শখের বাগান যখন আয়ের উৎস

রাজশাহী, ফুল বাগান, আম, টিউলিপ,
বাগানটির নাম দিয়েছেন তিনি ‘ড্রিমার্স গার্ডেন’। ছবি: আনোয়ার আলী

সাধারণত অবসরকে বিশ্রামের সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু, এই সাধারণ ধারণাকে পাল্টে অবসরে অসাধারণ কিছু করেছেন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সাবেক গ্রুপ ক্যাপ্টেন রাজশাহীর এম আর হাসান জুবেরীর। অবসর তাকে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।

চাচাতো ভাই হাসান আল সাদীকে সঙ্গে নিয়ে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে একটি আম বাগানের ভেতর ফুলের বাগান গড়ে তোলেন জুবেরি। সেই ফুলের বাগান এখন ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে।

আম বাগানের ভেতর ফুলের বাগান গড়ে তুলেছিলেন জুবেরী। ছবি: আনোয়ার আলী

বাগানটির নাম দিয়েছেন তিনি 'ড্রিমার্স গার্ডেন'। রাজশাহী শহর থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে পলাশবাড়ী গ্রামের এই বাগানের ফুলের রঙ ও সুগন্ধ দূর-দূরান্তের প্রকৃতিপ্রেমীদের আকৃষ্ট করছে।

বাগানে নেদারল্যান্ডসের টিউলিপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লুপিন, পেটুনিয়াস, ইংল্যান্ডের এস্টার ফুল, আফ্রিকার গাজানিয়া ছাড়াও ডালিয়া, কসমস এবং গাঁদা ফুলের জনপ্রিয় সব জাত রয়েছে।

হাসান জুবেরি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাগানটি প্রথমদিকে আমাদের একটা পাগলামি ছিল।' 

অথচ তার এমন 'পাগলামি' থেকে তৈরি বাগানে ঢুকলেই যে কেউ মুগ্ধ হবেন।

সেই ফুলের বাগান এখন ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে। ছবি: আনোয়ার আলী

মেইন গেট পেরোলে ঝুলন্ত ফুলের পথ দর্শকদের বাগানের জাদুকরী রাজ্যে আরও গভীরে আমন্ত্রণ জানায়। তারপর সামনে পড়ে রূপকথার মতো একটি কাঠের সাদা দরজা। খড়ের বেড়ায় ঘেরা দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে হয় এই স্বপ্নের ফুলের রাজ্যে।

বাগানের আম গাছগুলোর শাখা ফুলের গাছ দিয়ে সাজানো।

এক কোণে, অদ্ভুত সৃজনশীলতার মাধ্যমে গাছের গুঁড়িতে ফুল ফোটানো হয়েছে। এখানে টবের বদলে গাছের গুড়িতে ফুলের গাছ লাগানো। অন্যদিকে, ঝুলন্ত পাখির বাসার ভেতরে ফুলের টব রাখা হয়েছে, যেন ফুল ফুটলে খাঁচা আর দেখা যায় না, সামনে শুধু ফুলই দেখা যায়।

আরেক কোণে, একটি বিশাল বাঁশের কাঠামো থেকে ফুলের টব ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এদিকটা দেখলে মনে হয় ফুলের জলপ্রপাত।

হাবিবুর রহমান নামের এক দর্শনার্থী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই বাগানে প্রবেশ করে মনে হচ্ছে আমি যেন কোন স্বপ্নের রাজ্যে প্রবেশ করেছি।'

বাগানের ফুলের রঙ ও সুগন্ধ দূর-দূরান্তের প্রকৃতিপ্রেমীদের আকৃষ্ট করছে। ছবি: আনোয়ার আলী

গরুর গাড়ি কিংবা রিকশা ভ্যান এবং পুকুরপাড়ের নৌকার মতো অপ্রত্যাশিত জিনিসগুলোকেও শিল্পকলার ফুলেল ক্যানভাসে পরিণত করা হয়েছে।

মিথিলা আক্তার নামে আরেক দর্শনার্থী বলেন, 'আমি সব জায়গায় সেলফি তুলেছি।'

