সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে ৪ হাজার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন

লোকবল-সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে ৪ হাজার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
খন্দকার ফয়সাল আহমেদ মিউজিয়াম (কেএফএ)। ছবি: জাহিদুল ইসলাম জয়/স্টার

নরসিংদীতে খন্দকার ফয়সাল আহমেদ (৫৭) শখ থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন জিনিসপত্র সংগ্রহ করা শুরু করেন প্রায় ২৫ থেকে ২৬ বছর আগে। তার ব্যক্তিগত জাদুঘরে এখন প্রায় ৪ হাজার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আছে। তবে লোকবল ও সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।

ফয়সাল আহমেদের গড়া জাদুঘরে রয়েছে বিভিন্ন যুগের তাম্র মুদ্রা, রৌপ্য মুদ্রা, স্বর্ণ মুদ্রাসহ ১৫৭টি দেশের নোট ও মুদ্রা, ২০০-৩০০ বছর আগে বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত জিনিসপত্র। তাছাড়া রয়েছে তামার তৈরি মিশরের ছোট আকৃতির পিরামিড, তামা ও মাটির বড় মটকা (বড় পাত্র), কষ্টি পাথর, বিভিন্ন যুগের মূর্তি, মৃৎশিল্প, সিরামিকের তৈরি আসবাবপত্র, দোতরা, হারমোনিয়ামসহ বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র, ক্যামেরা, টিভি, গরুসহ বিভিন্ন প্রাণির বড় আকৃতির সিংসহ বিভিন্ন দুষ্পাপ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।

যেসব বস্তু কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে কিন্তু সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি, সেগুলো নিয়ে পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে পত্রিকার কাটিং সংগ্রহ করে নতুন প্রজন্মের জন্য দেয়ালের গায়ে সাঁটানো হয়েছে। এখন, এটি প্রতিষ্ঠিত প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর। জাদুঘরটি নাম দেওয়া হয়েছে খন্দকার ফয়সাল আহমেদ মিউজিয়াম (কেএফএ)।

খন্দকার ফয়সাল আহমেদ মিউজিয়াম (কেএফএ)। ছবি: জাহিদুল ইসলাম জয়/স্টার

নরসিংদী সদরের পাঁচদনায় ভাই গিরিশচন্দ্র মিউজিয়াম ও লাইব্রেরির পাশে অবস্থিত তার ব্যক্তিগত ৩ তলা ভবনের তৃতীয় তলায় প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলো সাঁজানো হয়েছে। জাদুঘরটির পাশে তিনি একটি লাইব্রেরিও গড়ে তুলেছেন।

ভবনটির প্রথম তলা ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহৃত হলেও দ্বিতীয় তলাটি লাইব্রেরি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যেটির নাম দেওয়া হয়েছে গিরিশচন্দ্র সেন মিউজিয়াম ও লাইব্রেরি। এটি পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়।

তৃতীয় তলায় প্রবেশ করতে বাম পাশেই লাইব্রেরি। যেখানে ভাই গিরিশচন্দ্র সেন ও মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রায় ৩ শতাধিক বই রয়েছে।

লাইব্রেরির পাশের কক্ষটি ব্যবহৃত হচ্ছে অভ্যর্থনা কক্ষ হিসেবে। যেটি সাজানো হয়েছে বিভিন্ন মনুষীদের বাণী সমৃদ্ধ পোস্টার দিয়ে। যা একজন জ্ঞান পিপাষু দর্শককে জ্ঞান অর্জনে সহজে আকৃষ্ট করবে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় নৃতাত্ত্বিক উপাদান দিয়ে গড়া তোলা হয়েছে জাদুঘরটি। জাদুঘরটি গড়তে শুরু থেকে প্রত্নবস্তু সংগ্রহ করতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ টাকা।

এখন, তার স্বপ্ন, কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া এসব দুর্লভ বিষয়গুলো সরকারি তত্ত্বাবধায়নে মানুষের সামনে তুলে ধরা। যাতে নতুন প্রজন্ম এসব দেখে ইতিহাস ঐতিহ্য বিষয়ে জানতে পারেন।

কেএফএ এর উদ্যোক্তা ও গবেষক খন্দকার ফয়সাল আহমেদ বলেন, 'আমি এগ্রো ফার্মের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কয়েকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মিউজিয়াম ও লাইব্রেরি দেখাশোনা করার জন্য। কিন্তু ঠিকঠাক মতো রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায়, এটি বন্ধ আছে। অবসর সময় পেলে মাঝেমধ্যে এটি খোলা রাখা হয়।'

যদিও প্রথমে পথ চলা মসৃণ ছিল না, তারপরও ফয়সাল আহমেদের একান্ত প্রচেষ্টার আর প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনরা এগিয়ে আসায় তার শখটি এখন সমৃদ্ধ জাদুঘরে পরিণত হয়েছে যা দর্শকদের নজর কেড়েছে।

ছবি: জাহিদুল ইসলাম জয়/স্টার

নরসিংদীর পাঁচদনায় গিরিশচন্দ্র সেন মিউজিয়াম ও লাইব্রেরি ও কেএফএ মিউজিয়ামটি পাশাপাশি অবস্থিত হওয়ায়, দর্শনার্থীরা তার প্রতিষ্ঠিত মিউজিয়ামটিও দেখার জন্য ভিড় জমাচ্ছেন। এসব কিছু তার ব্যক্তিগত সংগ্রহে প্রতিষ্ঠিত। 'দ্য ব্যাটল অব পাচঁদনা'বইটি দিয়ে প্রথম শুরু করেন সংগ্রহের কাজ।

