কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি শিল্পীদের জন্য হুমকি

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি শিল্পীদের জন্য হুমকি
এআইয়ের মাধ্যমে আঁকা জেসন অ্যালেনসের ছবি ‘থিয়েটার ডি অপেরা স্পেশাল’ ছবিটি কলোরাডো স্টেট ফেয়ারে প্রথম স্থান অর্জন করে।

বর্তমান সময়ে সৃজনশীল বহু ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রখর পদচারণা লক্ষ করা যাচ্ছে। 'ডাল-ই' এবং 'চ্যাটজিপিটি'র মতো প্রযুক্তির পেছনে থাকা প্রতিষ্ঠানটির নাম 'ওপেন এআই'। 

মানবতার প্রয়োজনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগাতে নিত্যনতুন বিষয়ের নির্মাণে এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে ২০২২ সালের শেষের দিকে ডাল-ই ২ প্রকাশ পাবার পরই জনমনে এর সম্পর্কে আগ্রহের জোয়ার আসে। 

সহজ কথায়, ডাল-ই ২ এমন একটি অনলাইন টুল, যা ব্যবহার করে মানুষ বিভিন্ন 'টেক্সট ইনপুট' দেবার মাধ্যমে বিভিন্ন ছবি উৎপাদন করতে পারবে। অনেক অনেক 'আসল' ছবির ভাণ্ডার পর্যালোচনা করার পরই বর্তমান অবস্থানে এসেছে এই প্রযুক্তি, তাই এটি ব্যবহারের ফলাফল খুব কমই হতাশ করে। নিজের লাগামহীন কল্পনার বাস্তব রূপ দেখতে কার না ভালো লাগে! তাই জনপ্রিয়তায় দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শিল্প। তবে প্রযুক্তির সকল এগিয়ে যাওয়াই আমাদেরকে একটি প্রশ্নের সম্মুখীন করে। এক্ষেত্রে প্রশ্নটি হচ্ছে– প্রকৃত শিল্প ও শিল্পী কি এর দ্বারা হুমকির মুখে পড়বে? 

আগেও প্রযুক্তির কারণে বহু পেশা হারিয়ে গেছে, যন্ত্র জায়গা নিয়েছে মানুষের। বিভিন্ন কারখানায় এ সংখ্যা সর্বাধিক। কিন্তু শিল্প বা সৃজনশীল জগতে এমনটা হওয়া অনেকটাই নতুন। কেন না শিল্পের সম্পর্ক আমাদের মনোজগতের ইতিহাসের গ্রন্থিতে বাঁধা, হিসেব-নিকেশের কাঠখোট্টা স্বভাব থেকে তার অবস্থান বহু দূরে। সভ্যতার আদিকাল থেকেই মানুষ আর শিল্প কোনো উদ্দেশ্য অন্বেষণে নয়, বরং সভ্যতাকে সাজিয়ে তুলতেই পায়ে পা মিলিয়ে যাত্রা করেছে। 

শিল্প সব সীমানা পেরিয়ে আমাদের সৃজনশীল হতে উদ্বুদ্ধ করে। সৃজনশীলতার এই চর্চা ছাড়া আমরা কি সমাজ হিসেবে উন্নত হতে পারতাম? প্রাগৈতিহাসিক গুহাবাসের দিনগুলো থেকে আজকের আধুনিক শিল্পের সবটাই মানবজাতির অদম্য কল্পনার প্রমাণ দেয়। আর তা আমাদের সামগ্রিক উন্নয়নেরই একটি বিশেষ অংশ। তাই যখন শিল্পের ক্ষেত্র হুমকির মুখে পড়ে, তখন দুশ্চিন্তা আসাটা স্বাভাবিক। 

এই প্রযুক্তির দ্বারা শিল্পীদের জীবিকা সরাসরি হুমকির মুখে না পড়লেও সৃজনশীল গোষ্ঠীর জন্য ভবিষ্যত আশঙ্কা থেকেই যায়। এ ক্ষেত্রে শুরুর দিকে গ্রাফিক ডিজাইনাররা এর মধ্যে বেশি ঝামেলায় পড়বেন। ইউটিউব বা সমমানের ওয়েবসাইটগুলোর থাম্বনেইল তৈরির কাজটি যেমন খুব সহজেই ডাল-ই'র উন্নত সংস্করণ দ্বারা করিয়ে নেওয়া সম্ভব। অর্থাৎ, কম বা মাঝারি দক্ষতার ডিজাইনাররা খুব সহজেই এই টুলটি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতে পারেন। 

