বইমেলা বিশেষ-১০

সাহিত্য সমালোচনার ভালো ধারাটা মরে গেছে

আজ শেষ হচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। এখনো মেলায় আসছে নতুন বই। এর মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে কথাসাহিত্যিক, কবি ও অনুবাদক মাসরুর আরেফিনের উপন্যাস আড়িয়াল খাঁ, সাক্ষাৎকারের বই মানবতাবাদী সাহিত্যের বিপক্ষে। প্রকাশ করেছেন কথাপ্রকাশ। বইমেলা ও নিজের লেখালেখি নিয়ে কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

আপনার লেখায় দেশীয় বিষয়ের সঙ্গে বিদেশের সাহিত্য সংস্কৃতি উপস্থাপিত হয় সমন্বয় করে। এটা দীর্ঘদিনের অর্জন নিশ্চয়। কিন্তু একজন লেখকের অভিজ্ঞতা পড়তে পাঠকদের কেমন প্রস্তুতি থাকা দরকার বলে মনে করেন? 

মাসরুর আরেফিন: প্রস্তুতি শুরু করলেই হয়ে যায়। পড়া শুরু করাটাই আসল কথা। বিদেশি সাহিত্যের বা সংস্কৃতির যদি কোনো প্রসঙ্গ লেখায় আসে, তার মানে ওই বিষয়টা আমার জানা এবং আমার ন্যারেশনের জন্য সেটার উল্লেখ আমি মনে করেছি যে—দরকারি। তার মানে এখানে দেশি বা বিদেশি কোনো ব্যাপার না। ব্যাপার হচ্ছে, 'ক' বিষয়টার বয়ানকে শক্তি দেবার জন্য 'খ'-কে ব্যবহার করার ক্ষমতা বা জ্ঞান। অর্থাৎ এদেশে বাকস্বাধীনতার অবস্থার কথা বলতে গিয়ে আপনি যদি ধরেন রাশিয়ান কবি ওসিপ মান্দেলস্তাম হত্যার প্রসঙ্গটা লেখায় আনতে পারেন তো, একইভাবে আপনি বরগুনায় একজন সাংবাদিককে কীভাবে তার বাককে রুখতে হত্যা করা হয়েছে, সেই বিষয়টাও আনতে পারেন। দেশ-বিদেশ এখানে কোনো বিষয় না। রেলেভেনস্ ও টাইমিং বিষয়, কোহারেনস্ বিষয়। লেখকদের এই জ্ঞান বা প্রসঙ্গ-ভিত্তিক জ্ঞানের ব্যবহার পাঠকের জন্য সেইটার পিছে পিছে ছোটার মতো কোনো জিনিস না। 

আর আসল কথা এই যে, পাঠকেরা চিরকালই লেখকদের থেকে আগানো। সেটা তাদের অবস্থানের নিরিখে। কারণ পাঠক লেখককে পড়েন, কিন্তু উল্টোটা সত্য না। পাঠকের রায় দেবার ক্ষমতা থাকে। লেখকের সেটা থাকে না। পাঠক আসলে লেখকের চাইতে বেশিই জানেন, যেহেতু পাঠক লেখকের জানাকে বা জ্ঞানকে অপ্রাসঙ্গিক বা শো-অফ বলে উড়িয়ে দিতে পারেন। 

বইমেলা পাঠকদের সহায়তা করে লেখকদের কাছ থেকে দেখতে ও পেতে। বিষয়টা আপনার কেমন অনুভূতি হয়। 

মাসরুর আরেফিন:  ব্যাপারটা ভাল। কিন্তু আমরা ব্যস্ত থাকি বই সাইন করায়। তাই পাঠকদের সঙ্গে কথা আসলে হয় না। একটু হাসি বিনিময় আর ছবি তোলা হয়, এই যা। আর ধুলা খাওয়া... ।

 

আপনার উপন্যাসগুলো বেশ দীর্ঘ, আকারে বড়। কবিতার মধ্যেও আপনার গল্প বলার অভ্যাস আছে। জীবনের গল্প—কতটা দেখেন সরাসরি কতটা কল্পনা আপনার? 

মাসরুর আরেফিন: গল্প বলার নামই সাহিত্য করা। কিন্তু গল্পটা জোর করে কোনো একটা বিশেষ থিমের জন্য উপযোগী উদ্দেশ্যপূরণের দিকে ঠেলে-ঠেলে দিলে সেটার নাম 'ফিকশন মেকিং'। গল্প বলা ভালো, ফিকশন মেকিং খারাপ। মানে একটা ভাল সাহিত্য, আরেকটা দুর্বল। জীবনের গল্প কল্পনা করে বলার নামই মাইমেসিস, অর্থাৎ একটা সত্য জীবনের কাগজে মিথ্যা বা কাল্পনিক রূপায়ণ। এখানে মিডিয়াম আলাদা বলে, একটা গল্পকে ভেবে ভেবে অন্য মঞ্চে টেনে তোলা হচ্ছে বলে, এখানে সত্য ও মিথ্যার মাঝপথে এসে দাঁড়ায় ভাষা ও প্রকরণ। তাই কিছুই আর তখন সরাসরি জীবনসত্যের বয়ান থাকে না, সবটাই তখন এসেনশিয়ালি কল্পনা হয়ে যায়। একটা সংবাদপত্রের কাটিংও যদি ঠিকভাবে একটা উপন্যাসে ঢোকে তো, সেটা তখন সাহিত্যের একটা 'টুল অব ট্রেড' হয় বলে নিছক আর পত্রিকার কাটিং হয়ে থাকে না। সেও তখন গল্পের অংশ হিসেবে আলাদা সত্তা হয়ে যায়; কল্পনা হিসেবে আলাদা সত্য হয়ে যায়, যা কিনা জীবনের সত্য নয়। 

