বিপ্লবী উল্লাসকরের জন্মভিটা সংরক্ষণে ডিসিকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চিঠি
দীর্ঘদিন ধরে ব্যক্তি মালিকানাধীন ও অস্তিত্ব সংকটে থাকা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের জন্মভিটা অবশেষে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।
শতবর্ষী এই বাড়িটি পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণ করতে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসককে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ শাখার মহাপরিচালক চন্দন কুমার দের সই করা চিঠি গত বৃহস্পতিবার পাঠানো হয়েছে বলে দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক মো. শাহগীর আলম।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার কালীকচ্ছ গ্রামে অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে অগ্নিগর্ভ বাংলার অন্যতম বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের সর্বশেষ স্মৃতি নিয়ে ডেইলি স্টারসহ কয়েকটি গণমাধ্যম সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই এই উদ্যোগ নেয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ।
এর আগে, জরাজীর্ণ ঐতিহাসিক ভবনটির সামনের অংশের খালি জায়গায় পাকা ভবন তৈরি করে ঢেকে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন ক্রয়সূত্রে বাড়িটির মালিক দাবি করা কালিকচ্ছ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আহমেদুর রহমান।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চিঠিতে বলা হয়, জেলা প্রশাসন থেকে গত ৭ ডিসেম্বর তাদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের জীবন ও কর্মের সাক্ষী হিসেবে তার বসতভিটার ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকার কথা উল্লেখ করা হয়। প্রত্নসম্পদ আইন ১৯৬৮ মোতাবেক, সংরক্ষণ করা যায় এমন প্রতিবেদন পাওয়া গেছে।
কোনো পুরাকীর্তি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী স্থানীয় প্রশাসনের নির্ধারিত ছকে সুস্পষ্ট মতামত ও ভূমি তফসিল থাকা প্রয়োজন। উল্লাস করের এই বসতভিটা সংরক্ষিত ঘোষণার গেজেট জারি হওয়ার পর বাজেট পাওয়া সাপেক্ষে ভূমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হবে।
প্রায় ৩৩ বছর পর এই বিপ্লবীর জন্মভিটা সংরক্ষণের উদ্যোগকে সংশ্লিষ্টরা অভিনন্দন জানিয়ে দ্রুত তা বাস্তবায়নের দাবি জানান।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমির সভাপতি কবি জয়দুল হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অগ্নিযুগের এই অগ্নিপুরুষের আত্মত্যাগের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে তার জরাজীর্ণ বাড়ির স্মৃতি সংরক্ষণ জরুরি। তার বাড়ি ঢেকে দিয়ে নতুন করে যে পাকা স্থাপনা করার কাজ চলছিল, তা যদি শেষ হতো তাহলে বাড়িটি উদ্ধারের প্রক্রিয়া আর কার্যকর করা যেত না।'
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি জহিরুল ইসলাম চৌধুরী স্বপন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'লন্ডন থেকে উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত পণ্ডিত দ্বিজ দাস দত্তের ছেলে উল্লাসকর দত্ত ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত বিপ্লবী। আলীগড় মামলার আসামি ছিলেন তিনি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যার বিশাল অবদান, তার বাড়ির অস্তিত্ব এভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে যারা নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের বিচার হওয়া উচিত।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা চাই প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর তার বাড়ির জায়গা অধিগ্রহণ করে সেখানে স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার তৈরি করুক।'
সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই বাড়িটির সঙ্গে সরাইল তথা বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের ইতিহাস জড়িত। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের অবদান ভারতবাসী শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। ব্রিটিশদের অস্ত্রাগার, সরকারি ডাক লুণ্ঠনের মাধ্যমে যিনি আন্দোলন চালিয়ে রেখেছিলেন, তার বাড়িটি উদ্ধার করে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হোক।'
'আগেও আমি একাধিকবার জাতীয় সংসদে এই দাবি তুলেছিলাম,' যোগ করেন তিনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক মো. শাহগীর আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই বাড়ির মালিকানার বিষয়ে খোঁজ নিতে প্রথমে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এরপর তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সেখানে পাকা ভবন তৈরির কাজ বন্ধ করে দেন।'
তিনি আরও বলেন, 'প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর থেকে পাঠানো চিঠিতে যে নির্দেশনা দেওয়া আছে, সে অনুযায়ী বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
অবিভক্ত বাংলার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার কালিকচ্ছ গ্রামে জন্ম নেওয়া উল্লাসকর দত্ত কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন। পরে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিবিদ্যায় ডিগ্রি অর্জন করেন।
কলেজে পড়ার সময় ইংরেজ অধ্যাপক রাসেল বাঙালিদের সম্পর্কে কটূক্তি করায় তিনি ওই অধ্যাপককে আঘাত করেন, এ জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে বহিষ্কার করেছিল।
পরে বিপিন চন্দ্র পালের অনুপ্রেরণাতে উল্লাসকর দত্ত প্রথম বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। এরপর যুগান্তর দলে যোগ দেন তিনি। তিনি বিস্ফোরক নির্মাণে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তার ফর্মুলায় তৈরি বোমা পরীক্ষা করার জন্য একদল বিপ্লবী বেছে নেন দেওঘরের কাছে নির্জন দীঘারিয়া পাহাড়। ১৯০৮ সালের ১ মে সেই পরীক্ষার দিন বোমা ছোড়ার সময় আহত হয়ে মারা যান বিপ্লবী প্রফুল্ল চক্রবর্তী। উল্লাসকর মারাত্মক জখম হন।
উল্লাসকরের তৈরি বোমায় ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে আক্রমণে ব্যবহার করেছিলেন। তবে এই হামলা বানচাল হয়ে যায় এবং পুলিশ উল্লাসকর দত্তসহ যুগান্তর দলের অনেক সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।
উল্লাসকর ১৯০৮ সালের ২ মে মুরারিপুকুর বাগানে ধরা পড়েন। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে আলিপুর বোমা মামলায় উল্লাসকর এবং বারীণ ঘোষকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। তবে পরবর্তীকালে এই সাজা রদ করে তাকে আন্দামানের সেলুলার জেলে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা দেওয়া হয়।
আন্দামানের সেলুলার জেলে উল্লাসকর দত্তকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। এর ফলে তিনি সাময়িকভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ১৯২০ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হলে তিনি কলকাতা শহরে আসেন। ১৯৩১ সালে তাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১৮ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
১৯৪৭ সালে ভারতভাগের পর তিনি গ্রামের বাড়ি কালিকচ্ছ ফিরে আসেন। ১৯৪৮ সালে সেখানে ৬৩ বছর বয়সে বিপিন চন্দ্র পালের বিধবা মেয়েকে বিয়ে করেন। ১০ বছর পর তিনি কলকাতায় ফিরে যান। উল্লাসকর তার শেষ জীবন আসামের শিলচরে কাটান এবং সেখানেই ১৯৬৫ সালের ১৭ মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
Comments