বিশাল রপ্তানি সম্ভাবনার ওষুধ শিল্প

ফার্মাসিউটিক্যাল ও স্বাস্থ্যসেবা খাতের ওপর আয়োজিত অধিবেশনে অংশ নেন এ খাতের শীর্ষ ব্যক্তিত্বরা। ছবি: প্রবীর দাস/স্টার
ফার্মাসিউটিক্যাল ও স্বাস্থ্যসেবা খাতের ওপর আয়োজিত অধিবেশনে অংশ নেন এ খাতের শীর্ষ ব্যক্তিত্বরা। ছবি: প্রবীর দাস/স্টার

বিশ্বের অনেক দেশে ওষুধ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা না থাকায় বাংলাদেশ খুব দ্রুত উন্নত মানের ও স্বল্প মূল্যের জেনেরিক ওষুধ তৈরিতে বৈশ্বিক কেন্দ্রে পরিণত হতে যাচ্ছে বলছেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা।

ওষুধ উৎপাদনের বৈশ্বিক কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার জন্য বাংলাদেশের সামনে থাকা সুযোগের কথা উল্লেখ করে তারা বলেন, উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি শুধু ভারত ও চীনের ফার্মাসিউটিক্যাল উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে।

ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মুক্তাদির বলেন, 'চীন, ভারত এবং পশ্চিমা বিশ্ব ছাড়া আর কেউ ওষুধ উৎপাদনে বাংলাদেশের সমকক্ষ নয়। ফলে বাংলাদেশের সামনে বিশাল সুযোগ রয়েছে। বস্তুত, বাংলাদেশ উচ্চমানের ও স্বল্প মূল্যের জেনেরিক ওষুধের জন্য একটি প্রধান বৈশ্বিক কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে।

গতকাল সোমবার বাংলাদেশ বিজনেস সামিটে তিনি এসব কথা বলেন।

দেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনা তুলে ধরতে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ৩ দিনব্যাপী এ সম্মেলনের আয়োজন করে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)।

একই সঙ্গে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতির ভূমিকায় থাকা মুক্তাদির জানান, চীন ও ভারতের যথাক্রমে ২২০ বিলিয়ন ও ৪০ বিলিয়ন ডলারের বড় বাজার রয়েছে এবং তা আরও বাড়ছে।

'সুতরাং, অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পর ভারত এবং চীনের পক্ষে এত বিশাল চাহিদা মেটানোর যথেষ্ট সক্ষমতা নাও থাকতে পারে', যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'সবাই ভারতের পর দ্বিতীয় বিকল্প খুঁজছে, যেখানে বাংলাদেশের দারুণ সুযোগ রয়েছে'।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শরিফা খাতুন এ আলোচনায় সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করেন।

ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্ব রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের সুযোগ তৈরি করছে', উল্লেখ করে মুক্তাদির জানান, সক্রিয় ফার্মাসিউটিক্যাল উপাদান, ফার্মাসিউটিক্যাল ফর্মুলেশন, বায়োসিমিলার, ভ্যাকসিন এবং মেডিক্যাল সরঞ্জাম খাতে অনেক সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশের ৯ প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অস্ট্রেলিয়ার নিয়ন্ত্রক সংস্থার পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছ থেকেও অনুমোদন পেয়েছে।

মুক্তাদির আরও বলেন, 'খুব শিগগিরই এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২০ এ উন্নীত হবে'।

'এতে বাংলাদেশ বিশ্ব বাজারের ওষুধ সরবরাহকারী হতে পারবে। বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের জন্য দৃশ্যমান প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা রয়েছে', যোগ করেন তিনি।

বাংলাদেশে ২১৩ স্থানীয় ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, যা দেশের মোট ওষুধের চাহিদার ৯৭ শতাংশ পূরণ করছে।

অপর দিকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ ওষুধ আমদানি করে।

২০২২ সালের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত বাংলাদেশে ওষুধের বাজারের আকার ছিল ৩ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। গত ১ দশকে বাজার ৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০২৭ সালের মধ্যে এটি ৬ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, লিকুইড প্রিপারেশন, ড্রাই সাসপেনশন, ইনজেকশন, ন্যাজাল স্প্রে ও স্যাশের মাধ্যমে গ্র্যানিউল সহ প্রায় সব ধরনের ডোসেজ উৎপাদনে সক্ষম।

এখন, ওষুধ উৎপাদকরা তাদের প্রতিযোগিতামূলক শক্তিমত্তা বাড়ানোর জন্য ওষুধের কাঁচামাল বা এপিআই উৎপাদনের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।

