র‌্যাব হেফাজতে মৃত্যু

‘দুই সপ্তাহ ধরে সুলতানার বাড়ি নজরদারিতে ছিল’

সুলতানা জেসমিন। ছবি: সংগৃহীত

নওগাঁ শহরের চকদেব জনকল্যাণপাড়া এলাকার যে বাসাটিতে সুলতানা জেসমিন ভাড়া থাকতেন, গ্রেপ্তারের ২ সপ্তাহ আগে থেকে সেটি নজরদারিতে ছিল বলে জানিয়েছেন বাড়িটির মালিক।

বাড়ির মালিক দেলোয়ার হোসেন দুলাল জানান, ৩ থেকে ৫ জনের একটি দল তার ৩ তলা বাড়ির সামনে কংক্রিটের বেঞ্চে বসে মধ্যরাত পর্যন্ত আড্ডা দিত।

গত শুক্রবার র‌্যাবের হেফাজতে মারা যাওয়া নওগাঁর একটি ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের অফিস সহকারী সুলতানা ৪ হাজার ২০০ টাকা ভাড়ায় ওই বাড়ির দ্বিতীয় তলায় ৬৫০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন।

সুলতানার মৃত্যুর ঘটনায় তীব্র সমালোচনা করেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং গতকাল মঙ্গলবার হাইকোর্ট প্রশ্ন তুলেছেন, আটকের সময় কোনো মামলায় অভিযুক্ত না হওয়ার পরও র‌্যাব তাকে কোন ক্ষমতাবলে তুলে নিয়েছে।

সুলতানার বাসার নিচতলায় থাকেন বাড়িওয়ালা দেলোয়ার। তিনি বলেন, 'রাতে ৩ থেকে ৫ জন যুবক বাসার সামনে বসে থাকা শুরু করলে এলাকায় অস্বস্তি শুরু হয়।'

'একদিন রাত ১১টার দিকে আমার বাসার দরজায় কড়া নাড়ে তারা। ভাড়া নেওয়ার জন্য বাড়িটি দেখতে চায়,' বলেন তিনি।

ওই যুবকদের তখন বাসায় ঢুকতে দেননি জানিয়ে তিনি বলেন, 'তাদের কথা খুব অদ্ভুত লেগেছিল।'

এর কয়েক দিন পর দেলোয়ার হোসেনসহ স্থানীয় কয়েকজন তাদের কাছে গিয়ে জানতে চান, তারা কেন ওই বাড়ির সামনে অবস্থান করছেন।

'তারা আমাদের জানান যে তারা সরকারের লোক এবং তাদের কাজে আমরা যেন বাধা না দেই,' বলেন দেলোয়ার।

গত ২২ মার্চ, সুলতানাকে তুলে নেওয়া দিন, দেলোয়ার লক্ষ্য করেন যে ভোর থেকে তার বাড়ির সামনে লোক সংখ্যা বাড়ছে।

তবে সকাল ৯টার দিকে তিনি কাজের জন্য বাসা থেকে বের হয়ে যান।

দেলোয়ার তার স্ত্রীর বরাত দিয়ে বলেন, 'সেদিন সকাল ৯টা ২০ মিনিটের দিকে আমার স্ত্রীকে সুলতানা বলেছিলেন, ওই লোকগুলো বাসার সামনে বসে থাকায় একা কাজে যেতে অস্বস্তি বোধ করেন তিনি।'

সকাল সাড়ে ৯টার দিকে স্থানীয় আরেক নারীকে সঙ্গে নিয়ে সুলতানা বাসা থেকে প্রায় ৩০০ গজ দূরে জনকল্যাণপাড়া মোড়ে যান।

এসময় অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তি সুলতানাকে অনুসরণ করেন বলে স্থানীয় ওই নারীর বরাতে জানান দেলোয়ার।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে দেলোয়ার জানান, সুলতানা জনকল্যাণপাড়া মোড় থেকে রিকশায় উঠলে আরও কয়েকজন এসে তার রিকশা অনুসরণ করে মুক্তির মোড়ে পৌঁছান এবং সেখান থেকে তাকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যাওয়া হয়।

'আমার স্ত্রীর কাছে সুলতানার ফোন কলের কথা শুনে সকাল ১০টার দিকে বাসায় ফিরে জানতে পারি, সুলতানাকে আটক করা হয়েছে,' বলেন দেলোয়ার।

তবে কারা তাকে আটক করেছে, এ বিষয়ে তারা কিছু জানতেন না।

দেলোয়ার বলেন, 'গত শনিবার সুলতানাকে যখন দাফন করা হয় তখন সেখানে স্থানীয়রা এমন অন্তত ৩ জনকে শনাক্ত করেছেন, যারা রাতে আমার বাড়ির সামনে অবস্থান করতেন। সুলতানাকে আমাদের বাড়ির কাছের একটি কবরস্থানেই দাফন করা হয়েছে। দাফনের সময় সেখানে পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।'

জনকল্যাণপাড়া মোড় ও মুক্তির মোড়ের অন্তত ৫ জন দোকান মালিকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে দ্য ডেইলি স্টার। তবে, তাদের কেউ এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

টিনপট্টি এলাকার নওগাঁ পৌরসভা-চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে সুলতানার সহকর্মীরা তাকে একজন ভদ্র, আন্তরিক ও সময়নিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করেন।

ইউনিয়নের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা কাজী রফিউল আলম বলেন, 'আমি এখানে ৮ মাস ধরে আছি। কখনো সুলতানাকে অফিসে অনুপস্থিত দেখিনি।'

সুলতানাকে তুলে নেওয়ার একদিন পর গত ২৩ মার্চ রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় তার বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়। সেখানে অভিযোগ করা হয়েছে যে গত ১৯ মার্চ রাজশাহীতে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের সামনে তিনি কয়েকজনের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।

কাজী রফিউল আলম জানান, ১৯ মার্চ সুলতানা অফিস সময়ে কর্মস্থলেই ছিলেন।

ইউনিয়ন উপ-সহকারী ভূমি কর্মকর্তা মোমেনা খাতুন জানান, ২২ মার্চ সুলতানাকে অফিসে না দেখে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন।

মোমেনা বলেন, 'তাকে তো কখনোই অফিসে অনুপস্থিত দেখিনি। তিনি খুবই সময়নিষ্ঠ ছিলেন।'

২২ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টা থেকে মোমেনা অফিসে ছিলেন এবং সুলতানা কোথায় আছেন তা জানতে বারবার ফোন করেন। তবে, তার কলটি রিসিভ করা হয়নি।

এমনকি সুলতানার ছেলে কোথায় আছেন, সেটা জানতেও মোমেনা ফোন করেন। দুপুর দেড়টার দিকে সুলতানার ছেলে মোমেনাকে জানান, র‌্যাব সুলতানাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।

গতকাল সুলতানার কোনো আত্মীয় দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদকের কল রিসিভ করেননি। তবে, সুলতানার মামা নওগাঁর সাবেক কাউন্সিলর নাজমুল হক মন্টুর সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি ২৭ বছর পৌর কাউন্সিলর ছিলেন।

২ বার স্থান পরিবর্তনের পর নওগাঁ শহরের একটি গ্যারেজে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে কথা হয়।

তিনি বলেন, 'সুলতানার মৃত্যুর পর থেকে আমাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ আমি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তুলে নিয়ে যাওয়ার ভয়ে দিন কাটাচ্ছি।'

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

7h ago