তবে, গিরিশচন্দ্র সেনের পরিত্যক্ত ভবনটি ভারত সরকারের অর্থায়নে সংস্কার করে আরেকটি গিরিশচন্দ্র সেন জাদুঘর ও লাইব্রেরি তৈরি করা হয়েছে। যেটি প্রত্নতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে।

কেএফএ এর পরিচালক ফয়সাল আহমেদ খন্দকার বলেন, 'আমার বাবা ডাক্তার খন্দকার মহিউদ্দিন আহমেদ ছিলেন একজন লেখক এবং তিনিই আমার অনুপ্রেরণার বাতিঘর। আমাদের বাড়ির পাশে কুরআনের প্রথম অনুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের বাড়ি হওয়ায়, তার প্রতি আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু কালের গর্ভে এক সময় অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে তার বাড়ি। ফলে, এলাকাবাসী জায়গাটিকে গণশৌচাগার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে। স্থানীয়দের উদ্যোগে ও ভারত সরকারের সহায়তায় গিরিশচন্দ্র ভবনটি সংস্কার করা হয়।

জাদুঘরটির পরিচালক জানান, তিনি গিরিশচন্দ্র সেন নিয়ে গবেষণা করে ২টি বইও লিখেছেন। কেএফএ মিউজিয়াম এবং গিরিশচন্দ্র সেন মিউজিয়াম ও পাঠাগার জনবলের অভাবে সব সময় খোলা যাচ্ছে না। যেহেতু ২টি পাশাপাশি ভবন, সেহেতু সরকার ভবনটিতে প্রয়োজনীয় লোকবল দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিলে, এলাকাটি ভালো টুরিস্ট এলাকা হওয়া সম্ভব ছিল।

ফয়সাল আহমেদ খন্দকারের ভাষ্য, জাদুঘরটি পরিপূর্ণতা লাভ করতে সহায়তা করেছে অনেক আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশী। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন, খন্দকার ফয়সালের ভাগিনা সেনা কর্মকর্তা মো. আলী কাউছার ও ওষুধপাতি কোম্পানির কর্মকর্তা ভগ্নীপতি মো. ইসমাইল। ভাগিনা দীর্ঘদিন লেবানন, সুদান, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ কয়েকটি দেশে মিশনের কাজ করার সুবাদে যেখানে, দুষ্পাপ্য জিনিস পেয়েছেন, তা কেএফএ মিউজিয়ামের জন্য সংগ্রহ করেছেন। তিনি নিজেও ইন্ডিয়া, নেপাল মিশরে ভ্রমণ করে পিরামিডসহ অনেক দুর্লভ বস্তু সংগ্রহ করেছেন।

এলকো ফার্মা লিমিটেডের সাবেক সিইও মো. ইসমাইল জানান, পুরাতন জিনিসের প্রতি ভালবাসা ছিল প্রবল। কোম্পানির প্রয়োজনে বিভিন্ন দেশে যেতে হয়েছে। দেশের বাহিরে গেলে, কোনো দুর্লভ বস্তু পেলে নিয়ে আসতাম। ফয়সাল আহমেদ খুব খুশি হতো। এসব বস্তু জমিয়ে আজ মিউজিয়ামে রূপ লাভ করাটা ফয়সালের প্রচেষ্টার ফসল। যদিও আমরা তাকে এসব কাজে সহায়তা করেছি।

গিরিশচন্দ্র সেন মিউজিয়াম ও পাঠাগারের পরিচালক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'এটা সত্য যে শুধু গিরিশচন্দ্র মিউজিয়াম ও লাইব্রেরি নিয়ে মানুষের আগ্রহের জায়গা কম। তাছাড়া, জনবল না থাকায় ব্যক্তিগত জনবল দিয়ে সপ্তাহে একদিন শনিবার খোলা রাখা হয়। যদি পাশাপাশি আরও কিছু আকর্ষণীয় বিষয়ের মাধ্যমে পর্যটকদের নজর কাড়া যায়, তাহলে এ স্থানটি হতে পারে ভালো একটু টুরিস্ট এলাকা। কারণ স্থানটি মহাসড়কের পাশে অবস্থিত হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই ভালো।'

এই অধ্যাপক বলেন, 'আমি বিষয়গুলো নিয়ে বিভিন্ন সময় নরসিংদী জেলা প্রশাসকদের জানিয়েছি, তারা জনবল নিয়োগ দেওয়াসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিবেন আশ্বাসও দিয়েছেন একাধিকবার। কিন্তু তার প্রতিফলন মাঠে দেখা যায়নি।'

গিরিশচন্দ্র সেন মিউজিয়াম ও লাইব্রেরির স্মৃতি ও গবেষণা রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. মানজার হোসেন রবিন বলেন, কেএফএ মিউজিয়ামটি অনেক সমৃদ্ধ একটি সংগ্রহশালা। কালের গর্ভে অনেক কিছু আমাদের থেকে হারিয়ে গেছে। আবার, সভ্যতার অংশ কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে নেই এমন অনেক উপাদান মিউজিয়ামটিতে সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। যা একজন পর্যটককে আকৃষ্ট করবে এবং এখান থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবে।

Comments

The Daily Star  | English

Ending impunity for crimes against journalists

Though the signals are mixed we still hope that the media in Bangladesh will see a new dawn.

13h ago