আধ বছরের উপরে নিকট বন্ধুদের কিভাবে সম্বোধন করব – এ নিয়ে এক অস্বস্তি হতো। বাঙ্গালি সংস্কৃতিতে বাহক হিসেবে বয়োজৈষ্ঠদের সমীহ প্রকাশের একটি অর্থ ছিল, আছে। শাহরিয়ার খোলাখুলিই বলে দিল পরস্পর "তুমি" বলব, আলী ইমামকে আপনিই বলতাম, উনি আমাকে তুমি বলতেন।
১৯৭৫ সালের স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় রেকর্ড ভঙ্গ করে ১ম হয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পাই। বছর দুয়েকের ভেতর উচ্চশিক্ষার জন্য আমন্ত্রিত হয়ে ফোর্ড স্কলার হিসেবে অস্ট্রেলিয়া ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে যেতে হয়। তাতে শিক্ষকতা, সাপ্তাহিক বিচিত্রার লেখক ঐসবে ছেদ পড়ে– যে সমাজে আলী ইমামরা থাকতো, সেখানের বন্ধুদের সঙ্গেও ছেদ পড়ে।
বছর ৬ আগে তার সঙ্গে শেষ দেখা হয়। সেবার তাকে অসুস্থ মনে হলো। উনার স্বাভাবিক প্রাণবন্ত সদা হাস্যোজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব যেন আর ঠিক ছিল না। এক ধরণের অবসাদে যেন ভুগছিলেন। আমি এমআইটিতে পিএইচডি করবার সময় একই সময় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মনস্তত্ত্বের তত্ত্ব ও তুলনামূলক পদ্ধতিও পড়েছিলাম। তার আচরণ ও অভিব্যক্তি থেকে ওরকমই মনে হচ্ছিল। তার বিষাদ ও অস্থিরতা দূর করতেই, বাউল গান, রবীন্দ্র সঙ্গীত, লালন শাহ আর পারস্যের কবি হাফেজের সম্ভাব্য প্রভাব– বিশেষ করে সিরাজ সাঁইর কথা বলি। তাকে মনে হল কিছুটা উজ্জীবিত হয়ে উঠলেন। এরপর তার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। আর অদেখায় বিদায় নেন...প্রিয় আলী ইমাম।
গবেষক ও প্রাক্তন অধ্যাপক, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়।
Comments