এ বিষয়ে এমকেবিএইচডি নামে সমধিক পরিচিত ইউটিউব কিংবদন্তি মার্কেজ ব্রাউনলি একটি চমৎকার ভিডিও তৈরি করেন। ভিডিওটির শিরোনাম হচ্ছে, 'ক্যান এআই রিপ্লেস আওয়ার গ্রাফিক ডিজাইনার?'; অর্থাৎ, এআই কি আমাদের গ্রাফিক ডিজাইনারদের প্রতিস্থাপিত করতে পারে? এটি তার দ্বিতীয় চ্যানেল– দ্য স্টুডিওতে প্রচার করা হয়। 

ভিডিওটিতে এই চ্যানেলের বর্তমান গ্রাফিক ডিজাইনারকে ডাল-ই প্রযুক্তির বিপক্ষে দাঁড় করানো হয়। এতে দেখা যায়, সেই গ্রাফিক ডিজাইনার ৩টির মধ্যে দুটো প্রম্পটের ব্লাইন্ড টেস্টেই জিতে যান। এতে বার্তা দেওয়া হয় যে শিল্পীর সৃজনশীলতাই তাকে যন্ত্র থেকে আলাদা করে। ডাল-ই বা এ ধরনের প্রযুক্তি যখন প্রদত্ত ইনপুট বা প্রম্পটকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করে, তখন নিজস্ব বোধশক্তির কারণে একজন শিল্পী বিষয়টি আরো ভালোভাবে বুঝতে পারেন। 

দুর্ভাগ্যজনকভাবে ডাল-ই ২ এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রযুক্তিটি ক্রমশ শিখছে, বিবর্তিত হচ্ছে এবং নতুন নতুন কাজের মাধ্যমে আরো সক্রিয় হচ্ছে। প্রতিবার কেউ একজন এতে 'প্রম্পট' বা 'টেক্সট' দেওয়ার মাধ্যমে এটি আরও ভালো ছবি তৈরির বিষয়ে দক্ষ হচ্ছে। অর্থাৎ ব্যবহারকারীরাই এর দক্ষতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তাই প্রকৃত শিল্পীদের সঙ্গে দ্বৈরথে নামতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ঠিক কতদিনে প্রস্তুত হবে বা আদৌ হবে কি না, তা এখনই বলা মুশকিল। 

ঢাকা কমিকস এবং উন্মাদ-এর মেহেদি হকের সঙ্গে কথা হয় এ বিষয়ে। খোদ শিল্পীরা এ বিষয়টিকে কীভাবে নিচ্ছেন, এ নিয়ে তিনি বলেন– 'ব্যক্তিগতভাবে এই ক্ষেত্রটির সমৃদ্ধি দেখতে আমি বেশ আগ্রহ বোধ করছি। শিল্পের জগৎটাতে দুটো দিক রয়েছে। একটা হচ্ছে শ্রমের, অন্যটা সৃজনশীলতার। তাই ডাল-ই'র মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মডেলগুলো অবশ্যই শ্রমভিত্তিক দিকগুলোকে হুমকির মুখে ফেলবে। তবে একজন শিল্পই কিন্তু সৃজনশীল দিকটা নিয়েই বেশি কাজ করেন, আমার মতে যা কিনা নিরাপদ থেকে যাবে। তবে প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে সময়ের সঙ্গে কিছু কাজ যে নেই হয়ে যাবে, সেটা অনিবার্য।'

নব্য ও ভবিষ্যত শিল্পীরা বর্তমান বিশ্বে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখতে পারেন, সে বিষয়ে তিনি পরামর্শ দেন, "আমাদের অনেক বেশি সফট স্কিল বৃদ্ধি করতে হবে। ফরমায়েশি কাজে বিশেষভাবে চিত্রকর্ম তৈরি করা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাজ নয়, অন্ততপক্ষে প্রকৃত শিল্পীর মতো করে তো নয়ই।"

ইশমাম টুনস, মাইটি পাঞ্চ স্টুডিওস এবং কার্টুন পিপল-এর জুনাইদ ইকবাল ইশমামও মেহেদির মতোই ধারণা রাখেন। জুনাইদ বলেন, 'ব্যক্তিগতভাবে আমি এআই শিল্পের বিরোধী নই। তবে যেভাবে বিশ্বব্যাপী এই বিষয়টি ব্যবহৃত হচ্ছে, আমি তার বিরুদ্ধে। এআই অন্যান্য শিল্পীদের কাজ তাদের অনুমতি ছাড়াই ব্যবহার করছে এবং যথাযথ কৃতিত্ব বা রয়ালটি ছাড়াই এ কাজ হচ্ছে। তবে আমার বিশ্বাস, এই টুলটিকে যথাযথভাবে ব্যবহার করলে এর মধ্যে শিল্পীদের কাজে সাহায্য করার ব্যাপক সম্ভাবনা ও দক্ষতা রয়েছে।'

