শওকত আলী: অন্তর্জগতের অনালোচিত মানবিক সাহিত্যিক

শওকত আলী
শওকত আলী। ছবি: সংগৃহীত

বাংলা কথাসাহিত্যে শওকত আলীই বোধহয় একমাত্র শক্তিমান সাহিত্যিক যিনি কথাসাহিত্যে একরকমের নীরব বিপ্লব ঘটিয়েও অনেকাংশেই অনালোচিত ছিলেন। বাংলা কথাসাহিত্যে যার হাত ধরে সৃষ্টি হয়েছিল এক অনন্য ভাষা শৈলীর, উঠে এসেছে প্রাকৃতজনদের কথা, ইতিহাসের পাঁজর থেকে যিনি উঠিয়ে এনেছিলেন জীবন সংগ্রাম সেই শওকত আলী বরাবরই থেকে গেছেন আমাদের আলোচনার বাইরে।

শওকত আলী তার সাহিত্যে পরম মমতায় তুলে এনেছেন নিম্নবর্গের মানুষের উপাখ্যান। ইতিহাসের খেরোখাতা থেকে তুলে এনে চরিত্র বিনির্মাণের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন সেন রাজাদের রাজত্বকালে সামন্ত মহাসামন্তদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ প্রাকৃতজনদের জীবন সংগ্রাম। কেবল কি তাই, মধ্যবিত্ত পরিবারের উত্থান-পতন, গ্রামীণ বাস্তবতা থেকে শহুরে জনপদ, দেশভাগ, কী আসেনি তার সাহিত্যে!

শওকত আলী বেড়ে উঠেছিলেন দুর্ভিক্ষ এবং বিশ্বযুদ্ধের কালে। এর পরবর্তীতে দেশভাগ তার মনোজগতে এবং জীবনে গভীরভাবে রেখাপাত ঘটিয়েছিল।

শওকত আলী চিরকালই ছিলেন শিকড়ের প্রতি তীব্র আকুতিতে পরিপূর্ণ এক মানব। তার সাহিত্যেও আমরা পাই সে শিকড় ছিন্ন এক অধ্যায়ের গল্প। প্রথম জীবনের পিছুটান তার সাহিত্যের ভাষায় এনেছিল মর্মস্পর্শী এক ব্যাকরণ।

জন্মেছিলেন অবিভক্ত ভারতবর্ষের উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে। হোমিওপ্যথি চিকিৎসক বাবার ব্যবসাও ছিল ভীষণ চাঙ্গা। কিন্তু এক দেশভাগ সঙ্গে তার মায়ের মৃত্যু এবং দেশত্যাগ তিনে মিলে শওকত আলীর পরিবারকে যে মুহূর্তেই বিভীষিকার মুখে ফেলল। মায়ের মৃত্যুর পরের বছরই রায়গঞ্জ ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুরে চলে এলেন তিনি। চিকিৎসক বাবার রমরমা ব্যবসাও প্রায় লাটে উঠল।

একদিকে মাকে হারানোর বেদনা, অন্যদিকে মাতৃভূমি ছেড়ে যাওয়ার গভীরতম বিচ্ছেদ যা পরবর্তীতে বারেবারে উঠে এসেছিল শওকত আলীর সাহিত্যে। তার সাহিত্যের হাতেখড়ি হয়েছিল নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়েছিল দেশভাগের পর 'নতুন সাহিত্য' পত্রিকায়।

কলেজ জীবনেই বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে তীব্রভাবেই যুক্ত হয়েছিলেন শওকত আলী। এজন্য তাকে মাশুলও দিতে হয়েছিল। গ্রেপ্তার হয়ে জুটেছিল বেশ কয়েক মাস কারাবাসের অভিজ্ঞতাও। বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছিল তৃতীয় বিভাগে। কিন্তু অন্যদিকে জেলজীবন যেন তার জন্য শাপেবরও হয়েছিল। এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই বলেছিলেন, 'জেলজীবনে আমার অনেক প্রাপ্তিযোগের মধ্যে একটি হলো বিখ্যাত কৃষক নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশের সঙ্গে জেল খাটা। বন্দী সাঁওতালদের সঙ্গে তাদের জীবনাচার, কৃষ্টি, গঞ্জনা বঞ্চনার কথাও শুনেছি অনেক। আর জেলের লাইব্রেরির সব বই প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। কি বিচিত্র বিষয়ের সেইসব বই।'

শওকত আলীর পেশাগত জীবন শুরু হয়েছিল দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে। যদিও সেখানেই সাংবাদিকতার ইতি ঘটেছিল। এরপর তার শিক্ষক জীবন। প্রথমে দিনাজপুরে একটি স্কুলে শিক্ষকতার শুরু, একে একে ঠাকুরগাঁও কলেজ, জগন্নাথ কলেজে শিক্ষকতা এবং সর্বশেষ সরকারী সঙ্গীত কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে চাকরিজীবন শেষ হয় তার। শিক্ষকতা ছিল শওকত আলীর রন্ধ্রে প্রাণে। শিক্ষকতা জীবনে শওকত আলী ছিলেন সর্বগুণে গুণান্বিত। তার পাঠদানের কৌশলও কাঠখোট্টার বদলে ছিল আনন্দদায়ক।