তিনি বলেন, 'গত বছর এখানে প্রবেশের জন্য ৫০ টাকা টিকিট ছিল। এ বছর ২০০ টাকা করা হয়েছে। কিন্তু বাগানে প্রবেশের পর টিকিটের টাকা খুব অল্পই মনে হয়। বাগান মালিক অনেক যত্ন করে বাগানটি সাজিয়েছেন।'

বিমানবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় জুবেরী উত্তরাধিকার সূত্রে ১৩ বিঘা জমি পান। জমিতে ৩৫০ প্রজাতির আম গাছ ও অন্যান্য প্রজাতির ফল গাছ ছিল। 

অবসরের সময় ঘনিয়ে আসায় তিনি বাগানটি কীভাবে কাজে লাগাবেন, তার উপায় খুঁজতে শুরু করেন।

শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডিতে রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেন, ভারতের হায়দ্রাবাদে রামোজি ফিল্ম সিটি এবং সিঙ্গাপুর সফর থেকে তিনি ফুলের বাগান করার অনুপ্রেরণা পান।

জুবেরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ফুলের বাগান সবসময় আমাকে মুগ্ধ করে। আমি যখন এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা দেখলাম তখন এর পেছনে সময় দেওয়া শুরু করলাম।'

বাগান করার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা বা শিক্ষা ছাড়াই বাগান তৈরি শুরু করেন তিনি।

বাগান করার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা বা শিক্ষা ছাড়াই বাগান তৈরি শুরু করেন তিনি। ছবি: আনোয়ার আলী

জুবেরি বলেন, 'বাগান তৈরি করতে গিয়ে আমরা সবকিছু শিখেছি। সব পরিকল্পনা আমাদের নিজস্ব।'

তিনি জানান, প্রথমদিকে তাদের দুটি প্রধান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। প্রথমত, আম বাগানের মধ্যে ফুলের বাগান তৈরি করা সহজ ছিল না। দ্বিতীয়ত, বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটি শক্ত এবং শুষ্ক বলে এখানে ফুল চাষ করা কঠিন। 

টিকিট কেটে কেউ বাগান দেখতে চাইবেন কি না এ নিয়েও তার সংশয় ছিল।

'প্রকৃতির পরিবর্তনের ছোঁয়া যখন বাগানে পড়ল, তখন আমরাও অবাক হয়ে গেলাম। একেক ঋতুতে বাগানের চেহারা একেক রকম হয়,' বলেন জুবেরি।

২০২২ সালে বাগানটি দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয় এবং প্রথম বছরেই সন্তোষজনক সাড়া মেলে।

জুবেরির চাচাতো ভাই সাদী বলেন, 'দর্শনার্থীরা বাগান থেকে যাওয়ার সময় যখন আবার আসার কথা বলেন, তখন খুব ভালো লাগে।'

এ বছর বাগানে গত বছরের চেয়ে দশ গুণ বেশি ফুলে পরিপূর্ণ। এ বছর বাগানে সেলোসিয়া, ডায়ান্থাস, গ্ল্যাডিওলি, লিলিয়াম ফুল, কৈলাশ এবং আরও বেশ কিছু ফুল ফুটেছে।

বাগানটিতে ৩০টিরও বেশি প্রজাতির এক লাখের বেশি ফুলের গাছ আছে। এসব ফুল শীত ও বসন্তকালে ফোটে।

গ্রীষ্মকালে বাগানের ব্যস্ততা আম নিয়ে।

ফুল ছাড়াও বাগানে একটি পুকুর আছে, যেখানে মাছের দেখা মেলে । অর্থাৎ পুরো বাগানজুড়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপার প্রদর্শনী।

জুবেরি বলেন, 'আমরা চাই মানুষ আমাদের বাগানে আসুক এবং তাদের দুঃখ ও জীবন সংগ্রাম ভুলে প্রকৃতির সৌন্দর্যে হারিয়ে যাক।'

Comments

The Daily Star  | English
US election outcome’s likely impact on the Russia-Ukraine war

US election outcome’s likely impact on the Russia-Ukraine war

The endgame of the Ukraine war remains uncertain with US policy likely to be influenced by the outcome of the US election.

3h ago