বছরের শুরু কেন জানুয়ারি থেকে

রোমান প্রজাতন্ত্রের সময় প্রাচীরে আঁকা ক্যালেন্ডারের একটি কপি। ছবি: সংগৃহীত

বর্তমানে বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলে যে ক্যালেন্ডারটি ব্যবহার হয় তা হলো গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। জানুয়ারিকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস ধরা হয়। প্রশ্ন জাগতে পারে, এতগুলো মাস থাকতে কেন জানুয়ারিকেই প্রথম মাস হিসেবে ধরা হয়?

নববর্ষের শুরু এখন ১ জানুয়ারি থেকে ধরা হলেও বিষয়টি সবসময় এরকম ছিল না। এমনকি অতীতে বিভিন্ন সময়ে অন্যান্য তারিখ যেমন ২৫ মার্চ, ২৫ ডিসেম্বরসহ বিভিন্ন তারিখ থেকে বছরের শুরু ধরা হতো।

চলুন দেখে নেওয়া যাক ১ জানুয়ারির নববর্ষের প্রথম দিন হয়ে ওঠার পেছনের ইতিহাস।

জানুয়ারির উৎপত্তি

মূল রোমান ক্যালেন্ডারে মোট মাস ছিল ১০টি, যেখানে দিন ছিল ৩০৪টি। শীতকালের সময়কে তারা মাসহীন সময় হিসেবে বিবেচনা করতো। রোমুলাসের উত্তরসূরি রাজা নুমা পম্পিলিয়াস প্রায় ৭১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এতে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাস যোগ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। যাতে ক্যালেন্ডারটি একটি আদর্শ চন্দ্র বছর অর্থাৎ ৩৫৪ দিন পূর্ণ করে। 

পুরনো রোমান ক্যালেন্ডারে মার্চকে প্রথম মাস হিসেবে ধরা হতো। ধারণা করা হয়, নুমা কিংবা মতান্তরে ডিসেমভিয়ারদের অধীনে ক্যালেন্ডারে বছরের প্রথম মাস হয়ে ওঠে জানুয়ারি।

তবে কিছু সূত্র দাবি করে যে, নুমা জানুয়ারি মাস তৈরি করলেও, ১৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত ১ জানুয়ারিকে আনুষ্ঠানিকভাবে রোমান বছরের সূচনা হিসেবে ধরা হয়নি।

এক্ষেত্রে মার্চকে প্রতিস্থাপিত করে জানুয়ারিকে প্রথম মাস হিসেবে ধরার পেছনে একটি উপযুক্ত যুক্তি ছিল। যেহেতু জানুয়ারির নামকরণ করা হয়েছিল রোমান দেবতা জানুসের নামানুসারে, যাকে সমস্ত কিছুর শুরুর দেবতা হিসেবে ধরা হয়। অন্যদিকে মার্চ এসেছে তাদের যুদ্ধের দেবতা মার্স-এর নামানুসারে। 
 

জুলিয়ান ক্যালেন্ডার

রোমান শাসক হওয়ার পরপরই জুলিয়াস সিজার সিদ্ধান্ত নেন যে প্রচলিত রোমান ক্যালেন্ডারের সংস্কারের অত্যন্ত প্রয়োজন। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর কাছাকাছি প্রবর্তিত রোমান ক্যালেন্ডারটি চন্দ্র চক্র অনুসরণের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু প্রায়শই ঋতুর সঙ্গে এর বিচ্যুতি ঘটতো। যার কারণে এটি বার বার সংশোধন করতে হতো। 

তার ওপর ক্যালেন্ডারের তত্ত্বাবধানে ছিল পোন্টিফিস নামক একটি রোমান সংস্থা। তাদের বিরুদ্ধে প্রায়ই রাজনৈতিক ক্ষমতার সময় বাড়ানো কিংবা নির্বাচনে হস্তক্ষেপের জন্য দিন যোগ করে কর্তৃত্বের অপব্যবহারের অভিযোগ উঠে। 

যার ফলস্বরূপ ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জুলিয়াস সিজার রোমান ক্যালেন্ডারে কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে যা জুলিয়ান ক্যালেন্ডার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। 

