উৎপাদন কম দামও কম, দুশ্চিন্তায় মৌ চাষিরা

সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মৌ খামারি মিনারুল ইসলাম চতুর্থবারের মতো ‘মৌ কলোনি’ বসিয়েছেন টাঙ্গাইল সদর উপজেলার গালা এলাকার বিস্তীর্ণ সরিষা ক্ষেতের পাশে। মৌসুমের অর্ধেক সময় না পেরোতেই তার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।
মধু চাষ
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার গালা এলাকায় সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌ চাষ। ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মৌ খামারি মিনারুল ইসলাম চতুর্থবারের মতো 'মৌ কলোনি' বসিয়েছেন টাঙ্গাইল সদর উপজেলার গালা এলাকার বিস্তীর্ণ সরিষা ক্ষেতের পাশে। মৌসুমের অর্ধেক সময় না পেরোতেই তার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।

গত একমাসে যে পরিমাণ মধু সংগ্রহের কথা ছিল হয়েছে এর অর্ধেক।

শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশার কারণে একদিকে যেমন মধু উৎপাদন কমেছে, অন্যদিকে মধু বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধি 'মধ্যস্বত্বভোগীরা' দামও বলছেন গত মৌসুমের চেয়ে অনেক কম।

মিনারুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত মৌসুমে এমন সময়ে এপিস মেলিফেরা প্রজাতির মৌমাছির ৩০০ কলোনি থেকে প্রায় ১০০ মন মধু পেয়েছি। এবার পেয়েছি ৫০ মন। শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশার কারণে উৎপাদন কমে গেছে।'

আরও বলেন, 'গত বছরও সরিষা ফুলের মধু প্রতি মন ৬ হাজার টাকা (প্রতি কেজি ১৫০ টাকা) করে দিয়েছিলেন ক্রেতারা। এবার তাদের নিযুক্ত মধ্যস্বত্বভোগীরা মধুর দাম ৪ হাজার টাকার বেশি বলছেন না।'

তার মতে, এত কমে বিক্রি করলে উৎপাদন খরচ উঠবে না।

'বছরের অর্ধেক সময় মৌমাছিগুলোকে চিনি খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'চিনির দাম ৬০ টাকা কেজি থেকে বেড়ে ১২০ টাকা কেজি হয়েছে। মধুর দাম যদি চিনির দামের চেয়ে কম দেওয়া হয় তাহলে কীভাবে এ পেশায় টিকে থাকবো?'

শুধু মিনারুল নয়, শ্যামনগর থেকে টাঙ্গাইলের ছোট বাসালিয়ায় আসা মৌ খামারি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ও কালীগঞ্জ থেকে টাঙ্গাইলের কুইজবাড়ি আসা খলিল মিয়া হতাশার কথা শোনান।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, দেশে সিরাজগঞ্জের পর টাঙ্গাইলে সর্বোচ্চ পরিমাণ সরিষা চাষ হয়। প্রতি বছর সাতক্ষীরাসহ অন্যান্য জেলা থেকে খামারিরা তাদের মৌ কলোনি নিয়ে মধু সংগ্রহে আসেন এই এলাকার সরিষা খেতগুলোয়।

তারা ডেইলি স্টারকে জানান, বছরে ৫ বার মধু সংগ্রহ করা হয়। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত সরিষা ফুল থেকে, জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ধনিয়া ও কালিজিরা থেকে, মার্চে লিচু বাগান থেকে, মার্চ-এপ্রিলে সুন্দরবনের কেওড়া, খলিশা, গোরান ও বাইন ফুল থেকে এবং মে-জুনে তিল থেকে তারা মধু সংগ্রহ করেন।

মধু চাষ
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার গালা এলাকায় মৌ চাষি। ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

বাকি ৫ মাস মৌ খামারিদের 'অফ সিজন' উল্লেখ করে তারা আরও জানান, সেসময় খামারিরা মৌমাছিগুলোকে চিনি খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখেন।

টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নার্গিস আক্তার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ বছর জেলার ১২ উপজেলায় প্রায় ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। গত বছর জেলার বেশ কয়েকটি সরিষা ক্ষেতে ১৭ হাজার মৌ কলোনি বসানো হয়েছিল। মধু উৎপাদিত হয়েছিল ৮৮ টন।'

