‘ক্যানসারের উন্নত চিকিৎসায় কেন বিদেশ যেতে হচ্ছে’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে অভিজ্ঞতা বিনিময় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ছবি: প্রথম আলোর সৌজন্যে

'আমি ক্যানসার রোগী—এভাবে কখনো ভাবতে চাইতাম না। কিন্তু কেমোথেরাপির পর যখন চুলগুলো পড়ে গেল, তখন আর সহ্য করতে পারিনি। কঠিন বাস্তবতা বুঝতে পারি। তবে বন্ধু-স্বজনরা পাশে ছিলেন, আছেন এবং চিকিৎসক যখন বলেন, তুমি ভালো হয়ে যাবে, তখন লড়াই করার সাহস পাই।'

ফটোগ্রাফার রায়না মাহমুদ কথাগুলো বলতে বলতে নিজের আবেগ আর ধরে রাখতে পারলেন না। তার কান্নায় মিলনায়তনে উপস্থিত সবার চোখও ভিজে উঠল। মিলনায়তনে উপস্থিত বেশির ভাগই ক্যানসারে পরিবারের কোনো সদস্য হারিয়েছেন, নিজে ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন বা ক্যানসার আক্রান্ত স্বজনের কেয়ারগিভার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বা করছেন। তাদের জীবনের গল্পগুলো তো প্রায় একই রকম।

গতকাল শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে বিশ্ব ক্যানসার দিবস উপলক্ষে ক্যানসার কেয়ার কমিউনিটি বাংলাদেশের আয়োজনে অভিজ্ঞতা বিনিময় ও সম্মিলনী অনুষ্ঠানে এ চিত্র দেখা যায়।

রায়না মাহমুদ ২০১৯ সালে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। ভুল চিকিৎসার শিকার হওয়ার অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, 'ক্যানসার রোগী ও তার পরিবারকে শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক—এই ৩ ধরনের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়। এর মধ্যে ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে সুসম্পর্ক না থাকলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে।'

তিনি জানান, ক্যানসার চিকিৎসার ৮ মাস পর তার শরীরে আবার ক্যানসার ফিরে আসে এবং এখনো তিনি চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন।

'এক সঙ্গে চলি, ক্যানসার চিকিৎসায় বৈষম্য দূর করি' স্লোগানকে সামনে রেখে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ক্যানসার জয়ীরা তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনার পাশাপাশি করণীয় বিষয়েও সুপারিশ করেন এবং দেশের ক্যানসার চিকিৎসার বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার কথা তুলে ধরেন। বিশেষ করে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ক্যানসার শনাক্ত হতেই সময় লাগছে বা ডায়াগনোসিস ভুল হচ্ছে, তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা। ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েছেন বলেও একাধিক ক্যানসার যোদ্ধা অভিযোগ করলেন। ক্যানসার রোগীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য কেন ভারতসহ বিভিন্ন দেশে যেতে হচ্ছে তা নিয়েও তারা সরকার ও রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন তোলেন।

অভিজ্ঞতা বিনিময়ের এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ক্যানসার যোদ্ধা তাহমিনা গাফফার। ক্যানসার যোদ্ধা চিকিৎসক খালেদা খানম, জেসমিন পারভীন, নুসরাত শারমিন, ক্যানসার আক্রান্ত ২ বছর বয়সী মেয়ের কেয়ারগিভার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সানজিদা আক্তার, ক্যানসারে সন্তান হারানো সায়েমা সাফীজ প্রমুখ নিজেদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন এবং ক্যানসার আক্রান্ত রোগী ও পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করেন।

অনুষ্ঠানে ক্যানসার আক্রান্ত স্বামীর কেয়ারগিভার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা তাবেন্দা হারুন খান বললেন, 'আমার স্বামীর ক্যানসার শনাক্ত হতেই ৮ মাস লেগে যায়। বাজারে ক্যানসারের নকল ওষুধ পাওয়া যায়। যার কারণে আমি ভয়ে জাপান থেকে ওষুধ আনাই।'

কেয়ারগিভার হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতায় তিনি বলেন, 'সবাই ক্যানসার রোগীর খোঁজ নেন। অথচ, কেয়ারগিভার কেমন আছে তা কেউ জানতে চান না। অথচ দিনের পর দিন মৃত্যু ভয় নিয়ে দিন পার করতে হয় কেয়ারগিভারকে। রোগীর সঙ্গে থাকতে থাকতে বিরক্ত লাগে, অভিমান হয়। ট্রমা থেকে বের হতে অনেক সময় লাগে। কেয়ারগিভারদের নিজেদের ভালো থাকার জন্য ছবি আঁকা, গান গাওয়া—যেটা করতে ভালো লাগে তাই করতে হবে।'

চিকিৎসক তুষার মাহমুদ ২০০৬ সালে প্রথমবার ক্যানসার আক্রান্ত হন। এরপর ২০১৩ ও ২০১৮ সালে ৩ বার ৩ ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হন। এখনো নিজেকে ক্যানসার জয়ী ঘোষণা করার সময় আসেনি।

তিনি জানান, ২০১৩ সালে তার সঙ্গে তার চিকিৎসক বাবাও ক্যানসার আক্রান্ত হন। ক্যানসারের সঙ্গে ৫ মাস যুদ্ধ করে বাবা মারা যান। আর ২০১৮ সালে যখন আবার নিজে ক্যানসারে আক্রান্ত হলেন তখন তার চিকিৎসক স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। তবে মা ও স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যরা পাশে আছেন বলেই যুদ্ধটা চালিয়ে যেতে পারছেন।

অভিনয় শিল্পী ও মিস বাংলাদেশ ইউকে খেতাব পাওয়া সুলতানা সারা জানালেন, শুধু বাংলাদেশে ক্যানসার ডায়াগনোসিসে ভুল হচ্ছে তা নয়, ব্যাংককে তিনি নিজে ভুল ডায়াগনোসিসের ভুক্তভোগী। বাংলাদেশেও ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েছেন তিনি। তবে সবকিছুর পরও সেজেগুজে সবসময় ভালো থাকার চেষ্টা করেন। কেননা ক্যানসার লড়াইয়ে মানসিক জোর থাকাটা জরুরি।

৬ বছর বয়সী সারওয়ানা পুরো মিলনায়তনে হাসিখুশিভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। পরে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ক্যানসার জয়ী জাহান-ই-গুলশান সারওয়ানার নাম ঘোষণা করে জানালেন, ছোট মেয়েটি নিজেও ক্যানসার যোদ্ধা।

আলোচনায় জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যানসার রোগতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, 'এক সময় ক্যানসার নিয়ে কেউ কথা বলতে চাইতেন না বা কথা শুনতে চাইতেন না। এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। ক্যানসার চিকিৎসাতেও ৫০০ শয্যার জাতীয় হাসপাতালের পাশাপাশি ৮টি বিভাগীয় শহরে ৮টি ক্যানসার সেন্টার তৈরির কাজ চলছে। তবে রোগী অনুপাতে এ চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনো অপ্রতুল। ক্যানসার চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত সমন্বিত পদ্ধতির পাশাপাশি জাতীয় ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিও নেই। ক্যানসার হলে সবাই মারা যাচ্ছেন না, যারা বেঁচে থাকছেন তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের কথাও ভাবতে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Injured protesters call off demo in front of CA residence

Earlier, they took position in front of the residence of Chief Adviser Professor Muhammad Yunus around midnight, breaching security barricades along the way

2h ago