সিজার তার নতুন ক্যালেন্ডার নকশার সময় আলেকজান্দ্রিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানী সোসিজেনেসের সহায়তা নেন। তিনি সিজারকে মিশরীয়দের মতো চন্দ্র চক্র অনুসরণ সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়ে সৌর বছর অনুসরণের পরামর্শ দেন। তখন বছরকে মোট ৩৬৫ যোগ ১/৪ দিন হিসেবে গণনা করা হয়। তারপর সিজার ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের সঙ্গে ৬৭ দিন যোগ করে তাকে ৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ করেন। তিনি সেখানে ১ জানুয়ারিকে বছরের শুরুর তারিখ হিসেবে ধরেন। 

রোমান সাম্রাজ্যের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ব্যবহারও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

তবে ৫ম শতাব্দীতে রোমের পতন ঘটলে। অনেক খ্রিস্টান দেশ ক্যালেন্ডারে কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসে। যাতে করে ক্যালেন্ডারটি তাদের ধর্মের আরও প্রতিফলন ঘটাতে পারে। তখন ২৫ মার্চের দ্য ফিস্ট অফ দ্য অ্যানানসিয়েসনের তারিখ এবং ২৫ ডিসেম্বরের বড়দিনের তারিখ নববর্ষের প্রথম দিন হয়ে ওঠে। 

গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার

জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে কিছু ত্রুটি ছিল। দেখা যায় ক্যালেন্ডারটিতে লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষ সংক্রান্ত কিছু ভুল গণনা ছিল। যার কারণে এর কিছু পরিবর্তন অত্যাবশ্যক হয়ে উঠে। কেননা কয়েক শতাব্দী ধরে এই ত্রুটির ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ফলে মৌসুম নির্ধারণে ভুল হওয়ার পাশাপাশি নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে থাকে। 

যার ফলস্বরূপ জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের পরিবর্তন এবং প্রতিস্থাপন হিসেবে চালু করা হয় বর্তমানের গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারটি। যা ১৫৮২ সালের অক্টোবরে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি দ্বারা সংশোধিত এবং প্রবর্তিত হয়।

অধিবর্ষের সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার আবার ১ জানুয়ারিকে নতুন বছরের শুরু হিসেবে পুনরুদ্ধার করে।

ইতালি, ফ্রান্স এবং স্পেন সেই দেশগুলির মধ্যে ছিল যারা দ্রুতই এই নতুন ক্যালেন্ডার গ্রহণ করে নেয়। তবে প্রোটেস্ট্যান্ট এবং অর্থোডক্স প্রধান দেশগুলো এটি বেশ দেরিতে গ্রহণ করে। গ্রেট ব্রিটেন এবং এর আমেরিকান উপনিবেশগুলো ১৭৫২ সাল পর্যন্ত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা শুরু করেনি। এর আগ পর্যন্ত তারা ২৫ মার্চকেই নববর্ষের প্রথম দিন হিসেবে উদযাপন করতো।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খ্রিস্টান প্রধান নয় এমন দেশও গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করতে শুরু করে। তবে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে এমন অনেক দেশে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যগত বা ধর্মীয় ক্যালেন্ডারও রয়েছে।

যেমন, বাংলাদেশের নিজস্ব বাংলা ক্যালেন্ডার রয়েছে। যা থেকে আমরা বাংলা নববর্ষ উদযাপন করি। এছাড়া ১৯১২ সাল থেকে চীন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণ করলেও তাদের নিজস্ব চন্দ্র ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তারা চীনা নববর্ষ উদযাপন অব্যাহত রেখেছে। এরকম আরও অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।

তবে কিছু দেশ কখনই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণ করেনি। তারা ১ জানুয়ারি ছাড়া অন্য তারিখেও বছর শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ, ইথিওপিয়া সেপ্টেম্বর মাসে এনকুটাটাশ নামে পরিচিত নববর্ষ উদযাপন করে থাকে।

 

তথ্যসূত্র: এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, হিস্টোরি টিভি

Comments

The Daily Star  | English

Nahid warns against media intimidation, vows stern action

The government will take stern action against those trying to incite violence or exert undue pressure on the media or newspapers, said Information Adviser Nahid Islam today

1h ago