জেলা আ. লীগের কমিটিতে বহিষ্কৃত-আসামিদের পদ পাওয়ার অভিযোগ

আওয়ামী লীগের নরসিংদী জেলা কমিটি
নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের নব গঠিত কমিটি নিয়ে অভিযোগ দলের একাংশের। ছবি: স্টার

নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের নব গঠিত কমিটিতে দলের বিদ্রোহী, বহিষ্কৃত ও বেশ কয়েকটি মামলার আসামিরাও পদ পেয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

অভিযোগ আছে, নবগঠিত ৭৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির ২০ জন সরাসরি তৃণমূলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। বিএনপির সাবেক নেতাও কমিটিতে পদ পেয়েছেন।

এই কমিটি প্রত্যাখ্যান করে আগামীকাল বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনের ডাক দিয়েছেন পদবঞ্চিত জেলা আওয়ামী লীগের একাংশের নেতারা।

কমিটির অসঙ্গতি নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠিসহ আনুষঙ্গিক তথ্যাদি পাঠানোর কথাও জানান তারা।

পদবঞ্চিত সিনিয়র নেতাদের দাবি, যোগ্যদের বাদ দিয়ে অযোগ্য, অপরিচিত ও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে পরিবারতন্ত্র। কমিটির সহসভাপতি ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকসহ শীর্ষ পদে আছেন ২ পরিবারের ৬ সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ আছে।

জেলা সভাপতি জিএম তালেব হোসেন জাতীয় পার্টি থেকে মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নরসিংদী সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ জেলা আওয়ামী লীগের একাংশের।

দ্য ডেইলি স্টারকে জিএম তালেব হোসেন বলেন, '১৯৮৫ সালে সদর উপজেলা পরিষদে আমি লাঙ্গল মার্কায় নির্বাচন করেছি। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী আব্দুল হান্নান দাঁড়িপাল্লা মার্কা নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আমি পরাজিত হই। তখন, নির্বাচনে দলীয়ভাবে প্রতীক বরাদ্দ ছিল না। আমার প্রতিপক্ষরা আমাকে অপদস্থ করতে জাতীয় পার্টির ট্যাগ লাগানোর চেষ্টা করছেন। দলীয় প্রধান আমার সব বিষয়ে জানেন। তিনিই আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। কে কী বলল এসব আমলে নেওয়ার সুযোগ নেই।'

২০১৪ ও ২০১৮ সালে পরপর ২ বার শিবপুরে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে একবার সংসদ সদস্য হওয়া সিরাজুল ইসলাম মোল্লা পেয়েছেন সহসভাপতির পদ। তিনি ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনীত নৌকার প্রার্থী জহিরুল হক ভূঁইয়াকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য হন।

জাসাসের সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা ছিল না। আমি ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম। তবে রাজনৈতিক পদ ছিল না। বিএনপি সরকারের সময় দায়িত্ব পালন করেছি বলেই আমি বিএনপির রাজনীতি করতাম এমনটি নয়। হীন উদ্দেশ্য নিয়ে আমার নামে এসব ভিত্তিহীন অভিযোগ করা হচ্ছে।

বর্তমান কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক আতাউর রহমান

শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন কমিটিতে সদস্য এবং তার ২ ভাই খায়রুল মজিদ মাহমুদ চন্দন সহসভাপতি ও নজরুল মজিদ মাহমুদ স্বপন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছেন।

নরসিংদী পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. কামরুজ্জামান কামরুলকে দেওয়া হয়েছে ১ নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ। তিনিসহ তার ভাবী ও প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেনের স্ত্রী তামান্না নুসরাত বুবলী ও নরসিংদী জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজও রয়েছেন কমিটিতে।

কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের অভিযোগে দুদকে অভিযোগ তদন্তাধীন। তাছাড়াও কমিশনার মানিক হত্যাসহ বেশ কয়েকটি মামলার আসামি তিনি।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে কামরুজ্জামান গত ৩০ নভেম্বর নরসিংদী জজ আদালতে ৬ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে ২টি পৃথক মামলার আবেদন করেন। আদালত মামলা হিসেবে গ্রহণ না করে তদন্তের নির্দেশ দেন।

কামরুজ্জামানের মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলে তিনি তা কেটে দেন। পরিচয় উল্লেখ করে খুদে বার্তা পাঠালেও এর উত্তর দেননি।

গত কমিটিতে বহিষ্কৃত মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য এবং পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সদস্য তামান্না নুসরাত বুবলী এবারও একই পদ পেয়েছেন।

২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএ পরীক্ষায় তার হয়ে ৮ ছাত্রী প্রক্সি পরীক্ষা দেওয়া সংক্রান্ত জালিয়াতির কারণে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।

বর্তমান কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক আতাউর রহমান বিএনপির অঙ্গসংগঠন জাসাসের নরসিংদী জেলা সদস্য ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাছাড়া তিনি তরিকত ফেডারেশনের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ আছে।

আতাউর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ও ২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের মেয়াদে মোট ১৭ বছর এপিপির দায়িত্ব পালন করেছি। আওয়ামী লীগের প্যানেল থেকে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতিসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছি।'

তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, 'জাসাসের সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা ছিল না। আমি ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম। তবে রাজনৈতিক পদ ছিল না। বিএনপি সরকারের সময় দায়িত্ব পালন করেছি বলেই আমি বিএনপির রাজনীতি করতাম এমনটি নয়। হীন উদ্দেশ্য নিয়ে আমার নামে এসব ভিত্তিহীন অভিযোগ করা হচ্ছে।'

১৯ নম্বর সদস্য আনোয়ার হোসেন ২০১৯ সালে সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। তিনি আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ও সদর আওয়ামী লীগের সভাপতি সফর আলী ভূঁইয়ার কাছে হেরে যান।

সদ্য বিদায়ী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক অলিউর রহমান আজিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দপ্তর সম্পাদক করা হয়েছে জুলহাস মিয়াকে। তিনি সাবেক আওয়ামী লীগের জেলা সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন ভূঁইয়াকে উৎকোচ হিসেবে বিলাসবহুল গাড়ি উপহার দিয়ে গত কমিটিতে উপদপ্তর সম্পাদক হন। তাছাড়াও তিনি বর্তমান সভাপতি জিএম তালেব হোসেনের এলাকার লোক। তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। অথচ করা হয়েছে দপ্তর সম্পাদক।'

তিনি আরও বলেন, '৩ নম্বর যুগ্ম সম্পাদক করা হয়েছে মাহমুদুল কবির সহিদকে। তিনি নরসিংদী পৌরসভার সাবেক মেয়র কামরুজ্জামানের ব্যবসায়িক অংশীদার। তাকে রাজনীতি করতে দেখিনি এবং তিনি আওয়ামী লীগের কোনো অঙ্গ সংগঠনের সঙ্গে জড়িতও নন।'

'এই কমিটি নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সংকট বাড়িয়ে দিলো। যোগ্য ও ত্যাগী পরীক্ষিত নেতাদের সুকৌশলে বাদ দেওয়ার খেসারত দিতে হবে। দুষ্টচক্র সাময়িকভাবে লাভবান হলেও সামনে বিপদে পড়বে কোনো সন্দেহ নেই। ৪ জন গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা চেয়ারম্যানকে দল থেকে বাদ দেওয়ায় স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে তৃণমূলে এর প্রভাব পড়বে।'

নরসিংদী সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আফতাব উদ্দিন ভূঁইয়া ডেইলি

উৎকোচ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে দপ্তর সম্পাদক জুলহাস মিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি গত কমিটিতে উপদপ্তর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি। টাকা দিয়ে পদ পাওয়া যায় কিনা আমি জানি না, কারণ আমি নিজে এসব বিষয়ে লেনদেন করিনি।'

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 'আমি দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করি, তাই একটি মহল আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।'

নরসিংদী সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আফতাব উদ্দিন ভূঁইয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই কমিটি নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সংকট বাড়িয়ে দিলো। যোগ্য ও ত্যাগী পরীক্ষিত নেতাদের সুকৌশলে বাদ দেওয়ার খেসারত দিতে হবে। দুষ্টচক্র সাময়িকভাবে লাভবান হলেও সামনে বিপদে পড়বে কোনো সন্দেহ নেই। ৪ জন গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা চেয়ারম্যানকে দল থেকে বাদ দেওয়ায় স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে তৃণমূলে এর প্রভাব পড়বে।'

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারি নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে সদরের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম সভাপতি ও আবদুল মতিন ভূঁইয়াকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়।

২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি লেফটেনেন্ট কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম হিরো বীরপ্রতীক ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঁইয়াকে কোনো কারণ উল্লেখ না করে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অব্যাহতি দেয় কেন্দ্রীয় কমিটি। তখন সহসভাপতি জি এম তালেবকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পীরজাদা কাজী মো. আলীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয়।

২০২২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সম্মেলনে তাদেরকে ভারপ্রাপ্ত থেকে পূর্ণাঙ্গ সভাপতি ও সম্পাদক ঘোষণা করা হয়।

জানা যায়, গত ১৯ জানুয়ারি এ কমিটিকে বর্ধিত করে ৭৫ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দিয়েছেন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

৭৫ সদস্যের কমিটির ৩৯ জন পদে আছেন এবং জেলার ৫ সংসদীয় আসনের সব সংসদ সদস্যসহ বাকি ৩৬ জন সদস্য হিসেবে আছেন। এর মধ্যে ৫ নারী পদ পেয়েছেন। এছাড়াও কমিটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে আছেন আরও ২৭ জন।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পীরজাদা মোহাম্মদ আলী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পুরনো সব দ্বন্দ্ব ভুলে নবীন-প্রবীণদের নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের ভালো কমিটি পেয়েছি। আসছে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা সবাই হাতে হাত মিলিয়ে নৌকাকে বিজয়ী করতে চাই।'

'আওয়ামী লীগ বড় দল। তাই মতবিরোধ থাকতে পারে। সবার চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। কমিটি গঠনের পর কেউ মৌখিক কিংবা লিখিত অভিযোগ করেননি। আমরা বলতে চাই, সুন্দর, সাবলীল ও যোগ্য লোক দিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। যারা নেতা-কর্মীদের ব্যাপারে এসব অভিযোগ করেছেন, তারা লিখিত অভিযোগ করলে, তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে,' যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

At least 30 hurt as clashes engulf part of Old Dhaka

Suhrawardy college, hospital vandalised as protests over student’s death turn violent

56m ago