শ্রদ্ধা 

'মৃত যোদ্ধাদের সেনাপতি' কথাসাহিত্যিক ইসমায়েল কাদারে

প্রখ্যাত আলবেনিয়ান সাহিত্যিক ইসমাইল কাদারে মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।
ইসমাইল কাদারে। ছবি: সংগৃহীত

জনপ্রিয় আলবেনিয়ান কথাসাহিত্যিক ইসমায়েল কাদারে লোকান্তরিত হইলেন। আড্রিয়াটিক সাগরের পশ্চিম উপকূলে ইতালি আর পূর্ব তীর ঘেঁষিয়া গ্রিস। আধুনিক ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের এই দুইটি আমাদের বিশেষ পরিচিত দেশ। বিংশ শতাব্দীর শেষপাদে পৃথিবীর এই অংশে ক্রোয়েশিয়া, মেসিডোনিয়া প্রজাতন্ত্র, সারবিয়া ইত্যাদি নানা নূতন নূতন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হইয়াছে। কিন্তু আড্রিয়াটিক সাগরের পূর্ব উপকূলে গ্রিস, ক্রোয়েশিয়া এবং মেসিডোনিয়া প্রজাতন্ত্রের কোলে ক্ষুদ্র আরেকটি দেশ বহুকাল হইতে ক্লাসের লাজুক ছেলেটির মতো নিঃশব্দে বিরাজমান: ইহার নাম আলবেনিয়া। 

পবর্তসংকুল যে বলকান সাম্রাজ্য যুদ্ধ-বিগ্রহ, দ্রোহ, হত্যা আর অপরিমেয় মানব রক্তস্রোতধারার কারণে ইতিহাসের পাতায় বিশেষ স্থান অধিকার করিয়া আছে, আলবেনিয়া সেই বলকান ভৌগোলিক সত্তার একটি প্রাচীন অংশভাক্। উল্লেখযোগ্য যে, প্রথম মহাযুদ্ধের কিছু আগে, প্রথম বলকান যুদ্ধ শেষে, ১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূত আলবেনিয়া কয়েক শতাব্দীর অটোমান আধিপত্য হইতে মুক্ত হইয়া পৃথক রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিতি অর্জন করে।

আলবেনিয়া ইয়োরোপের দরিদ্রতম দেশ বলিলে মিথ্যাভাষণ হয় না। যেইখানে নরওয়েতে বাৎসরিক মাথাপিছু আয় প্রায় ৮৩,৫০০ মার্কিন ডলার, সেইখানে আলবেনিয়ার মানুষ সারা বৎসরে গড়ে ৬,৫০০ মার্কিন ডলারও আয় করিতে পারে না। এই দারিদ্র্যের জন্য কেহ-কেহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সমাজতান্ত্রিক শাসনকে দায়ী করিয়া থাকেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ঘটনার পাকে-প্রকারে মার্শাল টিটো আলবেনিয়ায় সমাজতন্ত্র কায়েম করিয়া ফেলেন। 

এক সময় টিটোর আনুগত্য ত্যাগ করিয়া আলবেনিয়ার কম্যুনিস্ট গোষ্ঠী স্টালিনের আনুগত্য বাছিয়া লয়। অতপর আলবেনিয়ার শাসকগোষ্ঠী  গাঁটছড়া বাঁধে গণচীনের সঙ্গে। রুমানিয়াতে চসেস্কুর পতন হইলে আলবেনিয়ার কম্যুনিস্ট শাসক রামিজ আলিয়া দেয়ালের লিখন পাঠ করিয়া নিজেই গণতন্ত্রের সূত্রপাত করেন। তবে ১৯৯২ সালের সাধারণ নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির বিজয় হইবার পরেই আলবেনিয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অভিষেক হয়।