অদূর ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমতা এবং শিল্পের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে কার্টুন পিপল-এর প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ রাশেদ ইমাম তন্ময় বলেন, 'প্রথমে যখন আলোকচিত্র উদ্ভাবিত হয়, তখন সংবাদপত্র, বিজ্ঞাপন, ডিজাইন ফার্ম ইত্যাদি স্থানে কাজ করা অনেক পোর্ট্রেট শিল্পী তাদের চাকরি হারান। আলোকচিত্র শিল্প কি না, সে বিষয়ে পরবর্তী সময়ে বহু বিতর্কও জন্ম নেয়। কিন্তু তারপরই যে ইস্যুটি জন্ম নেয়, তা হচ্ছে এই প্রযুক্তিকে কোনোভাবেই দমিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না।'

তন্ময় আরও যোগ করেন, 'যখনই নতুন কোনো প্রযুক্তির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে, খুব কম আইনই পাওয়া যায়, যার মাধ্যমে শোষণ রোধ করা যায়। অতীতেও আমরা দেখেছি, প্রযুক্তির কারণে বিভিন্ন পেশার বিলোপ ঘটতে। এভাবে মানুষ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়, ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। বরং বিভিন্ন কাজই সেকেলে হয়ে পড়ে। তাই শিল্পীদের দরকার নতুন টুল বা মাধ্যমের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়া, আরও বেশি সৃজনশীল হয়ে ওঠা যাতে কোনো ক্ষেত্রেই তাদেরকে বাদ না পড়তে হয়।'

কপিরাইট আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কী করা যায়, সে বিষয়ে এই শিল্পী জানান, 'যদি বিশ্বব্যাপী এআই আর্ট জেনারেটরের জনপ্রিয়তা বাড়তেই থাকে, তাহলে শিল্পীদের যথাযথভাবে সুরক্ষা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় কপিরাইট আইনের দরকার রয়েছে। বাংলাদেশে আমাদের মৌলিক কপিরাইট সুরক্ষাই নেই। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতি মানদণ্ডে কপিরাইট আইন আনা উচিত। এরপর বাংলাদেশও এসব আইনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবে। তবে একথা অস্বীকার করার কিছু নেই যে আমাদের দেশে এসব প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীরগতির। বিশেষত শিল্পের ক্ষেত্রে তো বটেই। এই বিষয়টি এমন শিল্পীদের অতি মাত্রায় হতোদ্যম করে, যারা নিজের একটি স্টাইল তৈরি করেছেন– কেন না কৃত্রিম বুদ্ধিমতা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তাদের কাজের অনুলিপি তৈরি করতে সক্ষম।'

ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের যেখানেই নিয়ে যাক না কেন, প্রকৃত শিল্পীদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদকে সবসময় সুরক্ষা দিতে হবে। অন্যথায় লোভাতুর শোষক গোষ্ঠী এসব সৃষ্টিকর্মকে, তাদের এত বছরের পরিশ্রমকে ডাল-ই বা লেনসা'র মতো এআই টুলের সমৃদ্ধির ইন্ধন হিসেবে ব্যবহার করতে পিছপা হবে না।
 
যদিওবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখনো প্রারম্ভিককালেই আছে, এর ভবিষ্যত অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। এর ক্রমশ উন্নয়ন অনেকটা অনিবার্য এবং এর সঙ্গেই আমাদের মানিয়ে চলতে হবে। অনেক কাজ হারিয়ে যাবার আশঙ্কাও এই বাস্তবতারই একটি অংশ। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে বেকারত্বের দিকে ধাবমান না হয়ে বরং এটিকেই বিভিন্নভাবে কাজে লাগিয়ে আরও সৃজনশীল হয়ে ওঠা শ্রেয়। 

 

অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী
 

Comments

The Daily Star  | English

What if the US election ends in a Trump-Harris tie?

While not highly likely, such an outcome remains possible, tormenting Americans already perched painfully on the edge of their seats ahead of the November 5 election

2h ago