প্রযুক্তিতেও জেন্ডার বৈষম্য

সরকারের 'ডিজিটাল বাংলাদেশ এজেন্ডা' থাকা সত্ত্বেও দেশে উল্লেখযোগ্য হারে ডিজিটাল জেন্ডার বৈষম্য রয়ে গেছে। এই বৈষম্য পুরুষের তুলনায় নারীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সরঞ্জাম প্রাপ্তি এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করছে।

এটি শুধু নারীর ডিজিটাল অর্থনীতিতে অংশগ্রহণকেই সীমিত করছে না, তাদের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও বাধা দিচ্ছে। বয়স, অঞ্চল ও আয় বৈষম্যের কারণে এ বিভাজন আরও বেড়েছে। এ অবস্থায় বৈষম্য দূর করে সব নাগরিকের সমান ডিজিটাল সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে এজেন্ডাটি বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে উঠেছে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাশিদা আক্তার ডিজিটাল জেন্ডার বৈষম্যর একজন ভুক্তভোগী। করোনা মহামারী চলাকালীন অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। সে সময় রাশিদার কাছে কোনো স্মার্টফোন না থাকায় তাকে তার ভাইয়ের স্মার্টফোন ব্যবহার করে অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে হতো।

রাশিদা বলেন, 'আমি যখন প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই তখন আমার কাছে কোনো স্মার্টফোন ছিল না। বাবা-মা আমাকে স্মার্টফোন কিনে দেওয়া নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন। তারা আশঙ্কা করতেন, স্মার্টফোনের কারণে হয়তো আমার পড়াশোনায় ক্ষতি হবে বা আমি হয়তো কোনো রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে পারি। বিশেষ করে যখন থেকে আমি ঢাকায় একা থাকতে শুরু করি তখন তাদের মাথায় এসব ভাবনা আসে।'

'মহামারির সময় যখন গ্রামে বাড়িতে ফিরে আসি তখন আমাকে অনলাইনে ক্লাস করার জন্য ছোট ভাইয়ের ফোনের উপর নির্ভর করতে হতো। এই ফোনটা আমার বাবা-মায়ের একমাত্র স্মার্টফোন, যেটা আমার ভাই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ব্যবহার করে আসছে। আমার কোনো ক্লাসের নির্দিষ্ট কোনো সময়সূচি ছিল না। আমার ভাই প্রায়ই ফোন নিয়ে বাইরে থাকত। এ কারণে উপস্থিতি বাধ্যতামূলক হওয়া সত্ত্বেও আমার বেশ কয়েকটি ক্লাস মিস হয়ে গেছিল।

এ ছাড়া ভালো নেটওয়ার্ক সংযোগ পেতে আমাকে বাড়ির বাইরের একটা মাঠে গিয়ে ফোন ব্যবহার করতে হতো। আমার পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি ভালেভাবে নিতেন না। ফলে আমিও ক্লাস করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলি। এ কারণে সেই সেমিস্টারে আমার ফল খারাপ হয়', যোগ করেন তিনি।

রাশিদা আরও বলেন, 'আমার ছোট বোন জুলি তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত। তার অভিজ্ঞতাও একই রকম। সেও জুম ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিত হতে পারত না। আর্থিক সমস্যার কারণে আরেকটি নতুন স্মার্টফোন কেনার সামর্থ্য আমাদের পরিবারের ছিল না।'

রাশিদার এ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এ তথ্য সামনে উঠে আসে যে, এখনও অনেক পরিবারে স্মার্টফোন মূলত পুরুষরা ব্যবহার করেন। মেয়েদের পড়াশোনা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ এতে বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

গ্রুপ স্পেশাল মোবাইল অ্যাসোসিয়েশনের (জিএসএমএ) ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের মালিকানা এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য জেন্ডার বৈষম্য আছে। পুরুষের তুলনায় নারীর মোবাইল ফোন থাকার সম্ভাবনা ২৯ শতাংশ কম। মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করার সম্ভাবনাও পুরুষের তুলনায় নারীর ৫২ শতাংশ কম।

সবশেষ জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এও জেন্ডার বৈষম্যের বিষয়টি উঠে এসেছে। এতে দেখা গেছে, মোট জনসংখ্যার ৬৬.৫৩ শতাংশ পুরুষ এবং ৪৫.৫৩ শতাংশ  নারী মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৩৮.০২ শতাংশ পুরুষ এবং ২৩.৫২ শতাংশ নারী।

২০২১ সালে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) 'বাংলাদেশের প্রান্তিক পর্যায়ে ডিজিটাল জেন্ডার ডিভাইড: কতটা ব্যাপক এবং কেন' শিরোনামের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৩ শতাংশ পরিবার একজন পুরুষকে সবচেয়ে বেশি 'ডিজিটাল দক্ষতাসম্পন্ন' ব্যক্তি হিসাবে চিহ্নিত করেছে, যা নারীর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