শওকত আলীকে আজীবনই তাড়িত করেছে রায়গঞ্জে ফেলে আসা তার শৈশব। যা কৈশোরের মধ্য দিয়ে তিনি খুঁজে ফিরেছেন সাহিত্যে। দেশভাগ শওকত আলীকে বিদীর্ণ করে দিয়েছিল। শওকত আলীর উপন্যাস, গল্পের ভাষায় সেই বিচ্ছেদ যেন এক জাগরণের সৃষ্টি করেছে। অবহেলিত মানুষের মুখচ্ছবি, শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেওয়া মানুষের করুণ দৃষ্টি শওকত আলী পরম মমতায় তুলে এনেছেন তার সাহিত্যে।

শওকত আলীর ট্রিলজি 'দক্ষিণায়নের দিন', 'কুলায় কালস্রোত' এবং 'পূর্বরাত্রি পূর্বদিন' এ আমরা দেখতে পাই শওকত আলীর ইতিহাসআশ্রয়ী রূপ। যেখানে শওকত আলী বর্ণনা করেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ের প্রেক্ষপট, মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয়তাবাদী চরিত্রের প্রকাশ। শওকত আলী ছিলেন কালের সারথি। তার গল্প এবং উপন্যাসের ভাষায় বরাবরই তা দেখা যায়। সময়কে যিনি নিখুঁত বর্ণনায় এনে নানা ছাঁচে চরিত্রের দৃশ্যায়ন এঁকেছেন। যার কোনটিই কিন্তু কল্পিত ছিল না।

কিংবদন্তিতুল্য উপন্যাস 'প্রদোষে প্রাকৃতজন' এ শওকত আলী যেভাবে দ্বাদশ শতকের প্রেক্ষাপটকে তুলে এনে শ্যামাঙ্গ নামের আত্রেয়ী পাড়ের এক মৃৎশিল্পীর আখ্যানের বয়ান করেছেন তা বাংলা সাহিত্যে অতুলনীয়। ফলে পূর্বাপর জীবনচারণ ও সৃষ্টিশীল ব্যবচ্ছেদ দুয়ে মিলে প্রদোষে প্রাকৃতজন হয়ে উঠেছে কালোত্তীর্ণ।

শওকত আলীর সবচেয়ে বড় শক্তির স্থানটি ছিল তার সাহিত্যের ভাষায় দ্বিধাহীন চরিত্রের নির্মাণ। সমাজের সমস্ত গোত্র বর্ণের মানুষকেই তিনি তুলে এনেছেন সাহিত্যে। যেখানে সমাজের ধনবান ব্যক্তি যেমন স্থান পেয়েছে ঠিক তেমনি অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যক্তি বা দুর্বলতম ব্যক্তিও স্থান পেয়েছে। একই সঙ্গে শওকত আলী তার সৃষ্টিতেই প্রশ্ন এঁকে দিয়েছেন। তুলে এনেছেন ভাবনার অসীম দুয়ার।

শওকত আলী বলেছিলেন, 'আমি সবসময় শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে থাকতাম। তাদের সঙ্গে চলাফেরা করে আমি জীবনে অনেক কিছু শিখেছি। পরে এই সমস্ত মানুষ আমার গল্পে উঠে এসেছে নানা রূপে নানা মাত্রায়।'

শওকত আলীর ছোটগল্পের অনেক চরিত্রই পরবর্তীকালে তার উপন্যাসে চলে এসেছিল। এই প্রসঙ্গে শওকত আলীর যুক্তি ছিল এমনটাই। 'ছোটগল্পে আমি অনেক সময় ইচ্ছে থাকলেও চরিত্রের ডালপালা আমার মতো করে ছড়াতে পারিনি। কিংবা এটাও হতে পারে অসন্তুষ্টি আমার মধ্যে কাজ করেছে যার কারণে ঘটনা কিংবা চরিত্ররা পরবর্তীকালে উপন্যাসের বিস্তৃত হয়েছে।'

'দক্ষিণায়নের দিন', 'কুলায় কালস্রোত' এবং 'পূর্বরাত্রি পূর্বদিন' এই ত্রয়ী উপন্যাস শওকত আলীকে অনন্য করে তুলেছিল। কালের প্রেক্ষাপটে যা হয়েছে শওকত আলীর সর্বসেরা সৃষ্টিগুলোর অন্যতম।

