বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে ভর্তুকির নীতিতে অপ্রতুল কিডনি ডায়ালাসিস সেবা

বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে ভর্তুকি দিয়ে কিডনি ডায়ালাইসিস করানো হচ্ছে
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডায়ালাইসিস নিচ্ছেন একজন কিডনি রোগী। ছবি: রাজিব রায়হান/স্টার ফাইল ছবি

দেশে কিডনি রোগী বাড়লেও সেই অনুপাতে সেবার পরিধি ও দক্ষ জনবল বাড়েনি। এর বদলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে ভর্তুকি দিয়ে কিডনি ডায়ালাইসিস করানো হচ্ছে। সেই সেবাও প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগন্য।

যত দ্রুত সম্ভব কিডনি রোগীদের সেবার পরিধি ও দক্ষ জনবল না বাড়ানো হলে ভবিষ্যতে সংকট আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বব্যাপী অসংক্রামক রোগ (যেমন: ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ) বাড়ছে। এসব রোগের কারণেও রোগীর কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে কিডনি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ভবিষ্যতে কিডনি রোগী আরও বাড়তে থাকবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।

সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও দেশে কিডনি রোগীদের সেবার মান বাড়ানো হয়নি। সরকার নিজে সেবার পরিধি বাড়ায়নি এবং আমরা যখন তাদের সহায়তা চেয়েছি, সেটাও তারা করেনি। বরং বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে তারা ভর্তুকি দিচ্ছে।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র

কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা এবং সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন-আর-রশিদ দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, দেশে মোট নেফ্রোলজিস্টের (কিডনি বিশেষজ্ঞ) সংখ্যা ১৬৫ জন। সেই হিসাবে মোট জনসংখ্যা অনুপাতে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের মাথাপিছু ১ জন করে নেফ্রোলজিস্ট আছেন।

কিন্তু, প্রতি ৫০ হাজার মানুষের মাথাপিছু ১ জন করে নেফ্রোলজিস্ট থাকা প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন তিনি।

অধ্যাপক ডা. হারুন-আর-রশিদ বলেন, 'কিডনি রোগীদের সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। দক্ষ জনবল মানে শুধু চিকিৎসক না, ডায়ালাইসিস সেবা দিতে পারে, এমন নার্সসহ সংশ্লিষ্ট লোকবলের অভাব রয়েছে। আমাদের দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা বাড়লেও সেই অনুপাতে দক্ষ জনবল বাড়েনি।'

দেশে ডায়ালাইসিস রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকা সত্ত্বেও সরকারিভাবে ডায়ালাইসিস মেশিন না বসিয়ে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় স্যানডোর ডায়ালাইসিস সার্ভিস বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেডকে ভর্তুকি দিয়ে সেবা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

স্যানডোর ২ জায়গায় সেবা দিচ্ছে। রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে।

ভর্তুকির আওতায় ডায়ালাইসিসের প্রতিটি সেশনে রোগীকে এখন ৫৩৫ টাকা দিতে হয়। এখানে সরকার ২ হাজার ৪০০ টাকা ভর্তুকি দিয়ে থাকে। আর স্যানডোরের ডায়ালাইসিস বেসরকারি দর (ভর্তুকি ছাড়া) ২ হাজার ৯৩৫ টাকা।

স্বাস্থ্যখাতে যে বাজেট বরাদ্দ থাকে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তো সেটা সঠিকভাবে খরচও করতে পারে না। তাহলে কেন তারা ভর্তুকি কমিয়ে দিলো? এতে তো সাধারণ রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকার যতক্ষণ না পর্যন্ত নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ডায়ালাইসিস ব্যবস্থা স্থাপন ও পরিচালনা করতে পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানকে ভর্তুকি দিয়ে পরিচালনা করতে হবে।

অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান, সাবেক সভাপতি, স্বাচিপ

স্যানডোরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার কিডনি ইনস্টিটিউটে তাদের ৫৯টি ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩১টি ডায়ালাইসিস মেশিন আছে। সেই হিসাবে বছরে ঢাকায় তাদের ৮৬ হাজার ১৪০ ও চট্টগ্রামে ৪৫ হাজার ২৬০টি সেশন দেওয়া সম্ভব।

পিপিপি চুক্তি নিয়ে স্যানডোরের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. নাজমুল হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে আমাদের ১০ বছর মেয়াদি চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ঢাকায় বছরে ডায়ালাইসিসের ১৩ হাজার সেশন ও চট্টগ্রামে সাড়ে ৬ হাজার সেশনের জন্য সরকার আমাদের ভর্তুকি দেবে।'

