পর্যালোচনা

ভেড়া ও ভয়তন্ত্র : প্রখর জীবনবোধের অভিধান

কবিতা সময়ের কথা বলে। পড়ছিলাম 'ভেড়া ও ভয়তন্ত্র' শিরোনামে কবিতার বই। কবিতার শরীরজুড়ে রয়েছে ভয়ের আবেশ। এটি কোনো মানবিক বিকার নয়, স্রেফ রাজনীতি ও রাষ্ট্রের অসংলগ্ন মিলন থেকে উপজাত এক বিশেষ ভয়। বিশেষ উৎপাদ। এ ভয় আজ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। কবির রাজনৈতিক দায় ফুটে উঠেছে কবিতার পরতে পরতে। 'উপকথার পরের কথা' কবিতায় কবি লিখেছেন- ভাগাড়ে সুশাসন কেমনতর 'সু-রই সুশাসন, পশুদের নয়। দুঃশসানের কবলে পড়ে জনগণের উপস্থিতি কবির ভাষায় হয়ে উঠেছে ভেড়াসদৃশ।'

শ্লেষ প্রকাশে মোক্ষম শব্দের সন্ধানে নিবিষ্ট কবি বুকের অভিধান থেকে বের আনেন 'শুয়োর' নামক বিশেষ্য। একই কবিতায় কবি বলছেন- শুয়োররা গতকাল আর্জি জুড়েছে হত্যা মামলার, মামলা, হামলা, অনুকম্পা, হুঙ্কারে স্থির ভেড়াদল। রাষ্ট্র মানুষকে রেখেছে আজ দৌড়ের ওপরে। এমন রাষ্ট্রে সংক্ষুব্ধ কবি হয়েছেন হুইসেলব্লোয়ার। মানুষ ও রাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড়ানোর এক করুন মানচিত্র হলো ভেড়া ও ভয়তন্ত্র' । কথা ছিল মানুষ ও রাষ্ট্রের সখ্য হবে অলঙ্ঘনীয়। আজ এ সম্পর্কে পড়ছে ছেদের ছাদর। 

রাষ্ট্রীয় ভয় বিস্তরণে দৃশ্যমান ক্রসফায়ার। বাঙাল জনম কবিতায় কবি লিখেছেন-ক্রশফায়ারের মজা দেখেন, টাশ টাশ টাশ, খরচের খাতায় অল্প কয় ভেড়া অথবা পাখাগজানো পিঁপড়ে, অবলীলায় পিষে যেতে-শুধু বাংলায় জন্মাতে হয়। বুজি কবিতায় বিবৃত- গুম হয়ে যাচ্ছে... কথা বলা মুখ, রাষ্ট্র দখলে নিচ্ছে অসংখ্য ইতর। কবিতাসমগ্রে কবির উত্থান ঘটে এক প্রতিনিধিত্বশীল সত্ত্বা হিসেবে। শত মানুষের অব্যক্ত কণ্ঠের প্রতিভূ হয়ে উঠেছেন তিনি। কবি অপ্রিয় সত্য উচ্চারণে হয়ে উঠেছেন বিশেষ পারঙ্গম। 

এ রাষ্ট্রে নিপীড়ন নিত্য হয়ে উঠছে। হয়ে উঠছে এক স্বাভাবিক প্রপঞ্চ। এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেন কবি। লিখেছেন-কোথাও বিরাম নাই, কোন বিকার নাই, কোনো অনুশোচনা নাই। এমন এক বোধহীন সমাজের দিকে ধাবিত হচ্ছে প্রিয় স্বদেশ আজ। এমন অসম পরিস্থিতিতে কবি ভোট নিয়ে, গণতন্ত্র নিয়ে ভাবেন। ভয়তন্ত্র কবিতায় দেখা যায়- যেন দুর্ভাগ্য বেছে নেবার-বাজে সিদ্ধান্ত নেবার-দায় আপনার উপর না বর্তায়!

কবি পাঠকদের এক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন।  প্রশ্ন তুলেছেন কদাকার রাষ্ট্রে শিল্প, সাহিত্য বা সংস্কৃতি চর্চা কী কোনো ফলদায়ক ব্যাপার? বাঙাল জনম-২ কবিতায় তিনি লিখেছেন- শুদ্ধ শব্দ নয়, সংগীত নয়, সমস্ত মনন মৃত-রফিক আজাদ থেকে রায়-গুণাকর, বাঙালের কবি আজ-সত্য শুধু থালা ভর্তি ভাতের মিনার। রাষ্ট্রের স্পষ্ট আচরণ কবির কলম থেকে বেরিয়ে এসেছে-বাঙাল জনম কবিতার তিনি বলছেন-কবিতা হান্দায় দিমু জায়গা দিয়া, অহন যা মেলা কর গিয়া। এ হান্দা হান্দি আজ নানাপ্রকরণে নানা বিন্যাসে রাষ্ট্রীয় জীবনব্যাপী।