আলবেনিয়ান পৃথিবীর স্বল্প পরিচিত একটি ভাষা। পৃথিবীতে বড়জোর ৭৫ লক্ষ লোক এই ভাষায় কথা বলে। পাঠক সংখ্যা সীমিত হইলেও এবং বিশেষ করিয়া ধারাবাহিক রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মুখেও এই দেশটির সাহিত্য গত পঞ্চাশ বছরে যথেষ্ট সমৃদ্ধি অর্জন করিয়াছে। ইসমাইল কাদারে এই ভাষারই লেখক, সম্ভবতঃ প্রধান লেখক। ১৯৯০ হইতে তিনি ফরাসী দেশে অভিবাসন গ্রহণ করিয়াছেন। ফরাসী ভাষায় তাহার প্রায় সকল গ্রন্থ অনূদিত হইয়াছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফরাসী হইতে বা সরাসরি আলবেনীয় হইতে উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি সহ তাহার আশিটি গ্রন্থ এযাবৎ পৃথিবীর ৪৫ ভাষায় অনূদিত হইয়াছে। 

বিশেষ প্রণিধানযোগ্য এই যে,  ২০০৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য চেক ঔপন্যাসিক মিলন কুন্ডেরা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলিপ রথ, সিরিয়-লিবানীজ কবি এডোনিস, আলজেরিয়ান কথা সাহিত্যিক আসিয়া ইয়াবার এবং সুইডিশ কবি টমাস ট্রান্সট্রুমারের সহিত আলবেনিয়ার ইসমাইল কাদারের নামও বিবেচিত হইয়াছিল। ইহার পর বহুবার নোবলে পুরস্কারের সম্ভাব্য প্রাপকদের তালিকায় তাহার নাম আসিয়াছে।

কাদারে লিখিয়াছেন 'কবিতা আমার শেষ গন্তব্য'। তাহার সাহিত্যিক জীবনের শিলান্যাসও হইয়াছিল কবিতা দিয়া। তবে আজ ইসমায়েল কাদারের প্রধান পরিচয় কথাসাহিত্যিক হিসাবে। সাহিত্যের কারবারিদের চোখে তিনি আধুনিক জামানার আন্তর্জাতিক ঔপন্যাসিকদের অন্যতম। ম্যান বুকার পুরস্কার পর্ষদের পুরোহিত জন কেরী বলিয়াছিলেন: কাদারে গল্পের জাদুকর─ বিংশ শতাব্দীর ঘোর অমানিশার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ। 
একটি কবিতায় কাদারে লিখিয়াছেন : 

হে কবিতা, কী ক'রে ঠিক তুমি খুঁজে পেলে আমার ঠিকানা ─ 
আমার মা ভালো আলবেনিয়ান জানে না,
তাঁর অক্ষর আরাগনের মতো: দাঁড়ি-কমা নেই ;
আমার বাবা যৌবন কাটিয়েছেন সমুদ্র অভিসারে ;
কিন্তু এই নির্জন পাথুরে নগরীতে তুমি এলে হেঁটে ─ 
দুই পায়ে, তিনতলা ১৬ নম্বর বাড়ির দরোজায় তোমার 
লাজুক করাঘাত।...

এইরূপ লিখিবার কারণ আছে। ১৯৩৬-এ কাদারের জন্ম। তাহার জন্মের মাত্র চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বৎসর পূর্বে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আলবেনীয় ভাষার বর্তমান অক্ষরমালা প্রবর্তিত হয়। ইসমাইল কাদারে এই ভাষাতেই লিখিয়া থাকেন। তাহার মায়ের কাছে এই লিপিমালা খুব পরিচিত ছিল  না।  

১৯৬৮ সালে প্রকাশিত তাহার একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস ইন্টারনেটে লভ্য। বাংলা করিলে ইহার নাম দাঁড়ায় 'বিবাহ'। প্রচলিত প্রথায় একটি তরুণী গ্রাম্য মেয়ের বিবাহ ধার্য করা হইয়াছে। এই সম্পর্কে মেয়েটির মত নাই, সে আরেকজনকে ভালবাসে। তাহার কথা কে শুনিবে? কিন্তু বিবাহ উৎসবে একদল শ্রমিক আসিয়া মেয়েটিকে উদ্ধার করিয়া লইয়া যায়। শেষ পর্যন্ত মেয়েটি তাহার ভালবাসার পুরুষটির সহিত মিলিত হয়। তাহারা আবদ্ধ হয় বিবাহসূত্রে। 

