ভাঙা হচ্ছে টাঙ্গাইল শহরের শেষ সিনেমা হলটিও
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে টাঙ্গাইলের মানুষের সুস্থ বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল সিনেমা। প্রাচীন এ শহরে একে একে গড়ে উঠে ৫টি সিনেমা হল। 'রওশন', 'রূপবানী', 'রূপসী', 'কেয়া' ও 'মালঞ্চ'। ইতোমধ্যে ৪টি হল বন্ধ হয়ে গেছে। এবার সবশেষ 'মালঞ্চ' সিনেমা হলটি ভেঙে ফেলার মধ্য দিয়ে শতবর্ষী শহরে অবসান হয়েছে রূপালী পর্দা যুগের।
এর আগে ১৯৯৬ সালে 'রওশন' হলটি ভেঙে শপিং মল নির্মাণ করা হয়। এরপর একে একে ২০০০ সালের দিকে 'রূপবানী', ২০০৮ সালে 'রূপসী' ও ২০১৯ সালে 'কেয়া' সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যায়।
মালঞ্চ হলের ব্যবস্থাপক আব্দুল মিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ''১৯৭৪ সালে 'জিঘাংসা' ছবি মুক্তির মাধ্যমে সিনেমা হলটির যাত্রা শুরু হয়। তখন ব্যবসা ভালো ছিল। পরে দর্শকের অভাবে হলের আয় না থাকায় বছরের পর বছর লোকসান গুনতে হয়েছে। দীর্ঘদিন লোকসান দিয়ে হলটি চালু রাখা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত হলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।'
এতে সিনেমা বা সিনেমা হল ব্যবসা যে একবারে বন্ধ হয়ে গেল তা মনে করেন না আব্দুল। তিনি মনে করেন, এখনো আকর্ষণীয় গল্প নিয়ে ভালো চলচ্চিত্র তৈরি করা গেলে এবং সরকারি সহায়তায় ডিজিটালাইজড সিনেমা হল নির্মিত হলে এই শিল্প এবং ব্যবসা বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।
জানা গেছে, ১৯৯০ সালেও টাঙ্গাইলে মোট ৫১টি সিনেমা হল ছিল। এসব সিনেমা হলে ৫টি শিফটে সিনেমা প্রদর্শন করা হতো। শহর থেকে শুরু করে হাটে-বাজারে পোস্টার ও মাইকিং করে সিনেমা মুক্তির তারিখ, নায়ক-নায়িকা, ভিলেট এবং হলের নাম প্রচার করে দিন-রাত মাইকিং করা হতো। ঈদ ও বিভিন্ন উৎসবে সিনেমা হলের সামনে উপচে পড়া ভিড় থাকতো।
পরে দর্শকের অভাবে একে একে বন্ধ হয়ে যায় ৪৬টি সিনেমা হল। জেলা শহর ও উপজেলা মিলে যে ৫টি সিনেমা হল কোনোক্রমে টিকে ছিল তার মধ্যে টাঙ্গাইল শহরের শেষ সিনেমা হল মালঞ্চও আর রইল না। সিনেমা হল ভেঙে সেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে আধুনিক বহুতল ভবন।
টাঙ্গাইল শহরের মাইকম্যান নামে পরিচিত সিরাজ মিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, এক সময় কোন হলে কি সিনেমা চলছে তা জানতে হলের মাইকিং শুনতে উন্মুখ থাকতো শহরের মানুষ। রেডিওতে শোনা যেত সিনেমার ট্রেলার। এখন সেসবের কিছুই আর নেই।
'ঢাকার কাছে হওয়ায় আগে অনেক ছবি টাঙ্গাইলের হলে প্রথম মুক্তি দেওয়া হতো। ছবি দেখে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া জানতে জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকা, পরিচালকরা তখন দর্শকদের সঙ্গে হলে বসে সিনোমা দেখতেন। তাদের দেখতে মানুষের ভিড়ে নিনেমা হলগুলো ভেঙে পড়ার উপক্রম হতো', বলেন সিরাজ।
তিনি বলেন, '৪০ বছর মাইকিং পেশার অধিকাংশ সময় সিনেমার মাইকিংই করেছি। এখনো মাইকিং করে জীবিকা নির্বাহ করি। তবে সিনেমা হলগুলো আর নেই।'
সিনেমা হল সংশ্লিষ্টরা জানান, টাঙ্গাইলে সিনেমা হলের ব্যবসা শুরু হয় ১৯৫০ সালে লেবু চৌধুরী কর্তৃক তৎকালীন ছোট পৌর শহরের এক নির্জন কোণে 'রওশন টকিজ' নির্মাণের মাধ্যমে।
লেবু চৌধুরীর পথ অনুসরণ করে ১২টি উপজেলায় একে একে নির্মিত হতে থাকে অসংখ্য সিনেমা হল। ১৯৯০-এর দশকে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৫১-তে।
লেবু চৌধুরীর মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে শহরের দিঘুলিয়া এলাকার মন্টু মিয়া ১৯৬৪ সালে শহরের প্রধান সড়কে সবচেয়ে আকর্ষণীয় সিনেমা হলটি নির্মাণ করেন। তিনি হলটির নাম দেন 'রূপবানী', যা ছিল জেলার দ্বিতীয় প্রেক্ষাগৃহ।