সিজার ওহ্ সিজার কবিতায় ১৫ আগস্টের নির্মমতা উঠে এসেছে। কবি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন-স্বাধীনতা এনে দিলে মরে যেতে হয়, ব্রুটাস বেঁচে থাকে প্রেত জনমে।' বিষ্ণুপুরের বিষ জারি কবির শরীর। কবি উৎসগামী। পুরানো রাগে বা নস্টালজিয়া ভুগেন তিনি। বিষ্ণুপুর কবির দেশ। এ দেশ তার নিশানা বা গন্তব্য। বার বার ফিরে যেতে চান  বিষ্ণুপুরে। বিষ্ণুপুরের প্রতি কবির অন্তঃনিষ্ঠা কবিতায় ফিরছে বিশেষ মমতায়। বিদেশ-বিভুঁইয়ে থেকেও তার মনোজগৎ মুহূর্তের জন্যে ছুটি পায় না বিষ্ণুপুর থেকে। বিষ্ণুপুর কবির অন্তরে জ্বালা শিখা চিরন্তন। কবি নিউইয়র্কের আকাশে বিষ্ণুপুরের মেঘ কবিতায় কবি লিখছেন-কে কাকে ছেড়ে যায়! যতদূর আমি যাই- বিষ্ণুপুর ধায়। বিষ্ণুপুর কবির মূল পাঠাতন। সৃষ্টির জ্বালানি ও রসদের ভাণ্ডার। তা স্বীকারে কবির কোনো দ্বিধা নেয়। বিষ্ণুপুর-৪ কবিতায় তিনি লিখছেন- শিরদাঁড়া সোজা রাখো, কাঁধের উপরে রাখো শির, প্রাণপণে ভেসে থাকো, শ্বাস জারি রাখো, বিষ্ণুপুর।

আর দশ জন কবির মত মৃত্যু চিন্তাও কবিকে আচ্ছন্ন করেছে। তিনি মৃত্যু নিয়ে গভীর ভাবনায় পড়েছেন। আশিক, তাকায়ে আছো কবিতার শেষ পঙক্তি- মরে যাবার আগে জীবিতের যেতে হয় বহুদূর পথ। দমবন্ধ মুহূর্তেও পর কবিতায় মৃত্যু ভাবনা ধরা পড়ে আরও স্বচ্ছভাবে-পরিশুদ্ধ উচ্চারণ, নিয়মিত বিরতির প্রত্যেকটা দমবন্ধ মুহূর্তের পর, যখন নিজের পৃথিবী ফেরত পাই-ভাবি নেহায়েত মন্দ নয় এ জীবন। তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, জীবন মৃত্যুর মুখাপেক্ষী নয়, মৃত্যুতে শেষ নয় গহিন জীবন।

প্রখর জীবনবোধ নিয়ে কবির বেঁচে থাকা। যেভাবে বেড়ে উঠি কবিতায় কবির বিবৃতি- বোধের বারান্দায় প্রতিদিন নিকাতে হয়, শান তো শান দিতে হয় ধার। তিনি নিয়ত প্রয়াসে উদ্ভাসিত নানা ব্যঞ্জনে। অবিরত অন্ধকারের সামান্য পথ কবিতায় তিনি লিখেছেন- জলের খবর জানে না কেউ। দূর নক্ষত্র নিশানা। যতক্ষণ বেঁচে আছি বুনি বিবিধ আলাপন। বিষ্ণুপুর-৩ কবিতায় আবারো লিখছেন-জীবন তো পুরোটা নেশার কৌটা। যতক্ষণ শ্বাস আছে কবি বুনে যেতে চান অনুভবের জাল।

কবিতার উপমা বর্গীকরণ করলে দেখা যায়, ভেড়া, শুয়োর, ভয়, অন্ধকার, ভাত, স্বপ্ন, সময় ও রক্তের প্রকাশে। যেমন- রক্তের উপমায় বারবার ফিরে এসেছে হুমায়ুন আজাদ, অভিজিত আর রাফিয়া। যাহার জন্য প্রযোজ্য কবিতায় লিখেছেন-বাংলার রাস্তায় ছড়িয়ে দিচ্ছে কর্মক্ষম মগজ, এই চাপাতি ধার করা নির্বিষ সাপদের ঠিকানা। অন্ধকার পেরিয়ে আসে আলো। কবি হতাশা নন। আশার মশাল জ্বালিয়ে রাখতে চান সদাই। কারণ, তিনি জেনে গেছেন আশাবাদী মনোভাব হতাশার চেয়ে কল্যাণকর। একটি কবিতার পঙক্তি- বর্গাদার অক্কা পেলে, নতুন সূরের তলে, নতুন সম্ভাবনা করতে পারো আশা। আকালে আঠারোদয় কবিতায় আশা জাগানিয়া সুর তুলেছেন তিনি- কুম্ভের ঘুম থাক শাজাহানের ভালে! আর আঠারের জয় হোক।

উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প, রাজনীতি-সংস্কৃতি সংলগ্নতা ও পুরানো রাগ বা নস্টালজিয়ার মিশেলে প্রতিটি কবিতা হয়ে উঠেছে স্বতন্ত্র। আশিক রেজার ভেড়া ও ভয়তন্ত্র হলো ৬৯টি কবিতার সংকলন। প্রকাশ করেছে ঐতিহ্য প্রকাশনী। ভেড়া ও ভয়তন্ত্র পাঠে পাঠক পাবেন সমকালীন সময়ে বিশুদ্ধ স্বাদ।

Comments

The Daily Star  | English

July uprising: The wounds that are yet to heal, one year on

This week marks one year since 15-year-old Md Shahin Alam’s life was forever changed -- not by illness or accident, but by a bullet that tore through his left leg during a rally on August 5, 2024.

15h ago