'এ বছর একই সংখ্যক মৌ কলোনি বসানোর লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। মধু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৯০ টন। গত ১ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৯ হাজার মৌ কলোনি বসানো হয়েছে,' যোগ করেন তিনি।

টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মাহমুদুল হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পরাগায়নে সহায়তা করে মৌমাছি শস্যের উৎপাদন বাড়ায়। আগে সরিষা চাষিরা উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কায় মৌ কলোনি বসাতে ভয় পেতেন।'

তার মতে, খেতের পাশে মৌ কলোনি বসালে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ উৎপাদন বাড়ে, তা বোঝানোর পর সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কৃষকরা এ বিষয়ে তাদের মন পরিবর্তন করেছেন।

'সরিষা ফুলের মধু অনেক পুষ্টিকর' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'দেশের খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোয় মধুর ব্যাপক চাহিদা আছে। মধু উৎপাদনে সম্ভাবনাও বিপুল। চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ মধু আমদানি করা হয়। স্বল্প পরিমাণ মধু রপ্তানিও হচ্ছে। আমরা মধুর ব্র্যান্ডিং করতে পারি।'

মৌচাষি কল্যাণ সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার পাঁচ তেরিল্লা গ্রামের খামারি দুলাল হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এবার আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় মধু উৎপাদন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে গেছে। মধ্যস্বত্বভোগীরা সরিষার মধুর মণ প্রতি দাম ৬ হাজার টাকার পরিবর্তে ৪ হাজার টাকা বলছেন। এমন হলে দেশের খামারিরা টিকে থাকতে পারবে না।'

অসচ্ছল খামারিরা কম দামে মধু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন বলেও জানান তিনি।

তিনি আরও জানান, দেশে আড়াই হাজারের বেশি মৌ খামারি আছেন। তাদের মধ্যে টাঙ্গাইলে আছেন শতাধিক খামারি। তাদের অর্ধেকই বাণিজ্যিকভাবে মধু উৎপাদন করেন।

তার মতে, খামারিরা বছরে ৩ হাজার টনের বেশি মধু উৎপাদন করে থাকেন। এর মধ্যে প্রায় ১ হাজার টন করে সরিষা ও লিচু থেকে আসে।

দুলাল হোসেন মনে করেন, উৎপাদিত মধুর ন্যায্য মূল্য না পাওয়াসহ অন্যান্য কারণে খামারির সংখ্যা ও মধু উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

কয়েকজন খামারি ডেইলি স্টারকে জানান, তাদের উৎপাদিত মধুর প্রধান ক্রেতা এপি, স্কয়ার ও মর্ডানসহ অন্যান্য খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান।

এ ছাড়াও, ব্যক্তি পর্যায়ে কয়েকজন ব্যবসায়ী খামারিদের কাছ থেকে মধু কিনে বিদেশে, বিশেষ করে ভারতে রপ্তানি করেন।

খামারিদের অভিযোগ, তাদের ঠকিয়ে কম দামে মধু কিনে ভারতে রপ্তানির পর সেখান থেকে মধু বেশি দামে বাংলাদেশে আনা হয়।

উৎপাদিত মধুর ন্যায্য মূল্য পেতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকেই কোনো সহায়তা পাচ্ছেন না বলেও জানান খামারিরা।

তাদের দাবি, সরকার যেন এই সম্ভাবনাময় খাতের দিকে বিশেষ নজর দেয়।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) টাঙ্গাইলের সহকারী মহাব্যবস্থাপক শাহনাজ বেগম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কয়েক বছর আগেও খামারিদের প্রশিক্ষণ ও ২৫ হাজার টাকা করে ঋণ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে এ কার্যক্রম বন্ধ আছে।'

'অনেকেই সেই ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি,' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'খামারিরা ঋণের পরিমাণ এক লাখ টাকা পর্যন্ত করার দাবি করছেন। আমরা সেই প্রস্তাব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠিয়েছি। এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।'

Comments