উপন্যাসের শুরুতে কয়েক লাইনের একটি ক্ষুদ্র্র ভূমিকা আছে যাহা নিম্নরূপ : 
মার্চে এক রবিবার প্রত্যূষে দেখা গেল রেললাইনের এন. সেক্টরে কাহারা যেন রেল নষ্ট করিয়া রাখিয়াছে। ইহাতে যাত্রীবাহী ট্রেনটির ছয় মিনিট বিলম্ব হইল। রেল কোম্পানির লোকজন আসিয়া দেখিয়া-শুনিয়া ঠাহর করিতে পারিল না কেন এইরূপ হইল। তবে সকালেই কে যেন রেল কোম্পানির অফিসে ফোন করিয়া বলিয়াছিল, রেল বাঁকিয়া যাওয়ার কারণে রেল চলাচলে বিঘ্ন ঘটিয়াছে। জোরেশোরে নূতন রেল বসানোর কাজ চলিতেছে। নিশ্চিত যে রাত্রিকালে মাতাল কিছু বরযাত্রী এই অপকর্মটি করিয়াছে। অফিসেই একজন রেলচালক ছিল। সে গত মধ্য রাত্রিতে মালগাড়ি চালাইয়া আসিবার সময় প্রত্যক্ষ করিয়াছে যে রেলস্টেশনের ধারেকাছেই মহাসমারোহে বিশাল এক বিবাহ উৎসব চলিতেছে। 

যাইবার ও ফিরিবার উভয় দফায়ই সে বেদম ড্রাম পিটুনির শব্দ আর মানুষের তুমুল হৈ-হুল্লোড় শুুনিয়াছে। রেল কোম্পানির তদন্তকারীরা অচিরেই সিদ্ধান্তে পৌঁছিল যে ইহা মাতাল বরযাত্রীদেরই কাজ। জানা গেল, তাহাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন রেল বসানোর শ্রমিকও ছিল। রেল নষ্ট করিয়া তাহারা সম্ভবত বিশেষ আমোদ পাইয়াছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আর সেইখানেই মূল গল্প নিহিত।

সম্ভবতঃ এই অনুবাদ খুব বিশ্বস্ত হয় নাই। কিন্তু তাহাতে ইসমায়েল কাদারে মনঃক্ষুন্ন হইতেন না। তাহার ভাষা সোজা-সাপটা। কিন্তু ফরাসি অনুবাদকরা তাহার অনুবাদের সময় যথেষ্ট স্বাধীনতা লইয়া থাকেন। ফরাসি অনুবাদের ভাষা সাধারণত জটিল ; অনুবাদকদের বদৌলতে কাদারের নিরলংকার ভাষা ফরাসি অক্ষরে বেশ কাব্যিক হইয়া ওঠে। কাদারের ইহা পছন্দ ছিল। অনুবাদ অনুসরণ করিয়া তিনি প্রায়শঃ আলবেনীয় ভাষায় রচিত মূল রচনা পরিমার্জনা করিয়া ফেলিতের।  

এই পর্যন্তই: কাহিনীর সন্ধানে কদাপি তিনি আলবেনিয়ার বাহিরে যান নাই। আলবেনিয়ার ইতিহাস, অতীত ও বর্তমান সর্বদাই তাহাকে প্রভূত ইন্ধন যোগাইয়াছে। ৪৪৪ পাতার উপন্যাস 'মহা শীত' আবর্তিত হইয়াছে ১৯৬১ সালে পূর্ব ইউরোপীয় কম্যুনিস্ট গোষ্ঠী হইতে আলবেনিয়ার বিচ্ছিন্নতার ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া। ৭০৪ পাতার 'শীত শেষের বাদ্য' নামীয় মহাকাব্যিক উপন্যাসের কেন্দ্রে রহিয়াছে আলবেনিয়া এবং মাও যেদঙ-এর গণচীনের মধ্যকার রাজনৈতিক পরিণয়ের সমাপ্তি।