জীবনের সত্য আর জীবনের সত্যের কাল্পনিক রূপায়ণ দুই সম্পূর্ণ আলাদা কথা। সাহিত্যে, আমাদের জীবনের গল্পগুলো মূলত বাস্তব-বাস্তব হয়েও অধরা। আমরা লেখকেরা বলতে চাই যে, ওই অধরা ফিকশনের সত্যই আসলে জীবনসত্য, যেহেতু লেখক সেখানে লেখার পাতায় সত্যকে থ্রি-সিক্সটি-ডিগ্রি রূপে দেখতে পারেন। অন্যদিকে বাস্তব জীবনে রাস্তা ধরে একটা বাস বা ট্রাক আসছে তো একটা বাস বা ট্রাকই আসছে, সেখানে ওই বাস বা ট্রাকটার বাস বা ট্রাক হয়ে ওঠার গল্পটা নেই, ওর ভেতরে চারজন সন্ত্রাসীর বোমা নিয়ে বসে থাকার ব্যাপারটাও অদৃশ্য। 

মূল কথায় আসি, মাইমেসিস মানেই আসলে খাড়া-আলিফ সত্যের বয়ান লিখতে গিয়ে ওই সত্যকে কল্পনায় বাড়িয়ে-কমিয়ে সত্যের বাঁকাকরণ, সত্যের তির্যককরণ। ওইটা মিথ্যা। আবার মিথ্যাই এই প্রকরণের ফ্যাক্টরি দিয়ে ঢুকলে সবচাইতে বড় জীবনসত্য হয়ে দাঁড়ায়। এখানেই সভ্যতার পরিগঠনে সাহিত্য জরুরি।

আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতিতে বইমেলার প্রভাব পড়ে বলে মনে হয়? 

মাসরুর আরেফিন: মেলার প্রভাব এটাই যে, মেলাকে মাথায় রেখে প্রকাশকেরা তাদের বার্ষিক বাজেট করেন, লেখকেরা অলসতা ছেড়ে লিখতে বসেন। মেলায় বই ভাল চললে লেখক আরও লেখার উৎসাহ পান। বাকিটা নিয়ে আমি অত ভাবি না। কারণ আমি দেখেছি যে, মেলায় দুর্বল মানের বই থাকে বেশি আর বইয়ের ক্রেতা থাকে মোট ভিড়ের বেশি হলে মাত্র দশ শতাংশ। আবার এই বইমেলা এখন আমাদের সংস্কৃতির অংশ। সে হিসেবে এর লালন-পালন ভাল কথা। আসল লেখক কিন্তু মেলাকেন্দ্রিক হন না, হওয়াটা খারাপ। তাগিদের লেখা সাধারণত ভাল লেখা হয় না। 

সমালোচনা একজন লেখকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের এইখানে লেখকরা সমালোচনা সহজভাবে নেয় না কেন?

মাসরুর আরেফিন:এইখানে সাহিত্য সমালোচনার ভালো ধারাটা মরে গেছে। যেটা আছে সেটা ব্যক্তি আক্রমণ ও ইচ্ছাকৃত বাড়তি প্রশংসা কিম্বা ইচ্ছাকৃত বাড়তি নিন্দা। প্রশংসা বা নিন্দা কোনোটাই সাহিত্য সমালোচনা না। সাহিত্য সমালোচনা আসলে বিশ্লেষণ, বিভিন্ন প্রিজমে ফেলে লেখার মূল্যায়ন, কিন্তু একইসঙ্গে সেটা সাহিত্যপাঠের সাফ-সাফ অনুভূতিটাকেও বলা। আমাদের এখানে আসলে সাহিত্য হয়ে গেছে এজেন্ডাবাদী সাহিত্য, আর সমালোচনা হয়ে গেছে এজেন্ডাবাদী সমালোচনা। ব্যাপারটা দুঃখজনক। কিন্তু কিছু ভাল বুকরিভিউ যে লিটল ম্যাগাজিনগুলোতে একেবারেই হচ্ছে না, তা না। তবে মূল ধারাটা নদীর বুক ছাপিয়ে এখন অন্য ট্র্যাজিক পথে...

Comments

The Daily Star  | English

Likely reform proposal: Govt officials may be able to retire after 15yrs

For government employees, voluntary retirement with pension benefits currently requires 25 years of service. The Public Administration Reform Commission is set to recommend lowering the requirement to 15 years.

8h ago