ইউক্রেন যুদ্ধে ‘পুতিনবাদ’ কতটা প্রভাব রাখছে

ভ্লাদিমির পুতিন
প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেরগেই শইগুর (বামে)। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

এক এক করে ১১ মাস কেটে গেল। যে উদ্দেশ্য নিয়ে পরাশক্তি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন প্রতিবেশী ইউক্রেনে 'বিশেষ সামরিক অভিযান' শুরু করেছিলেন তার 'সাফল্য' এখনো মেলেনি। যুদ্ধের বর্ষপূতির আগে তাই প্রশ্ন জেগেছে, ইউক্রেন যুদ্ধে 'পুতিনবাদ' কাজে আসছে কি?

গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি যে শক্তি নিয়ে রাশিয়া হামলা শুরু করেছিল ইউক্রেনের ওপর, ধীরে ধীরে সেই শক্তির ক্ষয় দেখেছে বিশ্ববাসী। কিয়েভের দ্বারপ্রান্তে এসেও পিছু হটেছিল রুশ বাহিনী। এরপর আগ্রাসী শক্তি পিছু হটতে হটতে আশ্রয় নেয় পূর্ব ইউক্রেনের রুশপ্রধান অঞ্চলগুলোয়।

এসব সবারই জানা।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সেই ভস্ম থেকে ফিনিক্স পাখির মতো রুশ ফেডারেশনকে জাগিয়ে তোলার সাফল্য দেখিয়ে প্রেসিডেন্ট পুতিন শুধু নিজের দেশের জনগণের কাছে নয়, বহির্বিশ্বেও নিজের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি সৃষ্টি করেছিলেন।

মার্কিন আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে যে পুতিন সুউচ্চ পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেই পুতিনের পায়ের তলা থেকে ধীরে ধীরে 'মাটি সরে যাওয়ার' দৃশ্য মঞ্চস্থ হয়েছে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে।

শুধু তাই নয়, প্রেসিডেন্ট পুতিনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যারা রাশিয়ায় বিক্ষোভ করেছিলেন, তারা সীমিত আকারে হলেও প্রমাণ করেছেন যে 'পুতিনবাদ' অপ্রতিরোধ্য নয়।

পশ্চিমের গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, ইউক্রেন থেকে ক্রমাগত পিছু হটার পর রুশ জাতীয়তাবাদের কট্টর সমর্থকরা ভিন্ন আঙ্গিকে হলেও 'পুতিনবিরোধী' হয়ে উঠেন। মূলত তাদের বিরোধিতা ছিল প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঘনিষ্ঠ জেনারেলদের বিরুদ্ধে। কেননা তারা যুদ্ধক্ষেত্রে তেমন কোনো সফলতা বয়ে আনতে পারেননি।

প্রেসিডেন্ট পুতিন দেশজুড়ে সেনা সংগ্রহের আদেশ দিলে তার জনপ্রিয়তায় আরেক দফা 'ধস' নামে। সেসময় তরুণ-যুবাদের রাশিয়া ছাড়ার 'হিড়িক'র সংবাদ পশ্চিমের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের জোর করে যুদ্ধে পাঠানোর সংবাদও প্রকাশিত হয়েছিল স্বজনদের বরাত দিয়ে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আক্রান্ত ইউক্রেনের পক্ষে মিত্র দেশগুলো যেভাবে দাঁড়িয়েছে তা দেখা যায়নি রাশিয়ার ক্ষেত্রে। রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত বেলারুশও সরাসরি এই যুদ্ধে যোগ দিতে অস্বীকার করেছে।

সাবেক সোভিয়েতভুক্ত মধ্য এশিয়ার দেশগুলো নিজেদের বিপদের সময় মস্কোর দিকে হাত বাড়ালেও ক্রেমলিনের এই সংকটাপন্ন অবস্থায় কেউই জোরালোভাবে পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতিও দেয়নি।

যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের নিষেধাজ্ঞা ভেঙে পুতিনের 'সব সময়ের বন্ধু' শি জিন পিং বা 'প্রিয় বন্ধু' নরেন্দ্র মোদির পক্ষ থেকে মস্কোকে সামরিক সহযোগিতার ঘোষণাও আসেনি। এ ক্ষেত্রে কেবল ইরান রাশিয়াকে ড্রোন পাঠিয়ে বিশ্ব সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। মাথাব্যথার কারণ হয়েছে পশ্চিমের দেশগুলোর।

গত ১১ মাসে ক্রমাগত ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ-জ্বালানি অবকাঠামো প্রায় ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। তথাপি এই দুঃসহ শীতেও ইউক্রেনীয়রা মাথা নত করেননি 'পুতিনবাদের' কাছে।