ডিজিটাল জেন্ডার বিভাজন শুধু শিক্ষাগত সুযোগে নারীদের প্রবেশাধিকারকে সীমাবদ্ধ করেনি, এটি নারী ও পুরুষের মধ্যে জ্ঞানের ব্যবধান এবং দক্ষতার বৈষম্যও তৈরি করছে। ফলে শ্রমক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে নারীর সীমিত প্রবেশাধিকার পুরুষ ও নারীর মধ্যে আয় বৈষম্যও তৈরি করছে।

জামালপুরের মেলান্দহর শিরিন সুলতানা (২৯) গত ৫ বছর ধরে নকশি কাঁথা সেলাই করছেন। এগুলো এলাকার স্থানীয় এক বিক্রেতার কাছে বিক্রি করে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা আয় করেন তিনি।

অন্যদিকে ওই বিক্রেতা ফেসবুক পেজের মাধ্যমে সারাদেশে অনলাইনে এসব কাঁথা বিক্রি করেন। শিরিন প্রতিটি কাঁথা সেলাই করে মাত্র ১ হাজার টাকা আয় করলেও সেই বিক্রেতা তার গ্রাহকদের কাছে প্রতিটি কাঁথা বিক্রি করেন প্রায় ৫ হাজার টাকায়।

শিরিন ও তার মতো অন্যান্য নারী কর্মীরা এ বিষয়টা জানেন। কিন্তু তারা অনলাইন বাজারের সুবিধা নিতে পারছেন না। কারণ শিরিনের মতে, 'আমরা কেউই জানি না কীভাবে স্মার্টফোন চালাতে হয়। অনলাইনে ব্যবসা করা তো দূরের কথা।'

ডিজিটাল সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির জেন্ডারভিত্তিক এই অসমতা নারীর স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার ওপরও বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে।

যে নারীরা ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারছেন না তাদের মাতৃস্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা বা রোগ প্রতিরোধের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা কম। এ ছাড়া ডিজিটাল উপকরণের অনুপস্থিতি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তারা মানসিক সমর্থন এবং সামাজিক নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করতে পারেন। এ ছাড়া তাদের বিষণ্নতা ও উদ্বেগে ভোগারও আশঙ্কা আছে।

বিআইজিডির গবেষণায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাস নারীদের প্রযুক্তি ব্যবহার থেকে বিরত রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন-সীমিত শিক্ষাগত যোগ্যতার নারীদের প্রায়ই প্রযুক্তি ব্যবহারে অক্ষম হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু একই শিক্ষাগত যোগ্যতার অধিকারী পুরুষদের এভাবে বিচার করা হয় না।

এ গবেষণায় আরও দেখা গেছে, যে নারীরা উচ্চশিক্ষিত এবং নেতৃস্থানীয় অবস্থানে আছেন তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করার সম্ভাবনা বেশি। শিক্ষিত ও পরিবারের প্রধান নারীদের একটি বড় শতাংশ প্রযুক্তি ব্যবহারকারী।

সমীক্ষায় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যেহেতু নারীদের ডিজিটাল সাক্ষরতার উন্নতি তাদের শিক্ষার স্তরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, তাই সরকারকে অবশ্যই নারী শিক্ষায় বিনিয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে। একইসঙ্গে গ্রামীণ নাগরিকদের মধ্যে পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য ডিজিটাল সাক্ষরতার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

পাশাপাশি, সামাজিক নিয়মকানুন পরিবর্তন করা কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ হলেও এর সম্ভাব্য সমাধান বের করে তা অনুসরণ করতে হবে।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অফ ইকোনমিক মডেলিংয়ের গবেষণা পরিচালক ড. সায়েমা হক বিদিশা বলেন, 'অভিভাবকদের মানসিকতার পরিবর্তন করা এবং শিশুদের ডিজিটাল সাক্ষরতার সুবিধা সম্পর্কে সচেতন করা জরুরি। তাদের সঠিক নির্দেশনাসহ স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহার করার অনুমোদন দিতে হবে, যাতে তারা এর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে '

তিনি আরও বলেন, 'মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের কিশোর-কিশোরী ক্লাব ডিজিটাল সাক্ষরতা ও এটির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে পারে। পাশাপাশি সরকারের উচিত মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাড়ানো, যা এই অসমতাকে দূর করতে কাজ করবে।'

তিনি আরও বলেন, 'উপজেলার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নারী কর্মকর্তা নিয়োগের মাধ্যমে ডিজিটাল জেন্ডার বৈষম্য কমাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। এই নারী কর্মকর্তারা তৃণমূল পর্যায়ে নারীদের প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রাপ্তিতে সহায়তা করতে করতে পারেন।'

Comments

The Daily Star  | English

$14b lost to capital flight a year during AL years

Bangladesh has lost around $14 billion a year on average to capital flight during the Awami League’s 15-year tenure, according to the draft report of the committee preparing a white paper on the economy.

7h ago