সরকারি ভর্তুকির বাইরে স্যানডোর যে সেশনগুলো করবে, সেগুলোর প্রতিটির জন্য বেসরকারি ফি দিতে হবে। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে প্রতি সেশনে রোগীকে ২ হাজার ৯৩৫ টাকা দিতে হবে।

অথচ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের নিজস্ব মেশিনে ডায়ালাইসিসের জন্য একজন রোগীকে ৬ মাসের জন্য ২০ হাজার টাকা দিতে হয়। এর অর্থ হলো প্রতি সেশনের জন্য একজন রোগীকে ৪১৬ টাকা দিতে হয়।

কিডনি ইনস্টিটিউটে কথা হয় নবাবপুরের একটি কাপড়ের দোকানের কর্মচারী মো. মিরাজুলের (৩১) (ছদ্মনাম) সঙ্গে। গত সাড়ে ৪ বছর ধরে কিডনি রোগে ভুগছেন তার বাবা। এর মধ্যে গত ৩১ ডিসেম্বর থেকে তার বাবার ডায়ালাইসিস শুরু হয়। কিডনি ইনস্টিটিউটে প্রতিটি সেশনের জন্য তাকে ২ হাজার ৯৩৫ টাকা দিতে হচ্ছে।

ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'আমি হাসপাতালে ভর্তুকি সেবার আওতায় ডায়ালাইসিস পাওয়ার জন্য আবেদন করেছি ১ সপ্তাহ আগে। এখনো অনুমোদন পাইনি। ভর্তুকি ছাড়া আমার বাবাকে এত টাকা দিয়ে ডায়ালাইসিস করানোর মতো সামর্থ্য আমাদের নেই।'

এ বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়াকে ২ বার ফোন করলেও তিনি ধরেননি। ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তিনি জবাব দেননি।

দেশে মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৫-১০ শতাংশ কিডনি রোগী নিজের অর্থ খরচ করে ডায়ালাইসিস করতে পারবে। বাকি যারা মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও অতিদরিদ্র, তাদের জন্য ডায়ালাইসিস খুবই ব্যয়বহুল। এক্ষেত্রে সরকারি সুবিধার আওতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

অধ্যাপক ডা. হারুন-আর-রশিদ, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পিপিপির আওতায় স্যানডোর বা তাদের মতো যেসব প্রতিষ্ঠানগুলো আসে, এগুলো তো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। কাজেই তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ থাকে। বাংলাদেশে আমরা দেখি, নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হোক, বা জীবন রক্ষাকারী বিষয় হোক, সব খাতেই ব্যবসা চলছে। করোনা মহামারির সময়ও আমরা তা দেখেছি। এই মানসিকতা থেকেই স্যানডোরের মূল্যবৃদ্ধি ও সরকারের ভর্তুকির অংশ কমিয়ে দেওয়া। কিন্তু, কেন তারা ভর্তুকি কমাল? স্বাস্থ্যখাতে যে বাজেট বরাদ্দ থাকে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তো সেটা সঠিকভাবে খরচও করতে পারে না। তাহলে কেন তারা ভর্তুকি কমিয়ে দিলো? এতে তো সাধারণ রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকার যতক্ষণ না পর্যন্ত নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ডায়ালাইসিস ব্যবস্থা স্থাপন ও পরিচালনা করতে পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানকে ভর্তুকি দিয়ে পরিচালনা করতে হবে। অন্যথায় রোগীর ওপর চাপ বাড়বে।'

তিনি আরও বলেন, 'আমাদের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে নেফ্রোলজি বিভাগ আছে। কিন্তু, সেগুলোতে সক্ষমতা বাড়াতে তো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। শুধু ফলক লাগানো, ফিতা কাটা, আর ঢাকঢোল পিটিয়ে স্বাস্থ্যের উন্নয়ন সম্ভব না।'

সরকারিভাবে ডায়ালাইসিস সেবার পরিধি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন অধ্যাপক হারুন-আর-রশিদও। তার মতে, সরকারিভাবে ডায়ালাইসিসের সুযোগ বাড়ালে তখন আর সরকারি প্রতিষ্ঠানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম প্রয়োজন হবে না। সরকারিভাবেই কম খরচে রোগীকে ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়া যাবে।

কিডনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগীর এন-স্টেজ কিডনি ফেইলিওর (বিকল হওয়া) হলে ডায়ালাইসিস করাতে হয়। সপ্তাহে সাধারণত ২টি সেশন নিতে হয়। সেই হিসাবে মাসে ৮টি সেশন।