কিন্তু আলবেনিয়া পৃথিবী নামক গ্রহটির বাহিরের কোনো দেশ নহে। স্বৈরশাসকের রাহুগ্রাসে যে ভীতি ও সন্দেহ অন্ধকার আলবেনিয়ার সমাজকে দীর্ঘকাল কলংকিত করিয়া রাখিয়াছিল তাহা আবহমান মানব সভ্যতারই পর্যায়ক্রমিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি। মানবসৃষ্ট এই ভীতি ও সন্দেহ পৃথিবীর নানা অংশে নানা কাল খণ্ডে আস্তানা গাড়িয়াছে। কাদারের দর্পণে তাহার যে কোনটিকে নির্ভুল চিনিয়া লওয়া যায়।  

কাদারের অনুরাগী পাঠক ও অনুবাদক ডেভিড বিলোস বলিয়াছেন, রচনার পরিমাপে তিনি বালযাকের সমতূল্য, স্বৈরচারীর শাসনের সমালোচনায় তিনি জর্জ অরওয়েলের কথা স্মরণ করাইয়া দেন আর অসম্ভবের কল্পনায় তিনি কাফ্কার চাইতে কম যান না। কিন্তু যুদ্ধদীর্ণ সভ্যতার নানা প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ মানুষ যে অনিশ্চয়তা আর সংকটের শিকার, নানা উপন্যাসে তাহার প্রতিফলন প্রত্যক্ষ করা যায়। 'মৃত যোদ্ধাদের সেনাপতি' ইসমাইল কাদারের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস। 

তাহার অন্যান্য কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের নাম হইল: 'বিবাহ', 'পাথরের রোজনামচা', 'তিন খিলানের সেতু', 'ভাঙা এপ্রিল', 'পিরামিড', 'স্বপ্ন প্রাসাদ', 'শীত শেষের বাদ্য' এবং 'কসোভোর জন্য তিনটি শোকগাথা', 'বসন্তের ফুল, বসন্তের হিমকণা', 'একটি পূর্ণিমা রাত্রি', 'ইস্কাইলাস অথবা অনন্ত পরাজয়ের মানুষ' ও 'উত্তরাধিকারী'। তাহার সামপ্রতিক কালের উপন্যাসের মধ্যে রহিয়াছে ২০২২ সালে প্রকাশিত 'ওপরওয়ালাদের কাজিয়া', ২০১৭ সালে প্রকাশিত 'কাফে রোস্তাঁ'র সকালগুলি', ২০১৫ সালে প্রকাশিত 'পুতুল' এবং ২০১৩ তে প্রকাশিত 'মতানৈক্য'। আলবেনিয়ার পাঠকদের কাছে ইসমায়েল কাদারের বিশেষ সমাদর রহিয়াছে। 

ষাট বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে বলকান ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান শেষ হয় নাই। প্রাচীন সমাধি গহ্বর হইতে বাহির হইয়া তাহার নায়কেরা পাঠকের কাঠগড়ায় আসিয়া দাঁড়ায়। আধুনিক ইয়োরোপে এইরূপ একাট্টা জাতীয়তাবাদী লেখক আর নাই বলিয়াই মনে।

গত ষাটবছর যাবৎ তাহারা কাদারের নূতন উপন্যাসের জন্য উৎসুক হইয়া অপেক্ষা করিত। কাদারে অনর্গল লিখিতে পারিতের। তাহার ৭০৪ পাতার 'শীত শেষের বাদ্য'-এর প্রথম সংস্করণ ছিল ২০ হাজার। ১৯৮৮ সালে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রকাশিত হইবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই বিশাল উপন্যাসের প্রথম সংস্করণের ২০ হাজার কপিই তিরানার বই বাজারে বিনিঃশেষ হইয়া যায়। ইহা কম কথা নহে। 