এই ত্রয়ী উপন্যাস সর্ম্পকে শওকত আলী এক সাক্ষাৎকারে উন্মোচন করেছিলেন তার পীড়িত ভাষ্য। শওকত আলী অবলীলায় বলেছিলেন, 'ষাটের দশকের মানুষের মধ্যে চিন্তাভাবনার যে পরিবর্তন আসছে, সেটাই 'দক্ষিণায়নের দিন' যার মানে হচ্ছে শীতকাল আসছে। 'কুলায় কাল স্রোত' হচ্ছে পরিবর্তন যেখানে আঘাত করছে। আর 'পূর্বরাত্রি পূর্বদিন' হচ্ছে নতুন সময়টি আসার একেবারে আগের সময়টি। মূলত ষাটের দশকে আমাদের মধ্যবিত্ত এবং সমগ্র সমাজব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন আসে। নতুন একটা চিন্তা-চেতনা দ্বারা আলোড়িত হয় পুরো সমাজ। ধ্যান-ধারণা চাল-চলন জীবনব্যবস্থায় একটা পরিবর্তনের সুর বেজে ওঠে। সেসবই উপন্যাসে আনতে চেয়েছি।'

শওকত আলীর সাহিত্যের ভাষা পড়লেই চেনা যায় এটি কার সৃষ্টি। বাংলা সাহিত্যে এমন উদাহরণ খুবই নগণ্য, যাদের সৃষ্টির দ্বারা অতি সহজেই নির্ণয় করা যায় কে হতে পারেন স্রষ্টা। শওকত আলী ছিলেন সেই নগণ্য সংখ্যক সাহিত্যিকদের মধ্যে একজন। যিনি সমস্ত ধ্বংসলীলার মাঝেও বের করে এনেছেন জীবন সংগ্রামের পথ, মুক্তির নিশানা। সমস্ত নগ্নতার মাঝেও আকাঙ্ক্ষা করেছেন মুক্তির।

গত শতাব্দীর আশির দশকে শওকত আলী ছিলেন সবচেয়ে কর্মতৎপর। পূর্বের কয়েক দশকে শওকত আলী যা সৃষ্টি করেছেন তা এই দশকে এসে যেন পূর্ণ মাত্রা পেয়েছে। গদ্যের প্রকৃতি ঝাঁঝাল এবং ধারাল হয়েছে। যা কিছু সঞ্চিত হয়েছিল পূর্বে তার যেন সর্বস্ব প্রকাশ ঘটেছে সাহিত্যে। সাহিত্যের মূল রসকে যে শওকত আলী পরম মমতায় তুলে এনেছেন তার সৃজনশীলতা এবং মনন দ্বারা।

শওকত আলী সাহিত্যিক হিসেবে কখনোই স্রোতের ভিড়ে গা ভাসাননি। উপেক্ষা করেছেন যাবতীয় জনপ্রিয়তার পথ। নির্বিঘ্নে নিরুত্তাপে প্রাচীন ঋষির মতো একমনে কেবল সাহিত্য সাধনাই করে গেছেন। তার সমমনা বন্ধু আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যেমন ভীষণ নিরীক্ষাধর্মী সাহিত্যিক ছিলেন শওকত আলীও ছিলেন একই ধাঁচের। দুজনই ছিলেন বামপন্থায় বিশ্বাসী। অবশ্য তাদের সাহিত্যে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের সেই ছাপ পড়েনি।

শওকত আলীর সবচেয়ে মর্ম যাতনার বিষয়ে ছিল দেশভাগ। প্রকৃতই নিজের মাতৃভূমি এবং শিকড় ছেড়ে কতোটা কঠিন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একসময় তা স্বাভাবিক হয়ে যায় বটে। কিন্তু সেই সময়ের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যারা অসীম যাত্রাকে সঙ্গী করেছেন তারাই জানেন শিকড় ছিন্ন কতোটা নির্মম। শওকত আলী যেন তাই ভুলতে আশ্রয় নিয়েছেন সাহিত্যকে। শওকত আলী কখনোই নিজের শিকড়কে ভুলতে পারেননি কখনো। যিনি বারেবারে তার সাহিত্যে খুঁজে ফিরেছেন শিকড়কে। পাদপ্রদীপের আলো বরাবরই এড়িয়ে চলেছেন শওকত আলী। কিন্তু তার সাহিত্য কি আমাদের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়ার মতো?

জন্মদিবসে শওকত আলীর প্রতি শ্রদ্ধা। শওকত আলী চিরকাল থাকবেন তার সৃষ্টির মধ্য দিয়েই।

সূত্র –

মুখোমুখি শওকত আলী; শওকত আলীর সাক্ষাৎকার/ হামিদ কায়সার ও মাহবুব রেজা

শওকত আলী রচনাসমগ্র

শওকত আলীর সাক্ষাৎকার/ সাদিয়া মাহ্‌জাবীন ইমাম

অবিস্মৃত স্মৃতি/ শওকত আলী

Comments

The Daily Star  | English

Chief adviser returns home after joining COP29 in Baku

Chief Adviser Professor Muhammad Yunus returned home this evening wrapping up his Baku tour to attend the global climate meet Conference of Parties-29 (COP29)

1h ago