অধ্যাপক ডা. হারুন-আর-রশিদ জানান, দেশে ডায়ালাইসিস সেন্টারের সংখ্যা ১৬০। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই বেসরকারি। আবার এসব সেন্টারের ৭০ শতাংশই ঢাকায়।

তিনি বলেন, 'দেশে মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৫-১০ শতাংশ কিডনি রোগী নিজের অর্থ খরচ করে ডায়ালাইসিস করতে পারবে। বাকি যারা মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও অতিদরিদ্র, তাদের জন্য ডায়ালাইসিস খুবই ব্যয়বহুল। এক্ষেত্রে সরকারি সুবিধার আওতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।'

কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে তাদের ডায়ালাইসিস সেন্টারে ৪২ হাজার ৯৬৬টি সেশন দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালে এর সংখ্যা ছিল ৬০ হাজার ৫৭ এবং ২০২২ সালে ৬৭ হাজার ৬২০।

মানবদেহে কিডনির অবস্থান। ছবি: সংগৃহীত

২০১৭ সাল থেকে দেশে কমমূল্যে ডায়ালাইসিস সেবা দিচ্ছে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল। ঢাকায় তাদের সেন্টারে ১০০টি ও সাভারে ২৫টি ডায়ালাইসিস মেশিন আছে। দৈনিক তাদের সেন্টারে ২৭০ থেকে ৩০০টি সেশন হয়ে থাকে।

বেসরকারি এই হাসপাতালের ডায়ালাইসিস সেন্টারে প্রতি সেশনে রোগীদের কাছ থেকে সর্বনিম্ন ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৬০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে (নিম্ন আয় ও উচ্চ আয়ের রোগী ভেদে)। আর তাদের স্বাস্থ্যবীমার বাইরে অন্য কেউ এ সেবা নিলে প্রতি সেশনে ৩ হাজার টাকা দিতে হয়। তবে, গণস্বাস্থ্যের ডায়ালাইসিস সেন্টারে যারা চিকিৎসা নিতে আসেন, তাদের মধ্যে সর্বনিম্ন ফি পরিশোধ করে সেবা নেওয়া রোগীর সংখ্যাই সিংহভাগ। একইসঙ্গে সর্বনিম্ন ফি দেওয়ার সার্মথ্যও যাদের নেই, তারা বিনামূল্যে ডায়ালাইসিস সেবা পান এই হাসপাতালে।

এ বিষয়ে গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা. মহিবুল্লাহ খন্দকার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডায়ালাইসিস রোগীর সংখ্যা বাড়লেও সেই অনুযায়ী সেবার মান বাড়েনি। আমাদের ডায়ালাইসিস সেন্টারে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড রক্ষা করেই সেবা দেওয়া হয়। আমরা সরকারি ভর্তুকি চেয়েছিলাম। কিন্তু, তা পাইনি। মানুষের ডোনেশনের টাকায় আমাদের ভর্তুকি চলে। সরকারি ভর্তুকি পেলে আমরা আরও কম মূল্যে রোগীদের সেবা দিতে পারতাম। সরকার ভর্তুকি দিলে আমরা সারাদেশে কমমূল্যে রোগীদের ডায়ালাইসিস সেবা দিতে পারতাম।'

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও দেশে কিডনি রোগীদের সেবার মান বাড়ানো হয়নি। সরকার নিজে সেবার পরিধি বাড়ায়নি এবং আমরা যখন তাদের সহায়তা চেয়েছি, সেটাও তারা করেনি। বরং বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে তারা ভর্তুকি দিচ্ছে। আমরা বলেছিলোম, বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে যে অর্থ দেওয়া হচ্ছে, তা আমাদের দিলে আমরা আরও অনেক কম খরচে সারাদেশে ডায়ালাইসিসি সেবা চালু করতে পারব। তখন একদিনে মানুষকে আর ঢাকামুখী হতে হবে না, অন্যদিকে শুধু বাংলাদেশি নয়, আশপাশের দেশগুলো থেকেও আমাদের এখানে এসে সেবা নিতে পারবে। সেই সক্ষমতা আমাদের আছে। কিন্তু, সরকার নিজেও কিছু করছে না, আমাদেরকেও সহায়তা করছে না। এটা সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গার দুর্বলতা। আমরা তো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান না। আমরা চাই দেশের মানুষ সর্বনিম্ন মূল্যে সর্বোচ্চ সেবা পাক।'

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

9h ago