ষাট ও সত্তর দশক হইতে আলবেনীয় সাহিত্যে বিশেষ জোয়ার পরিলক্ষ্য করা যায়। কাদারে ইহার অন্যতম পুরোধা। কমিউনিষ্ট শাসনের নিগঢ় তাহাকে অবরূদ্ধ করিতে পারে নাই। সম্ভবত এই কারণেই কাহিনী বিন্যাসের ক্ষেত্রে সমকালীনতাকে আশ্রয় না-করিয়া প্রায়শঃ তিনি দূর ইতিহাসের আলো-ছায়ায় বসতি গাড়িয়াছেন। বলকান ইতিহাস, ইউরোপের উত্থান-পতন ইত্যাদি তাহার বিভিন্ন উপন্যাসের কাহিনীপটের পৌনঃপুনিক উৎস।

বস্তুতঃ বর্তমান ও অতীতের দূরত্ব কাদারের কাহিনীতে বিলীন হইয়া যায়। বর্তমানের ঘটনাকে ইতিহাসের দূরাশ্রিত কাহিনীর অবয়বে ধারণ করিতে তিনি ভালোবাসেন। ষাট বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে বলকান ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান শেষ হয় নাই। প্রাচীন সমাধি গহ্বর হইতে বাহির হইয়া তাহার নায়কেরা পাঠকের কাঠগড়ায় আসিয়া দাঁড়ায়। আধুনিক ইয়োরোপে এইরূপ একাট্টা জাতীয়তাবাদী লেখক আর নাই বলিয়াই মনে।

উল্লেখ্য যে, 'মৃত যোদ্ধাদের সেনাপতি' শুরুতে ছিল একটি ছোট গল্প মাত্র। ক্রমান্বয়ী পরিবর্ধনের ফলে তাহা উপন্যাসের অবয়ব পরিগ্রহ করে। কিন্তু ইংরেজী অনুবাদে প্রথম প্রকাশের সময় ইহা লন্ডনের পাঠক মহলে বিশেষ সাড়া জাগাইয়াছিল। কিন্তু বিলাতী পাঠকের এই আনুকূল্য দীর্ঘকাল বজায় থাকে নাই। ২০০৫ এ জুন মাসের ২ তারিখে যখন বুকার পুরস্কার প্রাপ্তির ঘোষণা দেওয়া হইল তখন বিলাতের বড় বইয়ের দোকানে ইহার একটিও কপি মজুত ছিল না। যাহা হইক আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার না-হইলে ইসমায়েল কাদারে হয়ত আমাদের কাছে চির-অপরিচিত থাকিয়া যাইতেন। আলবেনীয় ভাষার  অস্তিত্ব ও ইহার সাহিত্য সম্পর্কে অবহিত হইতে আরো দীর্ঘকাল অপেক্ষা করিতে হইত।  

আগেই বলা হইয়াছে কাহিনীর সন্ধানে কাদারে বারংবার আলবেনিয়ার অতীতের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন। এমনকি পৌরাণিক অতীত ও কুসংস্কারেরও ব্যবচ্ছেদ তাহার রচনায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করিয়াছে।

'মৃত যোদ্ধাদের সেনাপতি' পাঠকের মনোযোগ কাড়িবার প্রভূত কারণ ছিল। কাহিনীটি একই সঙ্গে অদ্ভুত ও আকর্ষণীয়: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন ইতালীয় সেনাপতি তাহার অধীনস্থ যোদ্ধাদের সমাধির তালাশে এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় আলবেনিয়ায় আসিয়া পৌঁছিয়াছেন; অঝোরে বৃষ্টি পড়িতেছে, মাটি কর্দমাক্ত, জীপের চাকা আটকাইয়া যায়, ওয়াইপার উই-শিল্ডকে পরিস্কার রাখিতে পারে না। কুড়ি বছর আগে যুদ্ধ শেষ হইয়াছে কিন্তু তাহার মনে হয় তিনি এখনো সেনাপতি, পুরা এক মৃত সেনাদলের অধিনায়ক। আলবেনিয়ার পথে-প্রান্তরে তিনি সহদ্ধোদের সমাধি খুঁজিয়া বাহির করিবেন, অতঃপর তাহাদের দেহাবশেষ স্বদেশে লইয়া যাইবেন; দেশের মাটিতে তাহাদের শেষ শয্যার ব্যবস্থা করিবেন :
 
