টেক বিলিয়নিয়ারদের দুর্ভাগ্যের বছরে ৫ এশিয়ান শিল্পপতির উত্থান

টেক বিলিয়নিয়ারদের দুর্ভাগ্যের বছরে ৫ এশিয়ান শিল্পপতির উত্থান
গৌতম আদানি, লো টাক কোয়ং, কলিন ঝেং হুয়াং, উ ইলিং ও রবি জয়পুরিয়া। ছবি: সংগৃহীত

'কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ', বাংলা সংস্কৃতির এই জনপ্রিয় প্রবাদটা বিলিয়নিয়ারদের তালিকায় ২০২২ সালকে প্রতিনিধিত্ব করে। বিশ্ব অর্থনীতিতে বিদায়ী বছরটা অধিকাংশ বিলিয়নিয়ারদের জন্যে দুঃস্বপ্নের হলেও এই বছরকে আশীর্বাদ রূপে পেয়েছেন এশিয়ার ৫ জন বিলিয়নিয়ার। 

বিশ্বব্যাপী বিলিয়নিয়ারেরা যেখানে প্রায় ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সম্পদ হারিয়েছেন, সেখানে এই ৫ জনের সম্পদে যুক্ত হয়েছে ৯১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। এই রদবদলের বছরে টেক বিলিয়নিয়ারদের শ্রেষ্ঠত্বে ভাগ বসিয়েছে ভোক্তাসহ ভিন্ন ধারার ব্যবসায়ীরা।

আশীর্বাদপুষ্ট এশিয়ান পঞ্চপাণ্ডবদের মধ্যে অন্যতম একজন ভারতীয় ব্যবসায়ী গৌতম আদানি, বছর শেষে এই ভারতীয় সবাইকে তাক লাগিয়ে সম্পদশালীদের তালিকা থেকে জেফ বেজোস ও বিল গেটসকে হটিয়ে স্থান করে নেন সেরা ৫ ধনকুবেরের তালিকায়। ব্লুমবার্গ ইনডেক্সের ২৬ ডিসেম্বরের তালিকা অনুযায়ী, মোট নিট সম্পদের দিক থেকে বিশ্বের তৃতীয় ধনকুবের এই ভারতীয়। তার উপরে অবস্থান করছেন টেসলা প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক এবং ফ্রেঞ্চ বিলিয়নিয়ার বার্নার্ড আর্নল্ট।

অর্থনৈতিক মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানি সংকট এবং এর ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্যে কয়লার চাহিদা বৃদ্ধি, নীতিমালায় পরিবর্তনসহ নানা কারণে প্রযুক্তি খাত ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন। স্ট্যানফোর্ড গ্রাজুয়েট স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক জেফরি ফেফার অবশ্য প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর কপি-কাট সংস্কৃতিকে দায়ী করেছেন। প্রযুক্তি-ক্ষেত্রের অধিকাংশ কোম্পানি সফল কিছু কোম্পানিকে হুবহু নকল করে, এই প্রবণতাকে সামাজিক সংক্রমণ বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। 

ফলে, বিশ্বব্যাপী কয়েকটি টেক জায়ান্ট যখন কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছে, অন্যরা সেই পথেই হেঁটেছে। বিদায়ী বছরে মেটা, টুইটার, নেটফ্লিক্স, আমাজন ও গুগলসহ ছোট-বড় কোম্পানিগুলো থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি কর্মী। এমন অস্থির অবস্থার কারণে শেয়ার বাজারগুলোতে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোতে ধস নামে। 

সিএনবিসির এক তথ্যসূত্রে জানা যায়, নাসডাকের ২০২২ সালের ১২ মাসের তথ্য অনুযায়ী বিনিয়োগকারীরা হারিয়েছেন প্রায় ৭ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। 

এই বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির মধ্যেই বাজিমাত করেছেন এশিয়ার ৫ ব্যবসায়ী। আজকের আলোচনায় থাকছে ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি ডলার অর্জনকারী ৫ বিলিয়নিয়ারকে নিয়ে।
 
গৌতম আদানি

গুজরাটের আহমেদাবাদে জন্ম নেওয়া ভারতীয় এই শিল্পপতি বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে আচমকা স্থান করে নিয়েছেন বিশ্বের শীর্ষ ধনকুবেরদের অভিজাত তালিকায়। আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান গৌতম আদানি বিলিয়নিয়ারদের এই অভিজাত ক্লাবে ঢুকতে গিয়ে টপকেছেন জেফ বেজোস, বিল গেটস কিংবা ওয়ারেন বাফেটের মতো ধনকুবেরকে। ২০২২ সালে আদানির অর্জিত সম্পদের পরিমাণ ছিল ৫৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি। 

আদানি গ্রুপের মালিকানায় রয়েছে একাধিক বন্দর, মহাকাশ প্রযুক্তি, তাপশক্তি ও কয়লার ব্যবসা। এ বছর তিনি সুইস সিমেন্ট কোম্পানি হোলসিম-এর ভারতীয় শাখা অধিগ্রহণ করলে আদানি গ্রুপ পরিণত হয় ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম সিমেন্ট উৎপাদনকারীতে। ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে, আদানি গ্রুপ ভারতের প্রভাবশালী টেলিভিশন নেটওয়ার্ক এনডিটিভির (নিউ দিল্লি টেলিভিশন লিমিটেড) সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ারহোল্ডার হয়ে ওঠে।  

