দেশে মলিকিউলার ল্যাবরেটরির অভাবে চিকিৎসা ব্যাহত
আজ মঙ্গলবার দেশে বিশ্ব ক্যানসার দিবস-২০২৫ পালিত হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ক্যানসার রোগীদের সর্বোত্তম চিকিৎসা প্রদানের অন্যতম অনুষঙ্গ মলিকিউলার ল্যাবরেটরির অভাব রয়েছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (সিএমসিএইচ) ক্যানসার বিশেষজ্ঞ এবং রেডিওথেরাপি ওয়ার্ডের প্রধান অধ্যাপক সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, 'মলিকিউলার পরীক্ষা ক্যানসার কোষের মধ্যে নির্দিষ্ট জেনেটিক মিউটেশন শনাক্ত করে। এই তথ্য চিকিৎসকদের টার্গেট থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করতে সাহায্য করে, যা বিশেষভাবে সেই মিউটেশনগুলোকে আক্রমণ করে, চিকিৎসার কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে এবং চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হ্রাস করে।'
'বর্তমানে চট্টগ্রামে কোনো আণবিক ল্যাবরেটরি নেই, এমনকি দেশেও নেই' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আণবিক ল্যাবের অভাবে নেক্সট-জেনারেশন সিকোয়েন্সিং (এনজিএস) করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলস্বরূপ প্রতিবছর অনেক ক্যানসার রোগী চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছেন।'
অধ্যাপক সাজ্জাদ বলেন, 'এনজিএস হলো একটি ডিএনএ সিকোয়েন্সিং কৌশল, যা ক্যানসারের মিউটেশন শনাক্ত করার জন্য রোগীর সম্পূর্ণ জিনোম বিশ্লেষণ করে। এটি নির্ভুল ক্যানসার শনাক্তের একটি মূল উপাদান এবং অ্যাডভান্স ক্যানসার চিকিৎসার একটি আদর্শ পদ্ধতি।'
সরকারি হাসপাতালগুলোতে একটি আণবিক পরীক্ষার সুবিধা স্থাপন করা হলে চিকিৎসার মান এবং নির্ভুলতা আরও সুনির্দিষ্টভাবে নিশ্চিত করা যেতে পারে বলে জানান তিনি।
'গত পাঁচ বছরে চট্টগ্রাম তথা দেশে ক্যানসার চিকিৎসার ওষুধের প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে' উল্লেখ করে এই ক্যানসার বিশেষজ্ঞ বলেন, 'অনেক ওষুধ যা আগে আমদানি করতে হতো, এখন দেশে অনেক কম দামে পাওয়া যাচ্ছে।'
'আমাদের ওষুধ কোম্পানিগুলো ক্যানসার চিকিৎসার ওষুধ তৈরি করছে, যা আমরা আগে বিদেশ থেকে অনেক বেশি দামে কিনতাম। এই পরিবর্তন ক্যানসার চিকিৎসাকে অনেক বেশি সাশ্রয়ী করে তুলেছে', বলেন তিনি।
চট্টগ্রামে ক্যানসার চিকিৎসার সুবিধা সম্পর্কে ডা. সাজ্জাদ বলেন, 'সিএমসিএইচ এবং শহরের কিছু বেসরকারি হাসপাতালে রেডিওথেরাপি, ব্র্যাকিথেরাপি এবং কেমোথেরাপির সুবিধা রয়েছে। তবে সিএমসিএইচের কোবাল্ট-৬০ টেলিথেরাপি মেশিনের আইসোটোপ এবং লিনিয়াক্স অ্যাক্সিলারেটরটি অকেজো।'
রোগীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য মেশিনের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো অবিলম্বে মেরামত করা উচিত বলে জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'সিএমসিএইচ রেডিওথেরাপি ওয়ার্ডে প্রতিদিন ২৫ জনেরও বেশি রোগী চিকিৎসা গ্রহণ করেন।'
এ বছর বিশ্ব ক্যানসার দিবসের প্রতিপাদ্য 'ইউনাইটেড বাই ইউনিক' বলেও জানান তিনি।
চট্টগ্রামের পরিস্থিতি
গত বছর সালাহ উদ্দিন (ছদ্মনাম) ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং তিনি গত সপ্তাহে সিএমসিএইচের রেডিওথেরাপি ওয়ার্ডে ভর্তি হন।
তিনি জানান, হঠাৎ বেশি অসুস্থ বোধ করায় চিকিৎসকরা তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেন।
তবে তার জেলা কক্সবাজারে কোনো ক্যানসার চিকিৎসার সুবিধা নেই, তাই তাকে চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামে আসতে হয়েছে।
চট্টগ্রামও ক্রমবর্ধমান ক্যানসার রোগীর চাপের মুখোমুখি, যা বিশ্বব্যাপী প্রবণতা প্রতিফলিত করে।
ক্যানসার গবেষণা ও চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও মানসম্পন্ন চিকিৎসার প্রাপ্যতা এবং এ সম্পর্কে সচেতনতার অভাব এই অঞ্চলে প্রধান উদ্বেগের বিষয়। এই অঞ্চলের সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে শুধু সিএমসিএইচে ক্যানসার চিকিৎসা পাওয়া যায়।
সিএমসিএইচ সূত্র অনুসারে, গত বছর মোট পাঁচ হাজার ৬৫৮ জন নতুন ক্যানসার রোগী রেডিওথেরাপি ওয়ার্ডের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে দুই হাজার ৫২০ জন নারী ছিলেন, যা মোট রোগীর ৪৪ শতাংশেরও বেশি।
গত পাঁচ বছরে সিএমসিএইচে নতুন ক্যানসার রোগীর সংখ্যায় কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। ২০১৯ সালে নতুন ক্যানসার রোগীর সংখ্যা পাঁচ ৭৯১ জন রেকর্ড করা হয়েছিল এবং পরবর্তী বছরগুলোতে এই সংখ্যা প্রায় একই ছিল।
নারী রোগীদের মধ্যে স্তন ক্যানসার সবচেয়ে সাধারণ ছিল, যেখানে পুরুষ রোগীদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসার এবং হেড ও নেক ক্যানসার প্রধান ছিল।
এ বিষয়ে সিএমসিএইচের রেডিওথেরাপি ওয়ার্ডের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আলী আসগর চৌধুরী বলেন, 'ধূমপান এবং পানের সঙ্গে তামাক সেবনের উচ্চ হারের কারণে পুরুষ রোগীদের ফুসফুস এবং হেড ও নেকের ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি।'
তিনি বলেন, 'নারী রোগীদের স্তন এবং জরায়ু মুখের ক্যানসার হওয়ার প্রবণতা বেশি। প্রাথমিক স্ক্রিনিং সম্পর্কে সচেতনতার অভাব এই রোগের প্রবৃদ্ধির পেছনে প্রধান কারণ।'
'যদিও সিএমসিএইচসহ সরকারি হাসপাতালগুলোতে স্ক্রিনিং সুবিধা পাওয়া যায়, তারপরও নারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব স্তন এবং জরায়ু মুখের ক্যানসারের প্রাথমিক শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। তবে চিকিৎসার সাফল্য মূলত প্রাথমিক স্তরে ক্যানসার শনাক্তকরণের ওপর নির্ভর করে।'
Comments