'মাটির গভীরাশ্রয়ে সমাধিস্থ শত-সহস্র যোদ্ধার দেহাবশেষ এত বছর ধরিয়া তাহার আগমনের অপেক্ষায় রহিয়াছে। অবশেষে তিনি আসিয়াছেন, যেন ত্রাণকর্তা যিশু; সঙ্গে যোদ্ধাদের দীর্ঘ তালিকা, অভ্রান্ত নির্দ্দেশ সম্বলিত প্রচুর মানচিত্র : মৃত্তিকার গভীর হইতে উদ্ধার করিয়া তিনি তাহাদিগকে তাহাদের স্বজনদের নিকট ফিরাইয়া দিবেন। অন্যান্য সেনাপতিরা এই সব অপরাজেয় সেনাদলকে নিছক পরাজয় আর বিনাশের মুখে ঠেলিয়া দিয়াছে। কিন্তু তিনি, তিনি আসিয়াছেন অবশিষ্ট যে কয়জনকেই পাওয়া যায় বিস্মরণ ও মৃত্যুর থাবা হইতে তাহাদের উদ্ধার করিতে। সমাধিক্ষেত্র হইতে সমাধিক্ষেত্র তিনি চষিয়া বেড়াইয়াছেন ; একদিন অকস্মাৎ করিয়া যাহারা উধাও হইয়া গিয়াছিল প্রতিটি যুদ্ধস্থলে অনুসন্ধান চালাইয়া তিনি তাহাদের খুঁজিয়া বাহির করিবেন। ... ' ['মৃত যোদ্ধাদের সেনাপতি']

তাহার প্রতিজ্ঞা কঠিন। যতই দিন যায় তিনি অনুধাবন করিতে থাকনে কী এক অসম্ভব অনুসন্ধানযজ্ঞে তিনি অবতীর্ণ হইয়াছেন। তাহার মহতী প্রতিজ্ঞা ক্রমশঃ নিষ্ফলা প্রমাণিত হইতে থাকে। আলবেনিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত জনগণ তাহার কার্যকলাপে উষ্মা প্রকাশ করে। একদিন একটি অপ্রকৃতিস্থ বুড়ি কুখ্যাত জনৈক কর্ণেল যেড্ এর হাড়-গোর তাহার পদতলে ছুঁড়িয়া মারিলে তাহার বোধোদয় হয়, তাহারা প্রতীজ্ঞা পর্যবসিত হয় অমোঘ দুঃস্বপ্নে। একসময় সেনাপতি নিজেও অপ্রকৃতিস্থ হইয়া উঠেন। 

যেমন আগেই বলা হইয়াছে কাহিনীর সন্ধানে কাদারে বারংবার আলবেনিয়ার অতীতের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন। এমনকি পৌরাণিক অতীত ও কুসংস্কারেরও ব্যবচ্ছেদ তাহার রচনায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করিয়াছে। সাম্প্রতিক ঘটনাকে অতি প্রাচীন অথচ সমতূল্য ঐতিহাসিক কোনো ঘটনা, এমনকি পুরান বা উপকথার আলোকে নিরীক্ষা করিয়া দেখিবার এইরূপ অনুরাগ সচরাচর দেখা যায় না। ১ জুলাই ২০২৪। আলবেনিয়ার সাহিত্য জগৎকে অনাথ করিয়া তিনি পরলোকে যাত্রা করিলেন। অবশেষে তাহার কলম নিরস্ত হইল। তাহার স্মৃতির উদ্দেশ্যে আমাদের নিরন্তর শ্রদ্ধা।

Comments