লো টাক কোয়ং

আদানির পরেই বিদায়ী বছরে সম্পদ অর্জনের দিক থেকে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে আছেন আরেকজন নন-টেক বিলিয়নিয়ার লো টাক কোয়ং। কোয়ংকে বলা হয় ইন্দোনেশিয়ার কোল কিং বা কয়লা সম্রাট। ২০২২ সালে এই শিল্পপতির কোম্পানি বায়ান রিসোর্সের শেয়ার দর ৩ গুণ বৃদ্ধি পায়। 

ফোর্বসের চলতি বছরের ২১ ডিসেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যসূত্রে ইন্দোনেশিয়ার দ্বিতীয় শীর্ষ এই ধনকুবেরের সম্পদের পরিমাণ ১৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার মধ্যে বিদায়ী বছরের অর্জিত হয়েছে প্রায় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ, বিগত বছরের তুলনায় ২০২২ সালের এই মন্দার বছরে কোয়ং ৯ গুণ বেশি ধনী হয়েছে।

কলিন ঝেং হুয়াং

২০২২ সালে বাজিমাত করা ৫ ধনকুবেরের মধ্যে একমাত্র হুয়াং টেক বিলিয়নিয়ার। চীনের ডিসকাউন্ট ই-কমার্স জায়ান্ট পিনদুওদো-এর প্রতিষ্ঠাতা। সাংহাই ভিত্তিক এই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানটি নাসডাকে তালিকাভুক্ত কোম্পানি। বিদায়ী বছরের থার্ড কোয়ার্টারে তার কোম্পানির শেয়ার দর ৬৫ শতাংশ বেড়ে যায়, যা হুয়াংয়ের সম্পদ অর্জনে বড় ভূমিকা রাখে।

চীনের এই ধনকুবেরের সমাজসেবী হিসেবে বেশি খ্যাতি আছে। ঝেং হুয়াং নামে অধিক পরিচিত এই চীনা ব্যবসায়ীর ই-কমার্স প্লাটফর্ম মূলত ছাড়ে পণ্য বিক্রির জন্যে বিখ্যাত। ফোর্বস সূত্রে, এই ব্যবসায়ীর সম্পদের পরিমাণ ৩১ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার মধ্যে ২০২২ সালেই ১১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্জিত হয়। অর্থাৎ, তার মোট সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ আয় হয় এ বছরে। 

উ ইলিং 

করোনা মহামারির উৎপত্তিস্থল চীনের এই ব্যবসায়ী করোনার ওষুধ বিক্রির মাধ্যমে সম্পদশালী হয়ে যান। শেনঝেন তালিকাভুক্ত শিজিয়াজুয়াং এ অবস্থিত কোম্পানি ইলিং ফার্মাসিউটিক্যালসের চেয়ারম্যান ইলিং। ইলিং ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রতিষ্ঠাতা উ ইলিংয়ের বাবা। এই কোম্পানিটি অন্যান্য ওষুধের পাশাপাশি কার্ডিওভাস্কুলার ও ফ্লু ড্রাগ উৎপাদনে বিখ্যাত। 

করোনা চিকিৎসায় ব্যবহৃত ভেষজ ওষুধ বিক্রির মাধ্যমে ইলিংয়ের মূল কোম্পানি লিয়ানহুয়া কিংওয়েনের শেয়ারদর বৃদ্ধি পায় ৬১ শতাংশ। ফোর্বস তথ্যসূত্রে, ইলিংয়ের বর্তমান সম্পদের পরিমাণ ৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ২০২২ সালেই অর্জিত হয়েছে ৪ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি। 
 
রবি জয়পুরিয়া

অর্থনৈতিক মন্দার বছরে সম্পদ বিপুল সম্পদ অর্জনের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ভারতের বহুজাতিক শিল্পগোষ্ঠী আরজে কর্প-এর মালিক রবি জয়পুরিয়া। এই শিল্পপতি ২০২২ সালে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ অর্জন করেন, যার তার নিট সম্পদকে নিয়ে যায় ৯ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে। 

আরজে কর্প মূলত বেভারেজ, হেলথ-কেয়ারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের একটি বহুজাতিক সংস্থা। যার মধ্যে বরুন বেভারেজ, দিভ্যিয়ানি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড অন্যতম অঙ্গসংস্থা। বরুন বেভারেজ যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে পেপসিকোর অন্যতম বড় ফ্রাঞ্চাইজি। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির আওতায় আছে কেএফসি, পিৎজা হাট এবং কোস্টা কফির মতো বিখ্যাত সব ব্রান্ডের ফ্রাঞ্চাইজি। বিদায়ী বছরে আরজে কর্পের শেয়ারদর ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।  
 
এই ৫ বিলিয়নিয়ারের ৪ জনই নন টেক শিল্পের সঙ্গে জড়িত। যার মধ্যে প্রথম দুজন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিনিয়োগকারী। চলতি বছরের শুরুতে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট সংকটের সুযোগ কাজে লাগিয়ে বছরটিকে আশীর্বাদে পরিণত করেন এই কয়লা ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে, কর্মী ছাঁটাইসহ নানা কারণে বছরটি দুঃস্বপ্নে পরিণত হয় টেক বিলিয়নিয়ারদের কাছে। 
 

তথ্যসূত্র: ফোর্বস, ব্লুমবার্গ, সিএনবিসি, স্ট্যানফোর্ড নিউজ

 

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

7h ago