পশ্চিমের গণমাধ্যমগুলোর সূত্রে আরও জানা যায়, বর্তমানে পূর্ব ইউক্রেনের রুশ ভাষাভাষী দনবাস অঞ্চলে ইউক্রেনের দখলে থাকা যে শহরগুলোয়, বিশেষ করে কৌশলগত বাখমুত শহরে যে যুদ্ধ চলছে তা রুশভাষীদের ভেতর 'পুতিনবিরোধী মনোভাব' তৈরি করছে। কেননা, রুশ সেনাদের নির্বিচার গোলা বর্ষণে মূলত মারা যাচ্ছেন রুশভাষীরাই।

গত ১৭ জানুয়ারি কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার 'পুতিনবাদ যুদ্ধক্ষেত্রে কাজে আসছে না' শীর্ষক এক মতামত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট পুতিন যতই চাপে পড়ছেন তার প্রত্যাশা ততই অবাস্তব হয়ে উঠছে।

উদাহরণ হিসেবে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, নিজেদের উড়োজাহাজ তৈরিতে দেরি হওয়ায় নিজের অনুগত শিল্পমন্ত্রী দেনিস মানতুরভকে প্রেসিডেন্ট পুতিন জনসম্মুখে তিরস্কার করেন।

মানতুরভ জানানোর চেষ্টা করেছিলেন যে উড়োজাহাজের কিছু যন্ত্রাংশ ইউক্রেন থেকে কেনা হতো। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক অবরোধের কারণে পশ্চিম থেকে প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ কিছুই আসছে না।

আর তখনই পুতিন রেগে গিয়ে বলেন, 'আমরা কী পরিস্থিতিতে আছি তা বোঝো না? এক মাসের মধ্যে এ কাজ শেষ করতে হবে। এর বেশি সময় দেওয়া হবে না।'

মতামত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রাশিয়ার 'এক নম্বর সেনা' বা চিফ অব জেনারেল স্টাফ ভালেরি গেরাসিমভকে ইউক্রেন যুদ্ধের দায়িত্ব দিয়ে পুতিন তার কাছ থেকে দ্রুত জয়ের আশা করছেন।

শুধু তাই নয়, পূর্ব ইউক্রেনের বড় শহর খেরসনসহ অন্যান্য অঞ্চলের পতনের দায়ভার পুতিন পূর্ববর্তী কমান্ডার সেরগেই সুরোভিকিনের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছেন।

সন্দেহ নেই, 'উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো'র চেষ্টা ব্যর্থ শাসকদেরই কাজ।

এদিকে পুতিনপন্থি রুশ ব্লগারদের বরাত দিয়ে পশ্চিমের বিশ্লেষকরা বলছেন, এই যুদ্ধে রাশিয়া যে সামরিক সাফল্য পেয়েছে তা প্রধানত এসেছে ইউক্রেনের রুশ ভাষাভাষী মিলিশিয়া, দুর্ধর্ষ চেচেন যোদ্ধা ও ভাড়াটে বাহিনীর হাত ধরে। এখানে রুশ পদাতিক বাহিনীর অবদান 'নগণ্য'।

এই ৩ সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে রাশিয়ার নিয়মিত বাহিনীর সমন্বয়ের 'ঘাটতি' থাকার কথাও জানিয়েছেন ব্লগাররা। তারা আরও জানান যে, 'অনিয়মিত' যোদ্ধাদের সাফল্য নিয়মিত বাহিনীর ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে, যা প্রকারান্তরে রুশ সেনাদের মনে 'চাপা ক্ষোভ' সৃষ্টি করছে।

এ ক্ষোভ দিন শেষে প্রেসিডেন্ট পুতিনের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে বলেও পশ্চিমের বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

গত ১৯ জানুয়ারি রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম আরটির প্রতিবেদনে বলা হয়, অধ্যাপক দিমিত্রি ত্রেনিনের মতে ২০২৩ সাল ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য 'বাঁচা-মরার' বছর।

প্রতিবেদন অনুসারে, রাশিয়ান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিলের সদস্য ও ইনস্টিটিউট অব ওয়ার্ল্ড ইকোনমি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসের শীর্ষ রিসার্চ ফেলো এবং হায়ার স্কুল অব ইকোনমিসের অধ্যাপক দিমিত্রি ত্রেনিন বলেছেন, পশ্চিমের দেশগুলো রাশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করায় মস্কো এক 'চরম সত্যের' মুখে পড়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

‘No room for politics under AL name, ideology’

Nahid Islam, adviser to the interim government, spoke with The Daily Star on the nation's key challenges and the way forward.

13h ago