বর্তমানে রাজধানী থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে মুন্সিগঞ্জের এপিআই পার্কে ১৫ প্রতিষ্ঠান এপিআই উৎপাদন করছে এবং আরও ২৭ প্রতিষ্ঠান সেখানে এপিআই অবকাঠামো নির্মাণ করতে যাচ্ছে।

মুক্তাদির বলেন, বিপিআইর লক্ষ্য ৮০০ থেকে ১ হাজার জেনেরিক বাল্ক ওষুধ তৈরি করা।

স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও ইউরোপের ১৫৭ দেশে পণ্য রপ্তানি করে থাকে। গত ৭ বছরে এ খাতে রপ্তানি আয় প্রায় ৩ গুণ বেড়েছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ওষুধ রপ্তানি ১১ শতাংশেরও বেশি বেড়ে ১৮৮ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

ডাবলিন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড মার্কেটসের গবেষণার বরাত দিয়ে মুক্তাদির বলেন, '২০২৫ সালের মধ্যে রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে ৪৫ কোটি ডলারে উন্নীত হবে'।

বৈশ্বিক জেনেরিক ওষুধের বাজার প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলার এবং বাংলাদেশ যদি এ বাজারের ১ শতাংশও ধরতে পারে, তাহলে সামগ্রিক ভাবে ফার্মাসিউটিক্যাল রপ্তানির পরিমাণ ৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।

মুক্তাদির বলেন, 'বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞের মতে এটি অর্জনযোগ্য লক্ষ্যমাত্রা। আর আমরা যদি তা ১০ শতাংশে উন্নীত করতে পারি, তাহলে তা হবে ৪০ বিলিয়ন ডলার।'

তবে এ খাতেও বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে।

যেহেতু বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে, তাই আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পেটেন্টকৃত ওষুধ উৎপাদনে ছাড় সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ।

মুক্তাদির বলেন, 'পেটেন্টকৃত পণ্যের দাম বেড়ে যাবে এবং কিছু কমপ্লেক্স বায়োলজিক্স দেশে আর পাওয়া নাও যেতে পারে'।

তিনি জানান, যেসব পেটেন্টযুক্ত ওষুধ ইতোমধ্যে বাজারে চালু আছে, সেগুলোতে ছাড় অব্যাহত থাকা উচিত।

স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পরেও ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যের ক্ষেত্রে ট্রিপস ছাড়ের সময়সীমা বাড়ানোর জন্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সঙ্গে আলোচনা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান মুক্তাদির।

মুক্তাদির বলেন, বাংলাদেশের উচিত লাতিন আমেরিকা, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, মিশর ও কেনিয়ার মতো সম্ভাব্য এপিআই বাজারের দিকে মনোনিবেশ করা।

এসব পণ্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে পাওয়া যাবে।

বিপিআই সভাপতি নাজমুল হাসান বলেন, 'বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা ওষুধের উৎস। এটা প্রমাণিত যে আমরা মানসম্মত ওষুধ উৎপাদন করতে পারি।'

বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধের দাম বেড়ে যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য কিছু সুযোগও আছে বলে মনে করেন নাজমুল হাসান।

একইসঙ্গে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনকারী নাজমুল হাসান আরও বলেন, '২০৩০ সালের মধ্যে ১৫০ বিলিয়ন ডলারের ওষুধ অফ-পেটেন্ট করা হবে। এতে বাংলাদেশের লাভ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে'।

তিনি বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে বাংলাদেশে উৎপাদন অবকাঠামো প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান এবং স্থানীয় উৎপাদকদের বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে এবং গবেষণা ও উন্নয়ন সক্ষমতা জোরদার করার পরামর্শ দেন।

নভো নরডিস্ক বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও জেনারেল ম্যানেজার রাজর্ষি দে সরকার স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের মাঝে অংশীদারত্ব গড়ে তোলার পরামর্শ দেন।

নভো নরডিস্ক এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালসের সঙ্গে সহযোগিতা ও অংশীদারত্ব তৈরি করেছে এবং ডায়াবেটিক রোগীদের ব্যবহৃত নভো নরডিস্কের ইনসুলিন কার্ট্রিজ উৎপাদন অবকাঠামো স্থাপন করেছে।

তিনি বলেন, 'এই অংশীদারত্ব বাংলাদেশে ইনসুলিনের সরবরাহ এবং অন্যান্য দেশে রপ্তানির বিষয়টি নিশ্চিত করবে'।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Eid meat: Stories of sacrifice, sharing and struggle

While the well-off fulfilled their religious duty by sacrificing cows and goats, crowds of people -- less fortunate and often overlooked -- stood patiently outside gates, waiting for a small share of meat they could take home to their families

4h ago