১৯৭৩ সালে জেলার হল মালিকদের প্ল্যাটফর্মের আজীবন সভাপতি লেবু চৌধুরী টাঙ্গাইল শহরের বটতলায় নিজের জমিতে 'রূপসী' নামে দ্বিতীয় সিনেমা হল (জেলায় তৃতীয়) নির্মাণ করেন। পরে দেলদুয়ার, মির্জাপুর ও ধনবাড়ী উপজেলায় আরও ৩টি সিনেমা হল নির্মাণ করেন।
১৯৭৫ সালে আদালতপাড়ার ছানা মিয়া আদালতপাড়া ও থানাপাড়ার মাঝে চতুর্থ সিনেমা হল হিসেবে 'মালঞ্চ' নির্মাণ করেন এবং পরের বছর একই এলাকার আফজাল চৌধুরী 'কেয়া' নামে একটি হল নির্মাণ করেন।
২০০০ সাল পর্যন্ত ব্যবসাটি লাভজনক ছিল। হলগুলোতে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত ৫টি করে শো প্রদর্শিত হতো।
হলের ভেতর ৫টি স্তরে বসার ব্যবস্থা ছিল- সামনের স্টল, স্টল, রিয়েল স্টল, ডিসি এবং বক্স। তাছাড়া নারী দর্শকদের জন্য আলাদা বসার ব্যবস্থা ছিল। দর্শকরা সিনেমা উপভোগ করার জন্য কোন আসন বেঁছে নেবেন তার ওপর নির্ভর করতো টিকিটের দাম।
দেলদুয়ারের খলিল মিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি কৈশরে শহরের একটি দোকানের কর্মচারী হিসেবে কাজ করতাম। শহরে থাকার লোভে তখন অনেক কষ্ট করে চাকরি করতাম। তার একমাত্র কারণ ছিল সিনেমা দেখা। কোনো সিনেমাই বাদ দিতাম না, সব দেখতাম। এমনো সিনেমা আছে কয়েকবার করে দেখেছি।'
'সিনেমার কাহিনীগুলো কত সুন্দর ছিল! অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কত সুন্দর অভিনয় করতেন। দুঃখের দৃশ্য দেখে চোখের জল ফেলতাম। আবার ভিলেনের বিরুদ্ধে নায়কের জয় দেখে উৎফুল্ল হয়ে শীষ দিয়ে উঠতাম' বলেন খলিল।
তিনি বলেন, 'জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে মানুষ শহরে সিনেমা দেখতে আসতেন। ২-৩ দিন শহরের সস্তা হোটেলে থেকে সব হলের সিনেমা দেখে ফিরতেন।'
সে সময় সিনেমা ব্যবসা এত জমজমাট ছিল যে ব্যবসার ক্রমবর্ধমান গতি অনুসরণ করে, জেলায় সিনেমা হল শ্রমিক ইউনিয়ন গঠিত হয়েছিল।
শহরের বিভিন্ন সিনেমা হলে মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ করা বাসাইলের মোখলেসুর রহমান পেশা বদলে এখন ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ করছেন। তিনি বলেন, 'আহা কি দিন ছিল! মানুষ কত সিনেমা পাগল ছিল।'
বর্তমানে নাগরপুর সদর উপজেলায় ২টি, মধুপুর উপজেলায় ১টি এবং কালিহাতী উপজেলার বাল্লায় ১টি সিনেমা হল অনিয়মিতভাবে চালু রয়েছে। তবে চরম মন্দার কারণে কতদিন চালিয়ে যেতে পারবেন তা জানেন না হল মালিকরা।
টাঙ্গাইলের কলেজ শিক্ষক রোখসানা খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ''ছেলেবেলায় বাবা-মার কোলে চড়ে সিনেমা দেখতে যেতাম। 'মালঞ্চ' আর 'রূপবানী' হলে সবচেয়ে ভালো সিনেমাগুলো প্রদর্শিত হতো। তখন শহরের সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলো সন্ধ্যার শো-টা বেশি দেখতো। আর কর্মজীবীরা রাতের শো। কত ভালো ভালো সিনেমাই যে এদেশে হয়েছে বলে শেষ করা যাবে না।'
'প্রযুক্তির প্রসার সব জায়গাতেই ঘটেছে। দুঃজনক হলেও সত্য, প্রতিবেশি ভারতসহ সারা দুনিয়াতেই সিনেমা শিল্প আরও প্রসার লাভ করেছে কিন্তু বাংলাদেশের সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সিনেমা শুধু যে বিনোদনেরই মাধ্যম তা নয়, সমাজ সংস্কারেও সিনেমা একটি শক্তিশালী মাধ্যম,' বলেন রোখসানা।
'বাংলাদেশেও কিন্তু এখন ভালো সিনেমা নির্মিত হচ্ছে। মানুষ দেখতে ভিড়ও জমাচ্ছে। কাজেই শিক্ষিত ও পেশাদাররা এগিয়ে এলে সুস্থ চলচ্চিত্র নির্মিত হলে, সরকার আধুনিক সিনেমা হল নির্মাণে আন্তরিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করলে এদেশে আবারও সিনেমা শিল্পের প্রসার ঘটবে বলে মনে করেন তিনি।
Comments